গাজা: ৭৫ বছরের রক্তভেজা ভূখণ্ড

গত শতকের চল্লিশের দশকের শেষভাগে ফিলিস্তিনে ব্রিটিশ শাসনের অবসান ঘটে। এরপর সেখানে আরব ও ইহুদিদের মধ্যে উত্তরোত্তর উত্তেজনা বাড়তে থাকে। ১৯৪৮ সালের মে মাসে নবগঠিত ইসরায়েল রাষ্ট্র ও আরব দেশগুলোর মধ্যে শুরু হয় যুদ্ধ।
গাজা: ৭৫ বছরের রক্তভেজা ভূখণ্ড
১৯৪৮ সালের অক্টোবর মাসে ইসরায়েলের গ্যালিলি এলাকা থেকে পালিয়ে যাছেন ফিলিস্তিনি গ্রামবাসী। ছবি: রয়টার্স।

আদিকাল থেকেই নৌপথ ও বাণিজ্যের কাজে ব্যবহৃত হতো গাজা উপত্যকা। ১৯১৭ সাল পর্যন্ত গাজা অটোমান সাম্রাজ্যের অধীনে ছিল। গত শতকে ব্রিটিশদের কাছ থেকে মিশরীয়দের হাতে যায় এর শাসনভার। এরপর থেকে সেখানে চলছে ইসরায়েলি দখলদারত্ব। বর্তমানে অধিকৃত এই ভূমিতে বাস করছে প্রায় ২৩ লাখেরও বেশি ফিলিস্তিনি।

দেখে নেওয়া যাক ফিলিস্তিনের গত ৭৫ বছরের টাইমলাইন।

১৯৪৮: ব্রিটিশ শাসনের অবসান

গত শতকের চল্লিশের দশকের শেষভাগে ফিলিস্তিনে ব্রিটিশ শাসনের যবনিকাপাত ঘটে। এরপর সেখানে আরব ও ইহুদিদের ভেতর উত্তরোত্তর উত্তেজনা বাড়তে থাকে। নবগঠিত ইসরায়েল রাষ্ট্র ও আরব দেশগুলোর মধ্যে ১৯৪৮ সালের মে মাসে শুরু হয় যুদ্ধ।

১৯৪৮ সালে স্বাধীনতা যুদ্ধের শুরুর দিকে ইসরায়েলি সৈন্যরা গ্যালিলি অঞ্চলের একটি গ্রামে আক্রমণ করছে। ছবি: রয়টার্স

নিজেদের বাড়িঘর ছেড়ে উদ্বাস্তু ফিলিস্তিনিরা দলে দলে আশ্রয় নিতে থাকেন গাজায়। মিসরীয় সেনারা ২৫ মাইল দীর্ঘ উপকূলীয় এই এলাকা দখলে রাখে। এটি সিনাই থেকে শুরু হয়ে বর্তমান ইসরায়েলের আশকেলনের দক্ষিণ পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। উদ্বাস্তুদের উত্তরোত্তর সংখ্যাবৃদ্ধিতে গাজার জনসংখ্যা প্রায় তিনগুণ বেড়ে যায়। সেখানে আশ্রয় নেওয়া মানুষের সংখ্যা দাঁড়ায় দুই লাখ।

১৯৫০-১৯৬০ দশক: মিসরের সামরিক শাসন

গাজা উপত্যকা প্রায় দুই দশক ধরে ছিল মিসরের নিয়ন্ত্রণে। সামরিক শাসনের অধীনে থাকা ফিলিস্তিনিরা মিসরে লেখাপড়া ও কাজের জন্য যেতে পারতেন। সে সময় 'ফিদাঈন' নামে একটি সশস্ত্র সংগঠন গড়ে ওঠে। তাদের অনেকেই ছিলেন উদ্বাস্তু। ইসরায়েলে হামলা করে প্রতিশোধ নেওয়ার পরিকল্পনা ছিল সংগঠনটির।

১৯৬৭ সালে ছয় দিনের যুদ্ধে ইসরায়েলি বিমান হামলায় সিনাইয়ের একটি সড়কের পাশে ধ্বংস হয়ে যাওয়া মিশরীয় প্রতিরক্ষা দেয়াল। ছবি: রয়টার্স

