গাজায় যে পরিমাণ বোমা ফেলেছে ইসরায়েল, ভিয়েতনাম যুদ্ধের পর আর দেখা যায়নি
গাজায় যুদ্ধের প্রথম মাসে ইসরায়েল শত শত বিশালাকার বোমা ফেলেছে। যার অনেকগুলোই বিস্ফোরণস্থল থেকে এক হাজার ফুটেরও বেশি দূরত্বে মানুষ হত্যা বা আহত করতে সক্ষম।
সিএনএন ও কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা সংস্থা 'সিনথেটাইক' যুদ্ধের প্রারম্ভিক দিনগুলোর স্যাটেলাইট চিত্র বিশ্লেষণ করে এসব তথ্য জানিয়েছে।
স্যাটেলাইট চিত্রে তারা গাজায় এ পর্যন্ত ১২ মিটার (৪০ ফুট) ব্যাসের ৫০০টিরও বেশি ইমপ্যাক্ট ক্রেটার বা বোমার আঘাতে তৈরি গর্ত দেখতে পায়। যেগুলো সাধারণত দুই হাজার পাউন্ড ওজনের বোমার আঘাতে সৃষ্টি।
প্রাণঘাতী এই বোমাগুলো ৩৬৫ মিটার (এক হাজার ১৯৮ ফুট) ব্যাসার্ধ পর্যন্ত আঘাত হানতে সক্ষম। যা ৫৮টি ফুটবল মাঠের সমান। এই বোমাগুলো আইএসের বিরুদ্ধে যুদ্ধের সময় ইরাকের মসুলে যুক্তরাষ্ট্রের ফেলা বৃহত্তম বোমাটির চেয়েও চারগুণ বড়।
গত ৭ অক্টোবর থেকে গাজায় ইসরায়েলের নির্বিচার হামলায় এ পর্যন্ত প্রায় ২০ হাজার মানুষ নিহত হয়েছেন। যাদের অধিকাংশই নারী ও শিশু।
গাজায় ক্রমবর্ধমান মৃত্যুর জন্য ইসরায়েলের দুই হাজার পাউন্ড ওজনের বোমার মতো ভারী অস্ত্রশস্ত্রের ব্যাপক ব্যবহারকে দায়ী করছেন অস্ত্র ও যুদ্ধ বিশেষজ্ঞরা।
সিআইভিআইসি'র অ্যাডভোকেসি এবং লিগ্যাল ফেলো জন চ্যাপেল বলেন, 'গাজার মতো এরকম ঘনবসতিপূর্ণ এলাকায় দুই হাজার পাউন্ড ওজনের বোমা ব্যবহারের ক্ষয়ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে কয়েক যুগ লেগে যাবে।'
গত সপ্তাহে মার্কিন গোয়েন্দা সূত্র সিএনএনকে জানায়, গাজায় ফেলা ২৯ হাজার এয়ার-টু-সার্ফেস বোমার মধ্যে ৪০ থেকে ৪৫ শতাংশই ছিল তথাকথিত ডাম্ব বোমা। অর্থাৎ এগুলো আনগাইডেড বোমা, যা ঠিক কোথায় আঘাত হানবে তার কোনো নিশ্চয়তা নেই। বিশেষ করে গাজার মতো ঘনবসতিপূর্ণ অঞ্চলে বেসামরিকদের জন্য এগুলো আরও বেশি হুমকিস্বরূপ। এই ডাম্ব বোমাগুলোর মধ্যে কিছু বোমা দুই হাজার পাউন্ড ওজনের ছিল বলে ধারণা করছে সিএনএন। যা গর্তের স্যাটেলাইট ইমেজিংয়ে শনাক্ত হয়েছে।
গত ৩১ অক্টোবর গাজার জাবালিয়া শরণার্থী শিবিরে ইসরায়েলের বোমা হামলায় শতাধিক মানুষ নিহত হন। যেখানে বোমার আঘাতে সৃষ্ট ২৪ মিটার এবং ১৩ মিটার আকারের দুটি বড় গর্ত দেখা যায়। জাতিসংঘ এটিকে 'অ-সমানুপাতিক আক্রমণ, যা যুদ্ধাপরাধ হিসেবে গণ্য হতে পারে' বলে নিন্দা করেছে।
এই বোমা হামলায় আল জাজিরার এক কর্মী পরিবারের ১৯ সদস্যকে হারান। যদিও ইসরায়েল দাবি করে যে, তারা হামাস কমান্ডার ইব্রাহিম বিয়ারিকে লক্ষ্যবস্তু করে এ হামলা চালিয়েছে এবং তার ঘাঁটি ধ্বংস করে তাকে হত্যা করেছে।
গাজায় ইসরায়েলি স্থল বাহিনীর প্রথম প্রবেশ করে অভিযান চালানোর একটি এলাকা বিচ ক্যাম্প। স্যাটেলাইট চিত্রে দেখা যায়, সেখানকার শরণার্থী শিবিরটি ৬ নভেম্বর বোমা হামলার মাধ্যমে একেবারে গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়েছে।
