‘ফাঁকা গুলি ছুড়তে ছুড়তে ইসরায়েলি সেনারা হাসপাতালে ঢোকে’

এক সেনা লাউডস্পিকারে আরবিতে বলেন, ’১৬ বা তার চেয়ে বেশি বয়সী সব পুরুষ মাথার উপর দুই হাত তুলে দাঁড়ান’।
আল-শিফা হাসপাতালে ইসরায়েলের হামলা চলার সময় রোগীদের নিরাপদ জায়গায় সরিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করছেন স্বাস্থ্যকর্মীরা। ছবি: রয়টার্স
আল-শিফা হাসপাতালে ইসরায়েলের হামলা চলার সময় রোগীদের নিরাপদ জায়গায় সরিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করছেন স্বাস্থ্যকর্মীরা। ছবি: রয়টার্স

গাজার আল-শিফা হাসপাতালের গেট দিয়ে ফাঁকা গুলি ছুঁড়তে ছুঁড়তে ঢুকে পড়েছে ইসরায়েলি সেনাদল। হামাসের বিরুদ্ধে চলমান যুদ্ধে হাসপাতালের একটি অংশে এই সশস্ত্র হামলা শুরু করেছে ইসরায়েল। 

আজ বুধবার এএফপি, রয়টার্স, আল জাজিরা ও সিএনএনের  প্রতিবেদনে উঠে এসেছে এই অভিযানের বর্ণনা।

যেভাবে শুরু হল অভিযান

এক সেনা লাউডস্পিকারে আরবিতে বলেন, '১৬ বা তার চেয়ে বেশি বয়সী সব পুরুষ মাথার উপর দুই হাত তুলে দাঁড়ান'।

'ভবন থেকে বের হয়ে হাসপাতাল প্রাঙ্গণে এসে আত্মসমর্পণ করুন', সেনাটি নির্দেশ দেয়।

হাসপাতালের ভেতর আটকে পড়া এক সাংবাদিক এএফপিকে এই তথ্য জানান।

ইসরায়েলের দাবি, হামাস কর্মীরা আল-শিফা হাসপাতালে লুকিয়ে আছে এবং এই হাসপাতালটির নিচেই ফিলিস্তিনি এই সংগঠনটির ভূগর্ভস্থ সুড়ঙ্গ নেটওয়ার্কের মূল নিয়ন্ত্রণকেন্দ্রের অবস্থান।

হাসপাতাল কমপাউন্ডের ভেতরের চিত্র। ছবি: রয়টার্স
হাসপাতাল কমপাউন্ডের ভেতরের চিত্র। ছবি: রয়টার্স

সেই দাবির জেরেই ইসরায়েল এই হামলা শুরু করেছে। তবে, হামাস বলছে, ওই হাসপাতালটিতে তাদের কোনো কর্মী লুকিয়ে নেই এবং সেখানে তাদের কোনো সুড়ঙ্গ নেই।

ইসরায়েলি ও ফিলিস্তিনি কর্মকর্তারা নিশ্চিত করেছেন, আল-শিফায় রাতভর সামরিক অভিযান চলেছে।

উল্লেখিত সাংবাদিক জানান, ইসরায়েলি বাহিনীর সদস্যরা দ্রুতগতিতে হাসপাতালের করিডর ধরে এগিয়ে যান। এ সময় বিভিন্ন ওয়ার্ড থেকে অসংখ্য তরুণ বের হয়ে আসেন।

তিনি আরও জানান, সেনারা এক কক্ষ থেকে আরেক কক্ষে হামাস-কর্মীদের খোঁজার সময় সতর্কতামূলক ফাঁকা গুলি ছোড়েন।

প্রত্যক্ষদর্শী সাংবাদিক আরও জানান, হাসপাতাল কমপ্লেক্সে বেশ কয়েকটি ইসরায়েলি ট্যাংক প্রবেশ করেছে।

