হুতি কারা, লোহিত সাগরে কেন তারা ‘মূর্তিমান আতঙ্ক’
ইরান সমর্থিত ইয়েমেনের হুতি বিদ্রোহীরা লোহিত সাগরের জাহাজগুলোয় হামলা চালাচ্ছে। তাদের ভাষ্য, গাজায় ইসরায়েলের হত্যাযজ্ঞের শোধ নিচ্ছে তারা।
এতে বিশ্বের বড় বড় তেল কোম্পানিগুলো তাদের অতীব গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্য পথে সরবরাহ বন্ধ রাখতে বাধ্য হচ্ছে। যার প্রভাব পড়তে পারে বিশ্ব অর্থনীতিতে।
হুতিদের অস্ত্র সরবরাহ ও প্রশিক্ষণ দেওয়ার অভিযোগ রয়েছে ইরানের বিরুদ্ধে। লোহিত সাগরে হুতিদের হামলা ইসরায়েল-হামাস যুদ্ধের উত্তাপ আরও বৃহৎ অঞ্চল-জুড়ে ছড়িয়ে দিতে পারে।
হুতি কারা, কেনই বা তারা এই যুদ্ধে জড়াল, চলুন আদ্যোপান্ত জেনে নেই।
হুতি কারা
ইয়েমেনে এক দশক ধরে চলা গৃহযুদ্ধের একটি পক্ষ হুতি, যারা আনসারুল্লাহ নামেও পরিচিত। ১৯৯০ এর দশকে তাদের উত্থান। তাদের নেতা হুসেইন আল-হুতি শিয়া ইসলামের জাইদি ধারার অনুসরণে ধর্মীয় পুনর্জাগরণমূলক আন্দোলন শুরু করেন।
জাইদিরা কয়েক শতাব্দী ধরে ইয়েমেন শাসন করলেও ১৯৬২ সালে গৃহযুদ্ধের পর সুন্নিরা ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হলে তারা কোণঠাসা হয়ে পড়ে। সুন্নি মৌলবাদ মোকাবিলা, বিশেষ করে সৌদি আরবের পৃষ্ঠপোষকতা পাওয়া ওয়াহাবি মতবাদ মোকাবিলায় আল-হুতি এই আন্দোলন গড়ে তোলেন।
হুতিরা যেভাবে ক্ষমতায়
১৯৯০ সালে উত্তর ও দক্ষিণ ইয়েমেন একত্রিত হলে দেশটির প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন আলী আবদুল্লাহ সালেহ। তিনি প্রথমদিকে হুতিদের 'বিলিভিং ইয়ুথ' সংগঠনকে সমর্থন করতেন। তবে আন্দোলনটি জনপ্রিয় ও শাসকবিরোধী হয়ে উঠতে থাকায় তা সালেহ'র মাথাব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়ায়। ২০০৩ সালে ইরাকে যুক্তরাষ্ট্রের হামলাকে সমর্থন দেন সালেহ, যদিও ইয়েমেনের অধিকাংশ জনগণ ছিল এর বিরুদ্ধে।
এই সুযোগটি কাজে লাগান আল-হুতি। জনগণের পুঞ্জীভূত ক্ষোভকে কাজে লাগিয়ে তাদের রাস্তায় নামিয়ে আনেন। সালেহ সরকার তার বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করে।
ইয়েমেনি সেনারা ২০০৪ সালের সেপ্টেম্বরে আল-হুতিকে হত্যা করে, তবে আন্দোলনটির মৃত্যু হয়নি। হুতিদের সামরিক শাখায় ইয়েমেনি তরুণেরা দলে দলে যোগদান করে। ২০১১ সালের 'আরব বসন্ত'র ঝড় নাড়িয়ে দেয় ইয়েমেনকেও। হুতিরা দেশটির উত্তরাঞ্চলীয় প্রদেশ সাআদা দখলে নিয়ে সালেহ'র শাসনের অবসানের দাবি করে।
