মৃত্যু উপত্যকায় শিশুদের মুখে হাসি ফোটানো পাপেটশিল্পী
পুরো পৃথিবীর ভেতর গাজাই এখন একমাত্র জনপদ, যেখানে মাতৃগর্ভেই হত্যার শিকার হচ্ছে শিশুরা। শুধু তাই নয়, যারা ভূমিষ্ঠ হচ্ছে তাদের অনেকেই জন্মের পর পর মরছে গুলি-বোমার আঘাতে।
যে শিশুরা এখনো মরেনি, তাদের মারতেও কোনো আয়োজন বাকি রাখছে না ইসরায়েল। হাসপাতাল-স্কুলসহ অপেক্ষাকৃত নিরাপদ বলে বিবেচিত শরণার্থী শিবিরগুলোতেও চলেছে বাছবিচারহীন হামলা। অকার্যকর করে দেওয়া হচ্ছে হাসপাতালের বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও অক্সিজেন সরবরাহ ব্যবস্থা। বন্ধ করে রাখা হচ্ছে অবরুদ্ধ উপত্যকায় খাবার-পানি প্রবেশের সব উপায়।
সবমিলিয়ে এই মৃত্যু উপত্যকায় মানবিক সংকট 'দুঃস্বপ্নের পরিস্থিতি' সৃষ্টি করেছে প্রসূতি মা ও নবজাতকদের জন্যও। সেখানকার চিকিৎসকেরা বলছেন, উপত্যকার হাসপাতালগুলোয় অপরিণত ও অসুস্থ শিশু জন্ম নিচ্ছে। মৃত শিশু প্রসবের ঘটনাও ঘটছে। এমনকি পর্যাপ্ত অবেদন (অ্যানেসথেসিয়া) ছাড়াই প্রসূতি মায়েদের অস্ত্রোপচার করতে হচ্ছে।
এমন পরিস্থিতিতে বিশ্বে শিশুদের জন্য সবচেয়ে বিপজ্জনক জনপদে পরিণত হওয়া গাজায় বেঁচে থাকা সব উদ্বাস্তু ও মৃত্যুভয়তাড়িত শিশুদের মুখে হাসি ফোটানোর দায় নিয়েছেন পাপেটশিল্পী মেহেদি কারিরা। নির্বিচার বোমাবর্ষণে ধ্বংসস্তূপ হয়ে ওঠা এ জনপদের আশ্রয়শিবিরগুলোতে তিনি ছুটে বেড়াচ্ছেন তার পুতুলের দল নিয়ে।
সম্প্রতি যুক্তরাজ্যের জনপ্রিয় টেলিভিশন চ্যানেল-৪ মেহেদি কারিরাকে নিয়ে একটি ভিডিও প্রতিবেদন প্রচার করেছে। সেখানে একটি আশ্রয়শিবিরে উৎফুল্ল শিশুদের সামনে পাপেট শো পরিচালনা করতে দেখা যায় তাকে।
গাজায় প্রায় আট মাস ধরে চলা ইসরায়েলি আগ্রাসনে ইতোমধ্যে ৩৬ হাজারের বেশি ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন। এর ভেতর প্রায় ১৫ হাজার শিশু। জাতিসংঘের শিশু বিষয়ক সংস্থা ইউনিসেফের নির্বাহী পরিচালক ক্যাথেরিন রাসেলের পর্যবেক্ষণ, ৭ অক্টোবরের পর থেকে গাজায় যে পরিমাণ শিশুর মৃত্যু হয়েছে, বিশ্বের আর কোনো সংঘাতে তেমনটি তারা দেখেননি। আর যারা বেঁচে আছে, তারা ক্ষুধা ও অপুষ্টিতে কাতর। এই শিশুদের অনেকেরই শরীরে 'কান্নার মতো পর্যাপ্ত শক্তি' অবশিষ্ট নেই। পাশাপাশি হামলায় আহত হাজারো শিশুর খবর এখনো অজানা।
চ্যানেল-৪ এর প্রতিবেদন সূত্রে জানা যায়, গাজায় ইসরায়েলি হামলা শুরুর আগে মেহেদি কারিরা থিয়েটারে কাজ করতেন। পাশাপাশি পাপেট শো পরিচালনার জন্য পুতুলের একটা বড় সংগ্রহ ছিল তার। কিন্তু হামলা শুরুর পর স্ত্রী ও ছয় সন্তানসহ বাড়ি ছেড়ে পালানোর সময় এর কিছুই সঙ্গে নিতে পারেননি তিনি।
এখন হাতের কাছে যা পাওয়া যায় তাই দিয়ে পুতুল বানান মেহেদি কারিরা। এমনকি যুদ্ধে ধ্বংসস্তূপ থেকে খুঁজে নেওয়া কোনো উপকরণও তার পাপেট তৈরির অনুষঙ্গ হয়ে ওঠে।
'মিট দ্য পাপেটার অব গাজা' শিরোনামের ওই ভিডিও প্রতিবেদনে মেহেদিকে বলতে শোনা যায়, 'আমি নিশ্চিত যে শিশুদের জন্য এই পাপেট শোয়ের দরকার আছে। কারণ আমাদের জীবনের যা কিছু সুন্দর, তার সবটা আমরা হারিয়েছি।'
মেহেদি বলতে থাকেন, 'গাজা উপত্যকায় ইসরায়েলি আগ্রাসন এখনো বন্ধ হয়নি। কিন্তু এর ভেতরেও আমরা কিছুটা সময় চুরি করে টিকে থাকার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি শিশুদের নতুন একটি স্বপ্ন উপহার দেওয়ার জন্য, তাদের ভোগান্তি আর উদ্বাস্তু হওয়ার যন্ত্রনা কিছুটা হলেও কমানোর জন্য।'