হাসপাতাল পরিস্থিতি

বেশ কয়েকদিন ধরেই আল-শিফা হাসপাতালের আশেপাশের এলাকাগুলোতে চলছে হামাস ও ইসরায়েলের মধ্যে স্থল যুদ্ধ। এর মাঝে থেমে নেই ইসরায়েলের নির্বিচার বোমাবর্ষণও।

হাসপাতাল থেকে কেউ বেরও হতে পারছেন না, সেখানে কেউ ঢুকতেও পারছেন না। বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও চিকিৎসাসামগ্রীর অভাবে হাসপাতালের রোগী, চিকিৎসক ও সেখানে আশ্রয় নেওয়া বাস্তুচ্যুত মানুষ চরম দুর্দশার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে।

প্রত্যক্ষদর্শীরা হাসপাতালের ভেতরের পরিস্থিতিকে 'ভয়াবহ' বলে বর্ণনা করেছেন। তারা জানান, চেতনানাশক উপকরণ ছাড়াই অনেক রোগীর সার্জারি করতে হচ্ছে। বাস্তুচ্যুত মানুষরা হাসপাতালের করিডরে আশ্রয় নিয়েছেন।

চেতনানাশক ছাড়াই এরকম অস্থায়ী অপারেশ থিয়েটারে রোগীদের সার্জারি করছেন চিকিৎসকরা। ছবি: রয়টার্স
চেতনানাশক ছাড়াই এরকম অস্থায়ী অপারেশ থিয়েটারে রোগীদের সার্জারি করছেন চিকিৎসকরা। ছবি: রয়টার্স

তাদের কাছে সামান্য খাবার-পানি রয়েছে, যা খুব শিগগির ফুরিয়ে যাবে।

নিহতদের লাশ দাফন করারও জায়গা নেই—পচা লাশের গন্ধে ভরে গেছে পুরো হাসপাতাল। হাসপাতালটির পরিচালক মোহাম্মাদ আবু সালমিয়া গতকাল জানান, কমপ্লেক্সের ভেতর গণকবরে খুঁড়ে ১৭৯টি মরদেহ কবর দেওয়া হয়েছে।

অভিযান নিয়ে ইসরায়েল যা বলেছে

ইসরায়েলের সেনাবাহিনী আজ দিনের শুরুতে এক বিবৃতিতে জানায়, '(হাসপাতালের) একটি সুনির্দিষ্ট জায়গায়, পূর্ব নির্ধারিত লক্ষ্যবস্তুতে হামাসের বিরুদ্ধে এই নিখুঁত অভিযান পরিচালনা করা হচ্ছে।'

সেনাবাহিনী অপর এক বিবৃতিতে দাবি করে, অভিযানের সময় তারা হাসপাতালে ইনকিউবেটর, শিশুদের জন্য খাবার ও চিকিৎসা সামগ্রী পৌঁছে দিয়েছে।

'আমাদের মেডিকেল টিম ও আরবি ভাষায় কথা বলতে পারেন এমন সেনারা এই অভিযানে আছেন। তাদের দায়িত্ব এসব উপকরণ সঠিক মানুষের হাতে তুলে দেওয়া', দাবি করে ইসরায়েল।

ইসরায়েলি সেনাবাহিনীর মুখপাত্র লেফটেন্যান্ট কর্নেল পিটার লার্নার সিএনএনকে জানান, '(আল-শিফা) হাসপাতাল ও কমপাউন্ড হামাসের সব কার্যক্রমের কেন্দ্র। এমন কী, একে আমরা (হামাসের) হৃদযন্ত্র বা মধ্যাকর্ষণকেন্দ্র হিসেবেও বিবেচনা করতে পারি।'

ফিলিস্তিনের বক্তব্য

ফিলিস্তিনের স্বাস্থ্যমন্ত্রী মাই আল-কাইলা এক বিবৃতিতে ইসরায়েলি বাহিনীর এই অভিযানকে 'মানবতার বিরুদ্ধে নতুন অপরাধ' হিসেবে অভিহিত করেছেন।