হুতিরা কি ইয়েমেন নিয়ন্ত্রণ করে
২০১১ সালে সালেহ উপ-রাষ্ট্রপতি আবদ-রাব্বু মনসুর হাদির কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরে রাজি হন, তবে সেসময় তার সরকারের আর তেমন জনপ্রিয়তা ছিল না। ২০১৪ সালে রাজধানী সানা'র বিভিন্ন অংশ দখলে নেয় হুতিরা। পরের বছরের শুরুতে তারা রাষ্ট্রপতির বাসভবনও দখল করে নেয়।
হাদি সৌদি আরবে পালিয়ে যান। তার অনুরোধে ২০১৫ সালের মার্চে হুতিদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ শুরু করে সৌদি আরব। কয়েক বছর ধরে এই যুদ্ধ চলে। অবশেষে ২০২২ সালে এসে উভয়পক্ষের মধ্যে যুদ্ধবিরতি চুক্তি হয়। ছয় মাস পর সেই চুক্তি ভেঙে গেলেও তারা আগের মতো
আর তুমুল যুদ্ধে জড়ায়নি।
জাতিসংঘ জানায়, ইয়েমেন যুদ্ধ পৃথিবীর সবচেয়ে গুরুতর মানবিক বিপর্যয় হিসেবে দাঁড়িয়েছে। তাদের তথ্য অনুযায়ী, এই যুদ্ধে প্রায় আড়াই লাখ মানুষের মৃত্যু হয়েছে।
যুদ্ধবিরতি চুক্তির পর থেকে হুতিরা ইয়েমেনের উত্তরাঞ্চলের অধিকাংশ জায়গা থেকে তাদের দখল ছেড়ে দিয়েছে। তারা সৌদি আরবের সঙ্গে স্থায়ী চুক্তিতে যেতে চাইছে, যাতে করে যুদ্ধের আনুষ্ঠানিক সমাপ্তি ঘটে ও তারা রাষ্ট্র ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হতে পারে।
হুতিদের মিত্র যারা
হুতিদের পৃষ্ঠপোষকতায় আছে ইরান। ২০১৪ সালে ইয়েমেনে গৃহযুদ্ধ তীব্র হওয়ায় এবং সৌদি আরবের সঙ্গে ক্রমবর্ধমান দ্বন্দ্বের জেরে হুতিদের সহায়তা বাড়িয়ে দেয় ইরান। সেন্টার ফর স্ট্র্যাটেজিক অ্যান্ড ইন্টারন্যাশনাল স্টাডিজের ২০২১ সালের প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, সমুদ্র মাইন, ব্যালিস্টিক ও ক্রুজ ক্ষেপণাস্ত্র এবং ড্রোনসহ অন্যান্য অস্ত্রশস্ত্র ও কারিগরি সুবিধা দিয়ে হুতিদের সহায়তা করে ইরান।
ইরানের কথিত 'অ্যাক্সিস অব রেসিস্ট্যান্স'-এর অংশ হুতিরা। এটি মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ ও জায়নবাদের বিরুদ্ধে ইরানের নেতৃত্বে গঠিত একটি আঞ্চলিক সামরিক জোট। গাজায় হামাস ও লেবাননে হিজবুল্লাহ'র মতো ইয়েমেনে ইরানের আস্থার জায়গা হুতিরা।
হুতিরা কতটা শক্তিশালী
হুতিদের তৈরি মিসাইলের পরিসর, লক্ষ্যভেদী নিশানা ও মারণঘাতী সামর্থ্য সম্পর্কে ধারণা পেতে কাজ করছেন মার্কিন কর্মকর্তারা। মার্কিন গোয়েন্দা সংশ্লিষ্ট এক কর্মকর্তা সিএনএনকে আগে জানিয়েছিলেন, প্রথমদিকে ইরান থেকে আলাদা আলাদা সরঞ্জাম চোরাপথে ইয়েমেনে এনে স্থানীয়ভাবে অস্ত্র তৈরি করতো হুতিরা।
