‘নিরাপদ অঞ্চলে’ হামলার ধারায় এবার রাফাহ

নেতানিয়াহুর কার্যালয় থেকে জানানো হয়, ‘হামাসকে নিশ্চিহ্ন না করে এই যুদ্ধের লক্ষ্য অর্জন সম্ভব নয়। রাফাহ শহরে চার ব্যাটালিয়ন হামাস যোদ্ধা অক্ষত রয়েছে, যাদের মোকাবিলা করতে বড় আকারে সামরিক অভিযান চালানো প্রয়োজন।
রাফাহ শহরে তাঁবুর নিচে বসবাস করছেন গাজার বিভিন্ন অংশ থেকে আসা বাস্তুচ্যুত ফিলিস্তিনিরা। এর মাঝে এক শিশু ঘুড়ি উড়িয়ে অবসর যাপন করছে। ছবি: রয়টার্স
রাফাহ শহরে তাঁবুর নিচে বসবাস করছেন গাজার বিভিন্ন অংশ থেকে আসা বাস্তুচ্যুত ফিলিস্তিনিরা। এর মাঝে এক শিশু ঘুড়ি উড়িয়ে অবসর যাপন করছে। ছবি: রয়টার্স

দক্ষিণ গাজার রাফাহ অঞ্চলে সর্বাত্মক অভিযান চালানোর পরিকল্পনা করছে ইসরায়েল। গাজার অন্যান্য অংশ থেকে বাস্তুচ্যুত হয়ে অসংখ্য ফিলিস্তিনি রাফাহ শহরে আশ্রয় নিয়েছেন। এর আগে রাফাহকে 'নিরাপদ অঞ্চল' বলে অভিহিত করেছিল দেশটি।

আজ রোববার বিবিসি ও আল জাজিরার প্রতিবেদনে এ বিষয়টি উল্লেখ করা হয়েছে।

ইসরায়েলের প্রস্তুতি

ফরাসি পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠক করেন নেতানিয়াহু। ছবি: রয়টার্স
ফরাসি পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠক করেন নেতানিয়াহু। ছবি: রয়টার্স

রাফাহ শহরে বড় আকারে হামলার জন্য সেনাবাহিনীকে প্রস্তুত হওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু। এর পাশাপাশি তিনি শহরটি থেকে বেসামরিক ব্যক্তিদের সরিয়ে নেওয়ারও নির্দেশ দিয়েছেন।

নেতানিয়াহুর কার্যালয় থেকে জানানো হয়, 'হামাসকে নিশ্চিহ্ন না করে এই যুদ্ধের লক্ষ্য অর্জন সম্ভব নয়। রাফাহ শহরে চার ব্যাটালিয়ন হামাস যোদ্ধা অক্ষত রয়েছে, যাদের মোকাবিলা করতে বড় আকারে সামরিক অভিযান চালানো প্রয়োজন। যুদ্ধ শুরুর আগে বেসামরিক ব্যক্তিদের সরিয়ে নিতে হবে।'

শুক্রবার নিউ ইয়র্ক টাইমস এক নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক জ্যেষ্ঠ মার্কিন গোয়েন্দা কর্মকর্তার বরাত দিয়ে জানায়, ইসরায়েল এখন পর্যন্ত মাত্র এক তৃতীয়াংস হামাস যোদ্ধাদের হত্যা করতে সমর্থ হয়েছে। যার অর্থ, 'যুদ্ধের লক্ষ্য অর্জন' থেকে তারা এখনো অনেক দূরে।

নেতানিয়াহু যুদ্ধবিরতির আলোচনায় হামাসের দেওয়া সর্বশেষ শর্তগুলো প্রত্যাখান করেছেন।

রাফাহ অঞ্চলের পরিস্থিতি

রাফাহ শহরে হামলা পরবর্তী দৃশ্য। ছবি: রয়টার্স
রাফাহ শহরে হামলা পরবর্তী দৃশ্য। ছবি: রয়টার্স

আল জাজিরার এক প্রতিবেদন মতে, গাজা উপত্যকা মোট পাঁচটি অঞ্চলে বিভক্ত: উত্তর গাজা, গাজা শহর (গাজা সিটি), দেইর এল-বালাহ, খান ইউনিস ও রাফাহ।