মেহেদির শো চলার সময় শিশুরা পাপেটদের সঙ্গে হ্যান্ডশেক করতে চায়। এই পাপেটরাই হয়ে ওঠে তাদের ভাই, বন্ধু অথবা প্রতিবেশী। এটিই তার জন্য সবচেয়ে সুখের মুহূর্ত বলে জানান তিনি।
মেহেদির ভাষ্য, গাজায় যে পরিস্থিতির ভেতর তারা বেঁচে আছেন, যে ধ্বংসযজ্ঞের মধ্য দিয়ে যাচ্ছেন, যে একপেশে যুদ্ধ তারা প্রত্যক্ষ করছেন, তা তাদেরকে নির্মল আনন্দে ঘিরে থাকা এই আশ্রয়টুকু নিতে বাধ্য করেছে।
মেহেদি মনে করেন, এই অসম যুদ্ধের মঞ্চে তার এই কার্যক্রম শিশুসহ এখানকার অন্য বাসিন্দাদের খানিকটা হলেও উপশম দেয়। তিনি বলেন, 'বড়দের কাছেও পাপেট চিত্তাকর্ষক, মনোমুগ্ধকর। আর শিশুদের জন্য এটা দরকার। আমাদের থিয়েটার আরও অনেকভাবে কাজ করছে। কাউন্সেলিং ও মানসিক সাপোর্টের জন্য, বিনোদনের জন্য, শিক্ষার জন্য। এর সবকিছুই আমরা হারিয়েছি। আমাদের স্কুলগুলো নেই। যাওয়ার মতো কোনো জায়গা অবশিষ্ট নেই।'
পৃথিবীজুড়েই পাপেট একটি জনপ্রিয় বিনোদন ও শিক্ষার মাধ্যম। এসব পুতুল বা পাপেট প্রথম কোথায় আবিষ্কার হয়েছে, তা নিয়ে বিতর্ক রয়েছে।
শোনা যায়, এখান থেকে তিন হাজার বছর আগে মিসরে প্রথম কাঠের পুতুল তৈরি হয়েছিল। সুতোয় বাঁধা থাকত সে পুতুলগুলো। পর্দার আড়াল থেকে দু-একজন মানুষ সেসব সুতো নাড়িয়ে-চাড়িয়ে পুতুলগুলোর অঙ্গভঙ্গি তৈরি করত। এভাবে একটি কাহিনি উপস্থাপন করা হতো দর্শকদের সামনে। মূলত তাদের রীতিনীতি, সংস্কৃতি অন্যদের কাছে তুলে ধরার জন্যেই আয়োজন করা হতো পাপেট শোয়ের।
আবার কিছু উৎসমতে, পাপেটের জন্ম ভারতে। এর মাধ্যমেই মহাভারতের বিভিন্ন কাহিনি উপস্থাপন করা হতো।
জাপানিদের পাপেট শোর গল্পটা আবার ভিন্ন। কোনো একটা সময়ে নাকি জাপানের জনপ্রিয় অভিনয়শিল্পীরা একটু বেশি পারিশ্রমিক নিতেন। এ জন্য কাঠের পুতুল দিয়ে গল্প উপস্থাপন শুরু করেন অনেক নির্মাতা, যা পরে বিনোদনের জনপ্রিয় মাধ্যম হয়ে ওঠে।
প্রাচীন গ্রিসেও পাপেট শো হতো। সমাজের শ্রেণিবৈষম্যকে গ্রিসের অনেক দার্শনিক তুলে ধরেছেন এই পুতুলনাচ দিয়ে। উনিশ শতকে ইতালি, ফ্রান্স, গ্রেট ব্রিটেনসহ সব দেশেই ছড়িয়ে পড়ে এই পাপেট শো। তখন শুধু বিনোদনের মাধ্যম হিসেবেই না থেকে বিভিন্ন অন্তর্নিহিত বার্তা পৌঁছানোর মাধ্যম হয়েও দাঁড়ায় এটি।
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের সঙ্গেও জড়িয়ে আছে এই পুতুলনাচের গল্প। যুদ্ধের দিনগুলোতে শিল্পী মুস্তফা মনোয়ার পশ্চিম বাংলার শরণার্থী শিবিরগুলোতে আশ্রয় নেওয়া মানুষের মনোবল বাড়ানোর জন্য আয়োজন করেন পাপেট প্রদর্শনীর। তখন 'আগাছা', 'রাক্ষস' ও 'একজন সাহসী কৃষক'সহ তার বিখ্যাত পাপেট শোগুলো মানুষকে গভীরভাবে অনুপ্রাণিত করেছিল।
তেমন গাজায় এত প্রতিকূলতার ভেতরেও পাপেটশিল্পী মেহেদি এখনো বিশ্বাস করেন, গাজার মানুষ বেঁচে থাকবেন তাদের গল্পগুলো বলার জন্য। তিনি বলেন, 'এই যুদ্ধের ভেতর দিয়ে আমাদের নিশ্চিহ্ন করে দেওয়ার প্রচেষ্টা আছে। কিন্তু যেভাবে হোক আমরা টিকে থাকার চেষ্টা করছি।'
এ সময় আরেকটা স্বপ্নের কথাও জানান মেহেদি। তা হলো, একটা বড় দল তৈরি করে পুরো পৃথিবী চষে বেড়ানো।
মেহেদি বলেন, 'যদি আমরা এটা পেরে যাই, তাহলে সবাইকে জানাবো আমরা কীভাবে বেঁচে আছি!'
Comments