তিনি জানান, হুতিরা বেশ কার্যকর মডিফিকেশন ঘটিয়েছে, যার ফলে তাদের যুদ্ধাস্ত্রের বেশ উন্নতি ঘটেছে। এর ফলে ডিসেম্বরের শুরুর দিকে তারা দক্ষিণ ইসরায়েলের এইলাতে মধ্যম পরিসরের ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র ছুড়ে, যা পরে ভূপাতিতের কথা জানায় ইসরায়েল।
ইসরায়েলের জন্য হুতিরা এখন পর্যন্ত বড় কোনো হুমকি হিসেবে আবির্ভূত হতে না পারলেও, তাদের প্রযুক্তি লোহিত সাগরে বিপর্যয় ঘটাতে সক্ষম। সম্প্রতি তারা লোহিত সাগরে ড্রোন ও জাহাজ-বিধ্বংসী ক্ষেপণাস্ত্রের সাহায্যে বাণিজ্যিক জাহাজগুলোকে টার্গেট করছে, যাদের অনেকগুলোর সঙ্গেই ইসরায়েলের কোনো সম্পৃক্ততা নেই।
হুতিরা লোহিত সাগরে জাহাজে হামলা করছে কেন
ভূগোল ও প্রযুক্তিগত দিক বিচারে হামাস কিংবা হিজবুল্লাহ'র মতো হুতিরা ততটা শক্তিশালী নয়, কিন্তু লোহিত সাগরে বাণিজ্যিক জাহাজে তাদের হামলা ইসরায়েল ও এর মিত্রদের বেশ সমস্যায় ফেলে দিচ্ছে।
সাগরের এই অংশের অন্যরকম গুরুত্ব রয়েছে বৈশ্বিক অর্থনীতিতে। ইয়েমেন উপকূলের বাব-এল-মান্দেব থেকে মিশরের উত্তরাঞ্চলে সুয়েজ খাল পর্যন্ত বিস্তৃত এই সাগর। বিশ্ব বাণিজ্যের ১২ শতাংশ সরবরাহ ও ৩০ শতাংশ কনটেইনার এ পথ দিয়ে যায়।
২০২১ সালে 'এভার গিভেন' নামে একটি জাহাজ সুয়েজ খালে আটকে পড়ায় প্রায় এক সপ্তাহ এ পথে বাণিজ্য বন্ধ ছিল। এতে প্রতিদিন প্রায় ১০ বিলিয়ন ডলার মূল্যের পণ্য সরবরাহ স্থগিত থাকে, যাতে বিশ্ব পণ্য সরবরাহ ব্যবস্থায়ও লাগে ভাটার টান।
গত ৯ ডিসেম্বর থেকে প্রায় প্রতিদিনই লোহিত সাগরে বাণিজ্যিক জাহাজ টার্গেট করে ড্রোন ও ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালাচ্ছে হুতিরা। এতে বিশ্ব অর্থনীতির আকাশে নতুন কালো মেঘের সৃষ্টি হয়েছে।
হুতিদের হামলার আশঙ্কায় ইতোমধ্যে বিশ্বের বৃহত্তম পাঁচটি শিপিং ফার্মের মধ্যে চারটি- মায়েরস্ক, হাপাগ-লয়েড, সিএমএ সিজিএম গ্রুপ ও এভারগ্রিন লোহিত সাগরে জাহাজ চলাচল বন্ধ রেখেছে। বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ জ্বালানি প্রতিষ্ঠান ব্রিটিশ পেট্রলিয়ামও (বিপি) গত সোমবার একই পদক্ষেপ নেওয়ার কথা জানিয়েছে। এতে বিশ্ব বাজারে তেল ও গ্যাসের মূল্য বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে।
