তুরস্কের প্রেসিডেন্ট নির্বাচন

এরদোয়ানের সামনে কঠিন চ্যালেঞ্জ

এ বছর তুরস্কের প্রেসিডেন্ট ও পার্লামেন্ট নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। গত ২০ বছর ধরে বর্তমান প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ান ক্ষমতায় আছেন। স্বাভাবিকভাবেই নিজের মেয়াদ বাড়ানোর পরিকল্পনা তার আছে। কিন্তু, রাজনীতি বিশ্লেষকরা বলছেন- রাজনৈতিক জীবনে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জের সামনে দাঁড়িয়ে আছেন এরদোয়ান।
এরদোয়ানের সামনে কঠিন চ্যালেঞ্জ
রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ান। রয়টার্স ফাইল ছবি

এ বছর তুরস্কের প্রেসিডেন্ট ও পার্লামেন্ট নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। গত ২০ বছর ধরে বর্তমান প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ান ক্ষমতায় আছেন। স্বাভাবিকভাবেই নিজের মেয়াদ বাড়ানোর পরিকল্পনা তার আছে। কিন্তু, রাজনীতি বিশ্লেষকরা বলছেন- রাজনৈতিক জীবনে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জের সামনে দাঁড়িয়ে আছেন এরদোয়ান।

রয়টার্সের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, তুরস্কের প্রেসিডেন্ট ও পার্লামেন্ট নির্বাচন অবশ্যই চলতি বছরের জুনের মধ্যে অনুষ্ঠিত হতে হবে। এবারের নির্বাচন হতে যাচ্ছে এরদোয়ানের সবচেয়ে বড় রাজনৈতিক চ্যালেঞ্জ।

মুস্তাফা কামাল আতাতুর্ক আধুনিক তুর্কি প্রজাতন্ত্র প্রতিষ্ঠার পর সবচেয়ে শক্তিশালী নেতা এরদোয়ান। তার ধর্মভিত্তিক একে পার্টি তুরস্ককে আতাতুর্কের ধর্মনিরপেক্ষতা থেকে দূরে সরিয়ে নিয়েছে। এরদোয়ান আঙ্কারায় ১ হাজার কক্ষের প্রাসাদে অবস্থিত নির্বাহী প্রেসিডেন্সির চারপাশে সরকারের ক্ষমতাকে কেন্দ্রীভূত করেছেন। সেখান থেকেই তুরস্কের অর্থনৈতিক, নিরাপত্তা, অভ্যন্তরীণ এবং আন্তর্জাতিক বিষয়ে নীতি নির্ধারণ করা হয়।

সমালোচকরা বলছেন, এরদোয়ানের সরকার ভিন্নমতাবলম্বীদের দমন করেছে, অধিকার খর্ব করেছে এবং বিচার ব্যবস্থাকে তার নিয়ন্ত্রণে নিয়েছে। যদিও সরকারি কর্মকর্তারা এই অভিযোগ আমনে না নিয়ে প্রত্যাখ্যান করেছেন। তারা বলছেন, ২০১৬ সালের অভ্যুত্থান প্রচেষ্টাসহ অন্যান্য নিরাপত্তা হুমকি থেকে সরকার নাগরিকদের রক্ষা করেছে।

তুরস্কের অর্থনীতিবিদরা বলছেন, সুদের হার কমানোয় গত বছর মূল্যস্ফীতি ২৪ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ ৮৫ শতাংশে উন্নীত হয়েছে এবং গত এক দশকে ডলারের বিপরীতে লিরা তার মূল্যের এক দশমাংশে নেমে এসেছে।

নির্বাচন উপলক্ষে বিরোধী দলগুলো কেন্দ্রীয় ব্যাংকের স্বাধীনতা পুনরুদ্ধার, সংসদীয় সরকার ফিরিয়ে আনা এবং আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার জন্য একটি নতুন সংবিধান প্রবর্তনের প্রতিশ্রুতি দিয়েছে।