গাজার মোট ৩৬৫ বর্গকিলোমিটার (১৪১ বর্গমাইল) এলাকাজুড়ে অবস্থিত। এর দৈর্ঘ্য ৪১ কিলোমিটার (২৫ মাইল)। দক্ষিণের রাফাহ থেকে উত্তরের বেইত হানুন অঞ্চলে গাড়ি চালিয়ে যেতে এক ঘণ্টারও কম সময় লাগে।

২০২২ এর তথ্য অনুযায়ী, রাফাহর জনসংখ্যা ছিল দুই লাখ ৬৭ হাজার। এই শহরটি ১৫১ বর্গকিলোমিটার জায়গাজুড়ে অবস্থিত। ইসরায়েল-হামাস সংঘাত শুরুর পর ইসরায়েলের নির্দেশে উত্তর গাজা ও গাজা উপত্যকার অন্যান্য অংশ থেকে অসংখ্য মানুষ রাফাহর 'নিরাপদ অঞ্চলে' চলে আসেন।

ধারণা করা হয়য় ,গাজার মোট ২৩ লাখ ফিলিস্তিনির মধ্যে ১৫ লাখই বর্তমানে রাফাহতে অবস্থান করছেন।

বাস্তুচ্যুত ফিলিস্তিনিদের বেশিরভাগই তাঁবুতে বসবাস করছেন।

ইসরায়েলের 'নিরাপদ অঞ্চলে' হামলার কৌশল

দক্ষিণ গাজায় ইসরায়েলি হামলা পরবর্তী দৃশ্য। ছবি: রয়টার্স
দক্ষিণ গাজায় ইসরায়েলি হামলা পরবর্তী দৃশ্য। ছবি: রয়টার্স

গত ৭ অক্টোবর ইসরায়েলি ভূখণ্ডে হামলা চালিয়ে এক হাজার ২০০ ইসরায়েলিকে হত্যা করে ফিলিস্তিনি সশস্ত্র সংগঠন হামাস। এরপর হামাসের বিরুদ্ধে প্রতিশোধ নিতে গাজায় নির্বিচার ও সর্বাত্মক হামলা শুরু করে ইসরায়েল।

আল জাজিরার প্রতিবেদন মতে গত ১৩ অক্টোবর উত্তর গাজার ১১ লাখ ফিলিস্তিনিকে দক্ষিণ গাজায় নিরাপদ আশ্রয়ে চলে যাওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল। ইসরায়েলি সামরিক বাহিনী সে সময় বলেছিল, 'আপনাদের নিরাপত্তার জন্য এই পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে'। হাজারো মানুষ এই সতর্কবাণী শুনে দক্ষিণ গাজার উদ্দেশে রওনা হয়, কিন্তু যাত্রাপথে এবং দক্ষিণ গাজায় উপস্থিত হওয়ার পরেও তারা বোমাহামলার মুখে পড়েন।

পরবর্তীতে একাধিকবার বিভিন্ন এলাকাকে 'নিরাপদ অঞ্চল' হিসেবে ঘোষণা দেয় ইসরায়েল।

নভেম্বরে স্থল অভিযান শুরুর অল্প কয়েকদিন পর গাজার উত্তর-দক্ষিণ অঞ্চলে যাতায়াতের জন্য ব্যবহৃত সালাহ আল-দিন সড়ককে ইসরায়েল 'নিরাপদ করিডর' হিসেবে আখ্যায়িত করে। এই বিষয়টিকে তারা বেসামরিক ব্যক্তিদের জীবন বাঁচানোর 'মানবিক উদ্যোগ' হিসেবে অভিহিত করে। কিন্তু গাজার এই সড়কটি পরবর্তীতে 'আতঙ্কের করিডরে' রূপান্তরিত হয়। সেখানে ফিলিস্তিনিদের ওপর নিরবচ্ছিন্ন বোমাহামলা চালানো হয়।

অপরদিকে, ইসরায়েলি সেনাবাহিনী ওয়াদি গাজার দক্ষিণ অঞ্চলকে 'নিরাপদ এলাকা' বললেও সেখানে বারবার হামলা চালিয়েছে।

নভেম্বরের শেষে নিহতের সংখ্যা ১৫ হাজার ছাড়িয়েছিল, যাদের বেশিরভাগই এসব তথাকথিত নিরাপদ অঞ্চলে অবস্থান করছিলেন।