এই হামলা সম্পর্কে স্থানীয় এক ফিলিস্তিনি সিএনএনকে বলেন, 'হঠাৎ আমরা দুটি বিমান হামলার শব্দ শুনতে পাই। প্রচণ্ড শব্দ হয়। মনে হলো ভূমিকম্প হচ্ছে। আমরা দেখলাম সব জায়গায় পাথর উড়ছে।'
ইতোমধ্যে গাজায় ধ্বংসযজ্ঞের মাত্রা নিয়ে আন্তর্জাতিক চাপে পড়েছে ইসরায়েল। এমনকি তাদের কট্টর মিত্র মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনও ইসরায়েলের বিরুদ্ধে 'নির্বিচারে বোমাবর্ষণের' অভিযোগ তুলেছেন।
যদিও এই ভারী অস্ত্রগুলোর বেশিরভাগই যুক্তরাষ্ট্রের তৈরি। ইসরায়েলের কাছে এমকে-৮৪ নামে পরিচিত বড় ধরনের বোমার একটি বিশাল ভাণ্ডার রয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র ৭ অক্টোবর থেকে ইসরায়েলকে পাঁচ হাজার ৪০০টিরও বেশি এমকে-৮৪ বোমা সরবরাহ করেছে।
সিআইভিআইসি'র চ্যাপেল বলেন, 'আমরা গাজায় যে ধ্বংসলীলা দেখেছি দুর্ভাগ্যবশত তাতে যুক্তরাষ্ট্রের মদদ রয়েছে। কেননা গাজায় ফেলা অধিকাংশ বোমাই যুক্তরাষ্ট্রের তৈরি এবং সরবরাহকৃত।'
তবে এর বিপক্ষে ইসরায়েলি কর্মকর্তারা যুক্তি দেন যে, হামাসকে নির্মূল করার জন্য তাদের ভারী অস্ত্রশস্ত্রের ব্যবহার প্রয়োজন। তারা আরও দাবি করেন যে, ইসরায়েল বেসামরিক হতাহতের সংখ্যা কমানোর যথাসাধ্য চেষ্টা করছে।
ইসরায়েলের প্রতিরক্ষা বাহিনী (আইডিএফ) এক বিবৃতিতে জানায়, ইসরায়েলি নারী, পুরুষ ও শিশুদের ওপর হামাসের ইচ্ছাকৃত আক্রমণের বিপরীতে আইডিএফ আন্তর্জাতিক আইন অনুসরণ করে এবং বেসামরিক ক্ষতি কমানোর জন্য সম্ভাব্য সতর্কতা অবলম্বন করছে।
ইসরায়েলের সমর্থকরাও যুক্তি দেন যে, ভারী অস্ত্রশস্ত্র হামাসের ভূগর্ভস্থ অবকাঠামো ধ্বংস করতে সাহায্য করছে।
কিন্তু আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইনে নির্বিচারে বোমা হামলা নিষিদ্ধ। এমনকি দুই হাজার পাউন্ডের বোমা পশ্চিমা সামরিক বাহিনীগুলোকেও সচরাচর ব্যবহার করতে দেখা যায় না।
সাবেক মার্কিন প্রতিরক্ষা গোয়েন্দা বিশ্লেষক এবং জাতিসংঘের সাবেক যুদ্ধাপরাধ তদন্তকারী মার্ক গারলাসকো বলেন, 'গাজায় প্রথম মাসে যে পরিমাণ বোমাবর্ষণ হয়েছে, তা ভিয়েতনাম যুদ্ধের পর আর দেখা যায়নি। এমনকি উভয় ইরাক যুদ্ধেও এত ঘন বোমাবর্ষণ হয়নি।'
যুদ্ধের ষষ্ঠ দিনে ইসরায়েলের বিমান বাহিনী এক্সে (সাবেক টুইটার) জানায়, যুদ্ধ শুরুর পর থেকে তারা গাজায় ছয় হাজার বোমা ফেলেছে। অর্থাৎ দিনে গড়ে এক হাজার বোমা ফেলা হয়। পরবর্তীতে ১০ ডিসেম্বর ইসরায়েলের সামরিক বাহিনী জানায় যে, তারা গাজার ২২ হাজারেরও বেশি লক্ষ্যবস্তুতে হামলা করেছে।
দুই মাসেরও বেশি সময় ধরে গাজায় অত্যন্ত অমানবিক যুদ্ধ পরিচালনা করে আসছে ইসরায়েল। তারা গাজায় নিরলস আর্টিলারি গোলা নিক্ষেপের পাশাপাশি বিমান থেকেও ভারী বোমাবর্ষণ চালিয়ে যাচ্ছে। এর বাইরে গত ২৭ অক্টোবর থেকে শুরু করেছে স্থল অভিযান।
নভেম্বরের শুরুতে ইসরায়েলের স্থল বাহিনী গাজা শহরটি শেষ পর্যন্ত অবরোধ করতে সক্ষম হয়। স্যাটেলাইট চিত্রে বোমা হামলার ধরণ থেকে বোঝা যায়, এই ভারী বোমাবর্ষণ গাজা শহরের চারপাশে ইসরায়েলি সেনাদের ঘেরাও করার পথ সুগম করেছে।
তথ্যসূত্র: সিএনএন
গ্রন্থনা: আহমেদ বিন কাদের অনি
Comments