এরদোয়ানের শাসনামলে তুরস্ক মধ্যপ্রাচ্য ও এর বাইরে সামরিক শক্তি বাড়িয়েছে। ইরাকের অভ্যন্তরে কুর্দিদের বিরুদ্ধে অভিযান চালিয়েছে এবং লিবিয়া ও আজারবাইজানকে সামরিক সহায়তা দিয়েছে। তুরস্ক আঞ্চলিক শক্তি সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত এবং ইসরায়েলের সঙ্গে ধারাবাহিকভাবে কূটনৈতিক লড়াইয়ে জড়িয়েছে। পাশাপাশি পূর্ব ভূমধ্যসাগরীয় সামুদ্রিক সীমানা নিয়ে গ্রিস এবং সাইপ্রাসের সঙ্গে অচলাবস্থা তৈরি হয়েছিল। তবে, দুই বছর আগে অবস্থান পরিবর্তন করা ও কিছু প্রতিদ্বন্দ্বীদের সঙ্গে আবারও সম্পর্ক প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করলে এসব সমস্যা থেকে কিছুটা হলেও বের হতে পেরেছিল।

এরদোয়ান রাশিয়ার বিমান প্রতিরক্ষা ক্রয়ের ফলে আঙ্কারার বিরুদ্ধে মার্কিন অস্ত্র নিষেধাজ্ঞা শুরু হয়েছিল। অন্যদিকে রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের সঙ্গে তার ঘনিষ্ঠতায় সমালোচকরা ন্যাটো পশ্চিমা প্রতিরক্ষা জোটের প্রতি তুরস্কের প্রতিশ্রুতি নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিল। এছাড়া, সুইডেন ও ফিনল্যান্ডের ন্যাটো সদস্যপদের আবেদন নিয়ে আঙ্কারার আপত্তিও এই অঞ্চলের উত্তেজনা বাড়িয়েছে।

এসবরে পরেও তুরস্ক ইউক্রেনের গম রপ্তানির জন্য একটি চুক্তি করেছে। ইউক্রেন যুদ্ধ শেষ করতে এরদোয়ান দুই পক্ষের মধ্যস্থতা করেছে। ধারণা করা হচ্ছে, তার নির্বাচনী প্রচারণায় বিষয়টি জোরালো ভূমিকা রাখবে।

যদিও এরদোয়ানের দুই দশকের ক্ষমতায় প্রথম দশকে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি থাকলেও গত ১০ বছরে তা হ্রাস পেয়েছে। যা ভোটারদের কাছে তার জনপ্রিয়তাকে কমাতে পারে। তারপরেও এরদোয়ানের একে পার্টি এখনো তুরস্কের সবচেয়ে শক্তিশালী দল এবং পার্লামেন্টে প্রভাবশালী হিসেবে টিকে আছে। অবশ্য জনমত জরিপে দেখা গেছে, কয়েকজন সম্ভাব্য প্রেসিডেন্ট প্রার্থীর তুলনায় পিছিয়ে আছেন এরদোয়ান।

রয়টার্স বলছে, জীবনযাত্রার ক্রমবর্ধমান ব্যয় তার পুনর্নির্বাচনের সম্ভাবনাকে হুমকির মুখে ফেলেছে জানার পর এরদোয়ান ন্যূনতম মজুরি দ্বিগুণ করার ঘোষণা দিয়েছেন।

বিরোধী দলগুলোও বেশ ভালোভাবেই নির্বাচনের প্রস্তুতি নিচ্ছে। তুরস্কের দুটি প্রধান বিরোধী দল- ধর্মনিরপেক্ষ রিপাবলিকান পিপলস পার্টি (সিএইচপি) এবং মধ্য-ডানপন্থী জাতীয়তাবাদী আইওয়াইআই পার্টি। তারা একটি প্ল্যাটফর্মের অধীনে ৪টি ছোট দলের সঙ্গে জোট করেছে।

তারা কেন্দ্রীয় ব্যাংকের স্বাধীনতা পুনরুদ্ধার এবং এরদোয়ানের অর্থনৈতিক নীতি পরিবর্তনের অঙ্গীকার করেছে। তারা পূর্ববর্তী সংসদীয় ব্যবস্থার পক্ষে নির্বাহী রাষ্ট্রপতি পদও ভেঙে দেওয়া এবং সিরীয় শরণার্থীদের ফেরত পাঠানোর প্রতিশ্রুতি দিয়েছে।

সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট বাশার আল-আসাদকে ক্ষমতাচ্যুত করার ব্যর্থ প্রচেষ্টাকে সমর্থন করেছেন এরদোয়ান। তিনি ৩.৬ মিলিয়নেরও বেশি সিরীয় শরণার্থীকে আশ্রয় দিয়েছেন। যা তুরস্কে অর্থনৈতিক সংকটকে প্রকট করেছে।

রয়টার্স বলছে, ৬ দলীয় জোট একটি ঐক্যবদ্ধ প্লাটফর্ম গঠনের চেষ্টা করছে। কিন্তু প্রেসিডেন্ট পদে এরদোয়ানকে চ্যালেঞ্জ জানাতে এখনো কোনো প্রার্থীর ব্যাপারে একমত হতে পারেনি।

সিএইচপি নেতা কামাল কিলিচদারোগলুকে একজন নিষ্ক্রিয় প্রচারক হিসেবে দেখা হয়। আরেক প্রতিদ্বন্দ্বী ইস্তাম্বুলের সিএইচপি মেয়রকে গত ডিসেম্বরে নির্বাচনী কর্মকর্তাদের কটূক্তির করার দায়ে জেল ও রাজনৈতিক নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়।

এদিকে তুরস্কের শীর্ষ আদালত তৃতীয় বৃহত্তম সংসদীয় দল কুর্দিপন্থী পিপলস ডেমোক্রেটিক পার্টির (এইচডিপি) কার্যক্রম বন্ধে একটি মামলার শুনানি করছে। প্রেসিডেন্টকে কটূক্তির অভিযোগে ২০১৬ সাল থেকে কারাগারে আছেন এইচডিপির সাবেক নেতা সেলাহাতিন ডেমিরতাস।

তবে, তুরস্কে নির্বাচনের প্রচারণা শুরু হয়ে গেলে বিরোধী দলগুলোর বার্তা মানুষের কাছে পৌঁছানো কঠিন হতে পারে বলে মনে করছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা। কারণ, ২০১৮ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে তারা তুর্কি টেলিভিশন চ্যানেলগুলোতে সম্প্রচারের চেষ্টা করেছিল। কিন্তু, তা হয়ে ওঠেনি। কারণ, বেশিরভাগ চ্যানেল এরদোয়ানকে সমর্থন করে।

নির্বাচনের সময়সীমা জুনের মাঝামাঝি হলেও এরদোয়ানের দল বলছে, নির্বাচনের তারিখ এগিয়ে আনা হতে পারে।

অন্যদিকে এরদোয়ান সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট আসাদের সঙ্গে একটি শীর্ষ বৈঠকের সম্ভাবনার কথা জানিয়েছেন। বৈঠকটিকে শরণার্থীদের ভবিষ্যৎ নিয়ে আলোচনার সম্ভাব্য প্রথম ধাপ হিসেবে দেখা হচ্ছে। একই সময়ে, আঙ্কারা কয়েক মাস ধরে সতর্ক করে আসছে, তারা কুর্দি যোদ্ধাদের লক্ষ্য করে উত্তর সিরিয়ায় নতুন করে আক্রমণের প্রস্তুতি নিচ্ছে। এ বিষয়টি নির্বাচনে এরদোয়ানের গ্রহণযোগ্যতা বাড়িয়ে তুলতে পারে।

গত ৯ জানুয়ারি ওয়াশিংটন পোস্টের বিশ্লেষণে বলা হয়েছে, ২০২৩ সালে বিশ্বের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ নির্বাচন হবে তুরস্কে। এই নির্বাচনের ফলের দিকে চোখ থাকবে ওয়াশিংটন, মস্কোর পাশাপাশি ইউরোপ, মধ্যপ্রাচ্য, মধ্য এশিয়া এবং আফ্রিকার।

বিশ্লেষকরা বলছেন, নির্বাচনে অর্থনৈতিক সংকটসহ অন্যান্য সমস্যাগুলো বিরোধীদের প্রধান চাবিকাঠি হতে পারে। কিন্তু, আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা যাই বলুন না কেন শেষ কথা বলবেন তুরস্কের ভোটাররা।

Comments