জাতিসংঘ উদ্বাস্তুদের জন্য দ্য ইউনাইটেড নেশনস রিলিফ অ্যান্ড ওয়ার্কস এজেন্সি ফর প্যালেস্টাইন রিফিউজি ইন দ্য নেয়ার এশিয়া  'ইউএনআরডব্লিউএ' নামে একটি সংস্থা গড়ে তোলে। এই সংস্থা বর্তমানে প্রায় ১৬ লাখ নিবন্ধিত ফিলিস্তিনি উদ্বাস্তুর জন্য বিভিন্ন সেবামূলক কার্যক্রম গ্রহণ করেছে। গাজার বাইরে জর্ডান, লেবানন, সিরিয়া ও পশ্চিম তীরে থাকা ফিলিস্তিনিদের জন্যও রয়েছে তাদের কার্যক্রম।

১৯৬৭: যুদ্ধ ও ইসরায়েলের দখলদারত্ব

১৯৬৭ সালে তৃতীয় আরব-ইসরায়েল যুদ্ধে গাজা দখল করে ইসরায়েল। ইসরায়েলের করা এক আদমশুমারিতে দেখা যায়, ফিলিস্তিনের জনসংখ্যা ৩ লাখ ৯৪ হাজার, যার ভেতর শতকরা ৬০ ভাগই উদ্বাস্তু।

মিসরের বিদায়ের পর, গাজার শ্রমিকরা ইসরায়েলের অভ্যন্তরে কৃষি, নির্মাণ ও সেবামূলক কাজে যুক্ত হতে থাকে। গাজার শাসনের ভার ইসরায়েলের হাতেই থেকে যায়। নিজেদের গড়ে তোলা স্থাপনাগুলোর রক্ষণের ভার পরবর্তী দশকগুলোতে ইসরায়েলের হাতেই থাকে। এর ফলে ফিলিস্তিনিদের ভেতর ক্ষোভের সঞ্চার হয়, যা উত্তরোত্তর বাড়তেই থাকে।

১৯৮৭: ফিলিস্তিনিদের জাগরণ

আরব-ইসরায়েল যুদ্ধের ২০ বছর পর ১৯৮৭ সালে আবারও ফিলিস্তিনিরা জেগে উঠতে থাকে। আরবি ভাষায় একে বলে 'ইন্তিফাদা।' একই বছর হামাস প্রতিষ্ঠিত হয়।

১৯৮৭ সালের ডিসেম্বরে ফিলিস্তিনি শ্রমিকদের বহন করা একটি গাড়িতে ইসরায়েলি এক ট্রাকের ধাক্কায় চার জন ফিলিস্তিনি শ্রমিক নিহত হন। এতে পাথর ছুঁড়ে, ধর্মঘট ও হরতাল পালন করে প্রতিবাদ চলতে থাকে। এর সদ্ব্যবহার করে মিসরের মুসলিম ব্রাদারহুডের গড়া সশস্ত্র সংগঠন হামাস। গাজা-ভিত্তিক এই সংগঠনটি ইসরায়েলের দখল থেকে ফিলিস্তিনকে মুক্ত করে ইসলামি শাসন প্রতিষ্ঠা করার বিষয়ে আগ্রহী হয়। তবে এ নিয়ে ইয়াসির আরাফাতের নেতৃত্বাধীন ধর্মনিরপেক্ষ 'ফাতাহ'-এর সঙ্গে হামাসের দ্বন্দ্ব শুরু হয়।

১৯৯৩: অসলো চুক্তি ও ফিলিস্তিনের অর্ধ-সায়ত্ত্বশাসন

১৯৯৩ সালে ঐতিহাসিক এক শান্তিচুক্তি স্বাক্ষরিত হয় ইসরায়েল ও ফিলিস্তিনের মাঝে। এর ফলে ফিলিস্তিনিদের শাসনভার গ্রহণের সুযোগ সৃষ্টি হয়। এই চুক্তি অনুসারে, ফিলিস্তিনিদের গাজায় ও পশ্চিম তীরের জেরিকোতে সামান্য নিয়ন্ত্রণের সুযোগ দেওয়া হয়। কয়েক দশক নির্বাসনে থাকার পর ইয়াসির আরাফাত গাজায় প্রত্যাবর্তন করেন।

পিএলও চেয়ারম্যান ইয়াসির আরাফাত ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী আইজাক রাবিনের সঙ্গে হ্যান্ডশেক করছেন। তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটন তাদের সঙ্গে দাঁড়িয়ে আছেন। ১৯৯৩ সেপ্টেম্বর মাসে হোয়াইট হাউস থেকে তোলা। ছবি: রয়টার্স।