হুতিদের হামলা এড়াতে চাইলে জাহাজগুলোকে আফ্রিকা হয়ে অধিকতর দীর্ঘ পথ পাড়ি দিতে হবে। এতে বিমা খরচও বেড়ে যাবে বহুগুণ। পণ্য পরিবহনের খরচ বেড়ে গেলে কোম্পানিগুলো তাদের পণ্যের দামও বাড়িয়ে দেবে। এতে করোনা মহামারি পরবর্তী মূল্যস্ফীতির পাশাপাশি বিভিন্ন দেশের সরকারকে আরেকটি নতুন ধাক্কা সামলাতে হবে।
হুতিরা বলছে, তারা তখনই থামবে, যখন ইসরায়েল গাজায় খাবার ও ওষুধ প্রবেশ করতে দেবে। তাদের প্রত্যাশা, এই পদক্ষেপের ফলে ইসরায়েলের মিত্ররা আর্থিক চাপে পড়বে, এর ফলে গাজায় বোমাবর্ষণ থেকে বিরত হতে পারে ইসরায়েল।
হুতিদের ফিলিস্তিন ইস্যুকে সর্বাগ্রে রাখার পেছনে নিজেদের মাটিতে আইনগত বৈধতা পাওয়ার চিন্তাও কাজ করে থাকতে পারে, যেহেতু তারা ইয়েমেনের উত্তরাঞ্চলের নিয়ন্ত্রণ ধরে রাখতে চায়। এর ফলে সৌদি আরব ও সংযুক্ত আরব আমিরাতের বিপক্ষেও হুতিদের অবস্থান সংহত হবে, কেননা তারা এই দুই দেশকে যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েলের আজ্ঞাবহ মনে করে।
বিশ্ব প্রতিক্রিয়া
লোহিত সাগরে হুতিদের হামলার উদ্দেশ্য আরও বেশিসংখ্যক দেশকে এই সংঘাতে জড়ানো। ইসরায়েল ইতোমধ্যে জানিয়ে দিয়েছে যে, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় নীরব থাকলে হুতিদের বিরুদ্ধে তারা একাই লড়বে। ইসরায়েলের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা যাকি হানেগবি এ মাসে জানান, এটি একটি বৈশ্বিক ইস্যু, এ কারণে হুতিদের হামলা মোকাবিলায় 'বৈশ্বিক সংহতি'র প্রয়োজন।
মার্কিন এক জ্যেষ্ঠ সেনা কর্মকর্তা জানান, গত মাসে লোহিত সাগরে অন্তত ১২টি বাণিজ্যিক জাহাজকে টার্গেট করা হয়েছে। যা গত দুই প্রজন্মে দেখা যায়নি। এর ফলে অন্তত ৪৪টি দেশ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। আন্তর্জাতিকভাবে যার প্রভাব আরও গুরুতর।
হুতিদের হামলা রোধে গত সোমবার যুক্তরাজ্য, বাহরাইন, কানাডা, ফ্রান্স, নরওয়ে ও অন্যান্যদের নিয়ে নতুন এক বহুজাতিক নৌ-টাস্কফোর্স গঠন করেছে যুক্তরাষ্ট্র।
হুতিদের এক মুখপাত্র মোহামেদ আল-বুখাইতি গত সোমবার আল জাজিরাকে জানান, তারা লোহিত সাগরে যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন যেকোনো জোটকে মোকাবিলা করবেন।
গাজায় ইসরায়েলের যুদ্ধ বন্ধে দেরিতে হলেও কিছু কাজ শুরু করেছে বাইডেন প্রশাসন, তবে মধ্যপ্রাচ্যে তারা নতুন করে জটিলতার মুখোমুখি হচ্ছে। কেননা আদতে অগোছালো তবে কার্যকর বিদ্রোহী হুতিরা এ অঞ্চলে নিজেদের সক্ষমতাকে এমন এক উচ্চতায় নিয়ে গেছে যে, তাদের এড়িয়ে যাওয়ার আর উপায় নেই।
তথ্যসূত্র: সিএনএন
গ্রন্থনা: মাহমুদ নেওয়াজ জয়
Comments