ফিলিস্তিনের ওয়াফা সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত বিবৃতিতে তিনি বলেন, 'হাসপাতালে অসহায় রোগীরা আছেন। একইসঙ্গে আছেন চিকিৎসাকর্মীরাও। হাসপাতালে অভিযান চালিয়ে ইসরায়েল মানবতার বিরুদ্ধে চরম অপরাধ করেছে।'

ইসরায়েলি অভিযানে প্রচুর ক্ষয়ক্ষতির শিকার হয়েছে আল-শিফা হাসপাতাল। ছবি: রয়টার্স
ইসরায়েলি অভিযানে প্রচুর ক্ষয়ক্ষতির শিকার হয়েছে আল-শিফা হাসপাতাল। ছবি: রয়টার্স

অভিযান শুরুর কয়েক ঘণ্টা পর গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র আশরাফ আল-কুদরা আল জাজিরাকে বলেন, 'ইসরায়েলি বাহিনী এখন হাসপাতালের বেসমেন্টে আছে। সেখানে তারা তল্লাশি চালাচ্ছে। কমপ্লেক্সের ভেতরেও আছে সেনারা। সেখানে নির্বিচার গুলি ও বোমাবর্ষণ চালাচ্ছে।'

গাজা স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের মহাপরিচালক ড. মুনির আল-বুর্শ আল জাজিরা টিভিতে দেওয়া বক্তব্যে বলেন, ইসরায়েলি বাহিনী হাসপাতাল কমপ্লেক্সের পশ্চিম অংশে হামলা চালিয়েছে।

হোয়াইট হাউজের দাবি

এদিকে হোয়াইট হাউজ জানিয়েছে, মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থার কাছে যে তথ্য আছে, তা ইসরায়েলের দাবির সঙ্গে মিলে যায়।

ইসরায়েলের সঙ্গে সুর মিলিয়ে হোয়াইট হাউজ জানায়, হামাস ও অপর এক সশস্ত্র সংগঠন, ফিলিস্তিনি ইসলামিক জিহাদ তাদের 'নিয়ন্ত্রণকেন্দ্র' আল-শিফার অভ্যন্তরে লুকিয়ে রেখেছে। 

হামাস এসব দাবি অস্বীকার করেছে।

জাতিসংঘের মন্তব্য

জাতিসংঘ জানিয়েছে আল-শিফা হাসপাতালে অন্তত দুই হাজার ৩০০ রোগী, চিকিৎসক ও বাস্তুচ্যুত মানুষ আছেন। নিরবচ্ছিন্ন ড্রোন ও স্নাইপার হামলার কারণে তারা বের হতে পারছেন না।

এ ছাড়া, জাতিসংঘ গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের বরাত দিয়ে জানায়, শুধু মঙ্গলবারেই আল-শিফার ৪০ রোগী মারা গেছেন।

নিহতের সংখ্যা

৭ অক্টোবর ইসরায়েলি ভূখণ্ডে হামাস হামলা চালালে এক হাজার ২০০ ইসরায়েলি নিহত হন। হামাসের হাতে জিম্মি হন প্রায় ২০০ ইসরায়েলি ও বিদেশী নাগরিক। প্রথমে এক হাজার ৪০০ নিহত ও ২৪০ জিম্মির কথা বললেও পরে সংখ্যাটি সংশোধন করে ইসরায়েলি কর্তৃপক্ষ।

এর পর থেকে প্রায় ৪০ দিন ধরে গাজা ভূখণ্ডে নির্বিচার ও প্রতিশোধমূলক বিমান ও স্থল হামলা চালাচ্ছে ইসরায়েল। এই হামলার সর্বশেষ লক্ষ্যবস্তু হল গাজার সবচেয়ে বড় হাসপাতাল আল-শিফা।

Comments

The Daily Star  | English

Has the war in Gaza exposed limitations of free speech in US?

Protests have rocked US university campuses over the last week as pro-Palestinian students have encamped on the grounds of Columbia, Yale, and New York University, among other prestigious educational institutions, urging universities to divest from the state of Israel amid the ongoing genocide.

41m ago