
গত ২৪ নভেম্বর আর্জেন্টিনার বিরুদ্ধে বিশ্বকাপের খেলায় চমক দেখায় সৌদি আরব। সেদিনের খেলায় দলের গোলকিপার মোহাম্মদ আল ওয়াইসের হাঁটুর আঘাতে নিজের দলের ডিফেন্ডার ইয়াসের আল শাহরানি গুরুতর আহত হন। তাকে বড় ধরনের অস্ত্রোপচার করাতে হয়েছে। তিনি আবার খেলায় ফিরতে পারবেন বলে আশা করছেন। কিন্তু, এমন ভাগ্য অনেকেরই হয় না।
গত ৩০ সেপ্টেম্বর রোমানিয়ার ফুটবলার ৩৩ বছর বয়সী আলেকজান্দ্রু ভাগনার অনুশীলন সেশনে হার্ট অ্যাটাক করে পড়ে যান। তাকে দ্রুত স্ট্রেচারে তুলে কাছাকাছি ব্রাসভ কাউন্টি ইমার্জেন্সি হাসপাতালে নেওয়া হয়। ডাক্তাররা সাধ্যমতো চেষ্টা করেও তাকে বাঁচাতে পারেননি।
গত ২ ফেব্রুয়ারি এথেন্সের ফুটবলার আলেকজান্দ্রোস ল্যামপিস খেলা শুরুর মাত্র ৫ মিনিটের মাথায় বলের পেছনে ছুটতে গিয়ে হুমড়ি খেয়ে পড়ে যান, তার হৃৎস্পন্দন পাওয়া যাচ্ছিল না। কৃত্রিমভাবে স্পন্দন সৃষ্টির ডিফিব্রিলেটর মাঠে ছিল না, ২০ মিনিটের মধ্যে অ্যাম্বুলেন্স এনেও তাকে মৃতই ঘোষণা করতে হয়।

২০২১ সালের ২২ ডিসেম্বর ইন্দোনেশিয়ার টোর্নাডো এফসি দলের গোলরক্ষক তৌফিক রামসিয়া বল ধরতে গেলে ওয়াহান এফসির খেলোয়াড়ের সঙ্গে সংঘর্ষে তার মাথা ফেটে যায়। তিনি তখনই কোমায় চলে যান। সেই অবস্থাতে তার মৃত্যু ঘটে।
২০১৯ সালের ২৯ ডিসেম্বর কলকাতা ইস্ট বেঙ্গলের সাবেক খেলোয়াড় রাধাকৃষ্ণ ধনরঞ্জন খেলার ২৭ মিনিটে বুকের ব্যথায় আকস্মিক মঠে পড়ে যান। তার নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসে। দ্রুতই হাসপাতালে নেওয়া হয়। অবস্থার পরিবর্তন ঘটেনি, তার মৃত্যু হয়।
২০১৮ সালের ৪ মে ফুটবলের পেছনে ছুটছিলেন দক্ষিণ আফ্রিকার মারিৎজবার্গ ইউনাইটেডের মিডফিল্ডার লুইয়ান্দা এনসাঙ্গাসি। এমন সময় তার ওপর বজ্রপাত হয়। তিনি হাসপাতালে মারা যান।
২০১৬ সালের ১ মে একইভাবে বজ্রপাতে মারা যান মালয়েশিয়ার মারেকা ইউনাইটেড ক্লাবের ফুটবলার স্তেফান পেত্রোভস্কি।

২০১৬ সালের ৯ মে ক্যামেরুন জাতীয় নারী দলের গোলরক্ষক জেনি জোমনাগ ওয়ার্মআপ ম্যাচে মুখ থুবড়ে পড়ে যান। হার্ট অ্যাটাকে মারা যান তিনি।
নেপালে জন্ম নেওয়া আবুধাবির খেলোয়াড় দীপক অধিকারী খেলার সময়ই অজ্ঞান হয়ে পড়েন। সে অবস্থাতেই মারা যান তিনি।
ব্রাজিলিয়ান সেন্টার ফরোয়ার্ড ক্রিস্টিয়ানো জুনিয়র ২০০৩ - ২০০৪ ইস্ট বেঙ্গলের হয়ে খেলছিলেন। মোহনবাগানের বিরুদ্ধে হাইপ্রোফাইল খেলায় তিনি যখন দ্বিতীয় গোলটি করেন, গোলরক্ষক সুব্রত পালের সঙ্গে সংঘর্ষের পরপরই তিনি শুয়ে পড়েন এবং মারা যান।