অসলোর এই চুক্তি ফিলিস্তিনের শাসকগোষ্ঠীকে কিছুটা সায়ত্ত্বশাসনের সুযোগ দেয় ও পাঁচ বছর পরপর ক্ষমতা পরিবর্তনের সুযোগ রাখে। তবে তা কখনোই ঘটেনি। ইসরায়েল ফিলিস্তিনের বিরুদ্ধে চুক্তিভঙ্গের অভিযোগ তোলে। এদিকে ইসরায়েলের দখল করা জমিতে নতুন বসতি নির্মাণ ফিলিস্তিনিদের আরও ক্ষুব্ধ করে তোলে।

হামাস নানাভাবে প্রতিবাদ জানাতে শুরু করে। এর প্রতিক্রিয়ায় ইসরায়েল গাজার বাইরে ফিলিস্তিনিদের যাতায়াতে বিধিনিষেধ আরোপ করে।

২০০০: দ্বিতীয় ইন্তিফাদা

২০০০ সালে দ্বিতীয়বারের মতো ফিলিস্তিনিরা ইন্তিফাদা নিয়ে সোচ্চার হয়। ফিলিস্তিনিদের দিক থেকে আত্মঘাতী বোমা হামলা চালানো হয়। ইসরায়েল জবাব দেয় বিমান হামলা, যাতায়াতে বিধিনিষেধ ও কারফিউ জারি করে।

গাজা উপত্যকার দক্ষিণে রাফাহ অঞ্চলে গাজা বিমানবন্দরের ধ্বংসপ্রাপ্ত ভবন। ছবি: রয়টার্স

সেখানে একটি সম্ভাবনাময় স্থাপনা ছিল গাজার আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর। ফিলিস্তিনিদের কাছে এটি ছিল অর্থনৈতিক স্বাধীনতার এমন এক প্রতীক, যা নিয়ে তারা আশাবাদী হতো। বাইরের পৃথিবীর সঙ্গে যোগাযোগের ক্ষেত্রেও এটি ছিল একমাত্র জায়গা। যার ওপর ইসরায়েল বা মিসরের নিয়ন্ত্রণ নেই। ১৯৯৮ সালে চালু হওয়া এই বিমানবন্দরটিকে ইসরায়েল নিরাপত্তার জন্য একটি হুমকি হিসেবে দেখে এবং ২০০১ সালের ১১ সেপ্টেম্বর টুইন টাওয়ারে হামলার কিছুদিন পরই বিমানবন্দরটির রাডার ও রানওয়ে ধ্বংস করে দেয়।

এমন আরেকটি সম্ভাবনাময় ক্ষেত্র ছিল গাজার মৎস্য শিল্প। বহু লোকের রুটি-রুজির উপায় ছিল এটি। গাজার মৎস্য ক্ষেত্রগুলো কমিয়ে দিতে থাকে ইসরায়েল। কারণ হিসেবে তারা জানায়, নৌকায় করে অস্ত্র চোরাচালান বন্ধের জন্য জলপথ কমিয়ে আনা দরকার।

২০০৫: ইসরায়েলের দখল অপসারণ

২০০৫ সালের আগস্টে ইসরায়েল গাজা থেকে তাদের সমস্ত সৈন্য ও সেটেলারদের সরিয়ে নেয়। সে সময় পুরো বিশ্ব থেকে গাজাকে বিচ্ছিন্ন করে রেখেছিল ইসরায়েল।

ফিলিস্তিনিরা বেশিরভাগ পরিত্যক্ত ভবন ও অবকাঠামোগুলো ধ্বংস করে, রয়ে যায় কিছু কিছু অবশেষ। সেটলমেন্ট অপসারণের ফলে গাজার ভেতর চলাচলে কিছুটা স্বাধীনতা আসে। এর সঙ্গে গতি পায় 'টানেল অর্থনীতি', সশস্ত্র ও ব্যবসায়ী গোষ্ঠীগুলো মিসর পর্যন্ত বহু সুড়ঙ্গ খোঁড়ে।