যুক্তরাষ্ট্রের চাপে ইসরায়েলি সেনাবাহিনী সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে একটি 'গ্রিড ম্যাপ' প্রকাশ করে, যেখানে গাজা উপত্যকাকে ৬০০টি ভাগে ভাগ করে দেখানো হয়, কোন অঞ্চল 'নিরাপদ' এবং কোন অঞ্চল ছেড়ে চলে যেতে হবে।

যেসময় এই ম্যাপ প্রকাশ করা হয়, সে সময় গাজার ফিলিস্তিনিদের অসব ধরনের যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করে রেখেছিল ইসরায়েলি সেনাবাহিনী। এই গ্রিডের ফলে বেসামরিক ব্যক্তিদের নিরাপত্তা বাড়ার বদলে গোলযোগ ও মৃত্যু বেড়ে যায়।

ডিসেম্বরে নিউ ইয়র্ক টাইমস এর এক অনুসন্ধানে বের হয়ে আসে, ইসরায়েল 'নিয়মিত তাদের সবচেয়ে বড় ও ধ্বংসাত্মক বোমাগুলো বেসামরিকদের জন্য নিরাপদ এলাকা হিসেবে চিহ্নিত অঞ্চলগুলোতে নিক্ষেপ করেছে'। যুক্তরাষ্ট্রে নির্মিত দুই হাজার পাউন্ড বোমাগুলো 'দক্ষিণ গাজায় নিরাপত্তা খুঁজতে আসা' মানুষের জন্য বড় হুমকি।

খান ইউনিস ও রাফাহর মতো 'নিরাপদ' অঞ্চলগুলোও শিগগির যুদ্ধক্ষেত্রে রূপান্তরিত হয়। এ ছাড়াও, হাসপাতাল, শরণার্থী শিবির ও অন্যান্য বেসামরিক স্থাপনার ওপরও হামলা চালিয়ে গেছে ইসরায়েল।

প্রায় চার মাস ধরে নিরবচ্ছিন্ন হামলায় ২৭ হাজার ৯০০ ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন। আহত হয়েছেন প্রায় ৬৭ হাজার। গাজার হামাস নিয়ন্ত্রিত স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় এই তথ্য জানিয়েছে।

রাফাহর সামরিক অভিযানের বিরুদ্ধে হুশিয়ারি

যুক্তরাজ্যের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডেভিড ক্যামেরন। ছবি: রয়টার্স
যুক্তরাজ্যের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডেভিড ক্যামেরন। ছবি: রয়টার্স

যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও জাতিসংঘ রাফাহর সম্ভাব্য অভিযান নিয়ে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছে।

যুক্তরাষ্ট্র বলেছে, রাফাহর ওপর হামলা করা হলে সেটি হবে এক ধরনের 'বিপর্যয়'।

ত্রাণসংস্থাগুলো বলেছে, এ শহর থেকে সব বেসামরিক মানুষকে সরিয়ে নেওয়া সম্ভব নয়।

যুক্তরাজ্যের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডেভিড ক্যামেরন বলেন, 'গাজার অর্ধেকের বেশি মানুষ এখানে আছেন'। নেদারল্যান্ডস এর পররাষ্ট্রমন্ত্রী হানকে ব্রুইনস স্লট বলেন, এ ধরনের অভিযানে 'অসংখ্য বেসামরিক মানুষের প্রাণহানি হবে'।

এই অভিযানের 'গুরুতর পরিণাম হতে পারে' বলে হুশিয়ারি দিয়েছে সৌদি আরব।

হামাস বলেছে, এতে 'দশ হাজারেরও বেশি বেসামরিক মানুষ হতাহত হতে পারেন'।

সৌদি পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বলেছে, 'রাফাহ গাজার হাজারো বেসামরিক ফিলিস্তিনিদের শেষ আশ্রয়। ইসরায়েলের সহিংস হামলা থেকে বাঁচতে তারা সেখানে আশ্রয় নিয়েছেন'। 

Comments

The Daily Star  | English
Chief Adviser Muhammad Yunus

Chief Adviser Yunus's UNGA trip a critical turning point

Now is the best chance for Bangladesh to strengthen international cooperation.

4h ago