বাস্তবতা হচ্ছে এমন ঘটনা মাঝে-মধ্যেই ঘটে। এই লেখাটিতে ফুটবল মাঠে মারা যাওয়া কয়েকজন পুরনো খেলোয়াড়কে স্মরণ করা যেতে পারে।
উইলিয়াম ক্রপার (জন্ম ২৭ ডিসেম্বর ১৮৬২ - মৃত্যু ১৩ জানুয়ারি ১৮৮৯): ক্রপার ছিলেন বিখ্যাত ডার্বিশায়ার ডাবল। একই সঙ্গে ডার্বি কাউন্টির ফুটবলার ও ডার্বিশায়ার ক্রিকেট ক্লাবের বোলার। ফুটবলে খেলতেন সেন্টার ফরোয়ার্ড হিসেবে। ফুটবল খেলতে গিয়ে মাঠে দুর্ঘটনায় তিনি প্রাণ হারান।
ডার্বিশায়ারের ব্রিমিংটনের ছেলে ক্রপারের বাবা ছিলেন রাজমিস্ত্রি। তিনি আশা করেছিলেন যে খেলার নেশা ছেড়ে ছেলেও বাবার পেশায় যোগ দেবেন। কিন্তু, ফুটবল ও ক্রিকেট খেলেই তার পুরো সময় কেটে যেত। ১৮৮৩ থেকে ১৮৮৬ পর্যন্ত তিনি ছিলেন কাউন্টির পক্ষে সর্বোচ্চ উইকেট শিকারি। ২৫ রানে ৭ উইকেট তার স্মরণীয় ইনিংস।
১৮৮৯ সালের ১২ জানুয়ারি লিঙ্কনশায়ারের ক্লি পার্ক মাঠে গ্রিমসবি দলের বিরুদ্ধে ফুটবলে নেমেছিলেন উইলিয়াম ক্রপার। তাকে আটকাতে না পারলে পরাজয় নিশ্চিত—এমন ধারণা ছিল প্রতিপক্ষের। ঠিক ১৫ মিনিট খেলার পর প্রতিপক্ষ খেলোয়াড় ড্যান ডয়েলের সঙ্গে ক্রপারের সংঘর্ষ হয়। ডায়েলের হাঁটুর আঘাত লাগে তার পেটে। যন্ত্রণাকাতর অবস্থায় মাঠ ছাড়েন তিনি। দর্শকরা আশা করেছিলেন যে, ক্রোপার আবার ফিরবেন খেলার মাঠে। তিনিও ভেবেছেন সেরে যাবে। কিন্তু, বিধি বাম।
ডায়েলের হাঁটুর আঘাতে ক্রপারের অন্ত্রনালী ছিঁড়ে যায়। তখন চিকিৎসা তেমন সহজলভ্য ছিল না। যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছিলেন ক্রপার। পরের দিন ড্রেসিংরুমেই টিমমেট জর্জ হের কোলে মাথা রেখে মারা যান তিনি।
জেমস ডানলপ (১৭ মে ১৮৭০ - ১১ জানুয়ারি ১৮৯২): জেমস মিরেন ফুটবল দলের ক্যাপ্টেন ছিলেন স্কটিশ ফুটবলার ডানলপ। তখন বয়স ২১ বছর। তার সঙ্গে কোনো খেলোয়াড়ের সংঘর্ষ হয়নি। খেলার সময় নিজেই অসাবধানতার কারণে মাঠে পড়ে যান। কাঁচের টুকরো, কারো মতে ধারালো লোহার টুকরো লেগে হাঁটুতে বেশ খানিকটা কেটে যায়। তাৎক্ষণিক ভালো চিকিৎসা হয়নি। ফলে ধনুষ্টঙ্কার হয়ে যায়। ১০ দিন পর মৃত্যু হয় উনবিংশ শতকের এক শ্রেষ্ঠ ফুটবলারের।
টেডি স্মিথ: গ্লস্টারশায়ার কাপ সেমিফাইনালে বেডমিনস্টার দলের পক্ষে খেলছিল বিপক্ষ দল ইস্টভাইল রোভার্স। উপরে উঠে যাওয়া বল হেড করতে ছুটে যান ২ দলের ২ জন। টেডি স্মিথ মাথায় ধাক্কা খেয়ে পড়ে গেলেও আবার ওঠে দাঁড়ান এবং খেলা চালিয়ে যান। তখন বুঝতে পারেননি যে মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণ শুরু হয়ে গেছে। এক সময় মাঠে বসে পড়েন। সতীর্থরা দ্রুত ড্রেসিং রুমে নিয়ে যান। পরদিন সকালে তার মৃত্যু হয়।