২০০৬: হামাসের অধীনে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়া গাজা

২০০৬ সালে ফিলিস্তিনের সংসদ নির্বাচনে চমকপ্রদ সাফল্য পায় হামাস। এতে গাজার সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণও চলে আসে তাদের হাতে। এর ফলে আরাফাতের পর প্রেসিডেন্ট হওয়া মাহমুদ আব্বাস ও তার অনুসারীরা ক্ষমতাচ্যুত হন।

আন্তর্জাতিক মহল হামাসের এই বিজয়কে সহজভাবে নেয়নি। এই সরকারকে অনেক দেশ স্বীকৃতি দেয়নি, কারণ হামাসকে তারা সন্ত্রাসী সংগঠন হিসেবেই দেখতেন।

হাজারো ফিলিস্তিনি শ্রমিককে ইসরায়েলে গিয়ে কাজের সুযোগ বন্ধ হয়ে যায়। ইসরায়েলের বিমান হামলায় গাজার একমাত্র বিদ্যুৎকেন্দ্র অকার্যকর হয়ে পড়ে। এতে বিস্তৃত এলাকাজুড়ে 'ব্ল্যাকআউট' শুরু হয়। নিরাপত্তাজনিত কারণে, ইসরায়েল ও মিসর গাজা সীমান্ত দিয়ে মানুষের চলাচল ও মালামাল পরিবহনে কঠোর বিধিনিষেধ আরোপ করে।

হামাসকে হুমকি হিসেবে দেখতে শুরু করে মিসরের সেনা সমর্থিত নেতা আবদেল ফাত্তাহ আল-সিসি। ২০১৪ সালে ক্ষমতাগ্রহণের পর তিনি গাজার সঙ্গে সীমান্ত বন্ধ করে দেন এবং বেশিরভাগ সুড়ঙ্গ উড়িয়ে দেন। আরও একবার একঘরে হয়ে পড়ায় গাজার অর্থনীতি চলতে শুরু করে উল্টোপথে।

ইসরায়েল ও ফিলিস্তিনের অব্যাহত দ্বন্দ্ব

ইসরায়েল ও ফিলিস্তিনের সশস্ত্র দলগুলোর ভেতর অব্যাহত দ্বন্দ্ব, আক্রমণ ও পাল্টা-আক্রমণে ধুঁকতে শুরু করে গাজার অর্থনীতি।

২০২৩ সালের আগে ২০১৪ সালে হামাস ও অন্যান্য দলগুলো ইসরায়েলের শহরগুলোতে রকেট হামলা চালায়। ইসরায়েল বিমান ও আর্টিলারি হামলা চালায় যাতে গাজার আশেপাশের অঞ্চলগুলো বিধ্বস্ত হয়। ২ হাজার ১০০-এর বেশি ফিলিস্তিনি প্রাণ হারান, যাদের বেশিরভাগই ছিলেন বেসামরিক নাগরিক। বিপরীতে ইসরায়েলের ৬৭ জন সৈন্য ও ছয় জন বেসামরিক মানুষ নিহত হন।

২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর ইসরায়েল-গাজা সীমান্তে কাঁটাতাদের প্রাচীর ভেঙে ইসরায়েলে হামলা করে হামাস যোদ্ধারা। ছবি: রয়টার্স

২০২৩: অতর্কিত আক্রমণ

ইসরায়েলের ধারণা ছিল যুদ্ধ করতে করতে পরিশ্রান্ত হামাসকে তারা দুর্বল করে ফেলেছে। তবে তলে তলে হামাস সদস্যরা যুদ্ধের প্রশিক্ষণ নিতে থাকে।

ইসরায়েলি বাহিনী গাজা শহরের একটি উঁচু ভবনে হামলার পর ধোঁয়া ও আগুনের শিখা। ৭ অক্টোবর, ২০২৩। ছবি: রয়টার্স।

গত ৭ অক্টোবর হামাস ইসরাইলের ওপর অতর্কিত হামলা চালায়। নিহত হন হাজারের বেশি মানুষ। শতাধিক ইসরায়েলি ও অন্যান্য দেশের নাগরিককে জিম্মি করে হামাস। এর শোধ নিচ্ছে ইসরায়েল। চালাচ্ছে মহাতাণ্ডব, অতর্কিতে করছে বিমান হামলা। সংঘাত শুরু হওয়ার ৭৫ বছর পরে এখন রক্তাক্ত, ধ্বংসস্তুপে পরিণত হয়েছে গাজা।

তথ্যসূত্র: রয়টার্স

 

Comments