জেমস লোগান (১৮৭০ - ১৮৯৬): স্কটিশ পেশাদার ফুটবলার লোগান ১৮৯৪ সালে এফএ কাপ ফাইনালে হ্যাট্রিক করে ইউরোপে খ্যাতি পেয়েছিলেন। তিনি খেলেছেন নটস কাউন্টির পক্ষে। বোল্টন ওয়ান্ডারার্স তাদের কাছে ৪-১ গোলে হারে। দলবদল করে অ্যাস্টন ভিলাতে আসতে তাকে ৩০ পাউন্ড ট্রান্সফার ফি দিতে হয়েছিল।
লাফবরার পক্ষে নিউটন হিথে খেলতে গিয়ে দেখলেন তাদের পোশাকের ট্রাংক হারিয়ে গেছে। পরনের পোশাক নিয়েই মাঠে নামতে হয়। বৃষ্টির মধ্যে খেলায় ০-২ গোলে হেরে গেলেন। অন্য পোশাক না থাকায় দীর্ঘ সময় ভেজা কাপড়েই বাড়ি ফিরতে হয়।
ইউরোপের আবহাওয়ার সঙ্গে যাদের পরিচয় আছে তারা জানেন এমনিতেই প্রায় সারা বছর শীতের কাপড় পরে থাকতে হয়। সেদিন তার ভীষণ ঠান্ডা লেগে যায়; এর মধ্যেই তিনি খেলেতে নামেন এবং ক্রু আলেকজান্দ্রা ফুটবল দলের বিরুদ্ধে খেলে ৪-১ গোলে জয়ী হন। তারপর বিছানায় পড়ে যান। ২৫ বছর বয়সেই নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত লোগানের মৃত্যু ঘটে।

ওয়াল্টার ব্যানিস্টার: সেকালে ফাউলের প্রকৃতি কী হতে পারে চেস্টারফিল্ড টাউন দলের ব্যানিস্টারের মৃত্যু এর সাক্ষ্য দেয়। ডার্বি জংশন দলের বিরুদ্ধে খেলার সময় প্রতিপক্ষের খেলোয়াড়ের লাথি লাগে তলপেটে। তার কিডনির রক্তনালী ফেটে যায়। ৩ সপ্তাহ পর ১৮৯৩ সালের ২৩ নভেম্বর তার মৃত্যু হয়।
ডেভিড 'সোলজার' উইলসন (১৮৮৩- ১৯০৬): লিডস সিটির ফুটবলার উইলসন ব্ল্যাক প্রথমে ছিলেন ওয়াচ ফার্স্ট ব্যাটালিয়নের সৈনিক। দক্ষিণ আফ্রিকায় বোয়ার যুদ্ধে অংশ নেন। নামের সঙ্গে তাই 'সোলজার' যুক্ত হয়। তিনি তা পছন্দও করতেন। তারপর সেনাবাহিনী ছেড়ে পেশাদার ফুটবলে যোগ দেন।
১৯০৬ সালের ২৭ অক্টোবর লিডস সিটির হয়ে বার্নলে দলের বিরুদ্ধে খেলছিলেন উইলসন। অর্ধেক সময় যাওয়ার পর বুকে ব্যথা শুরু হওয়ায় নিজেই ইঙ্গিত দিয়ে খেলা ছেড়ে ড্রেসিং রুমে চলে যান। কিছুক্ষণের মধ্যেই লিডস দলের ২ খেলোয়াড় আহত হয়ে মাঠ ছাড়লে তাদের প্রতিস্থাপক উপযুক্ত খেলোয়াড় না থাকায় উইলসনই গা ঝাড়া দিয়ে আবার মাঠে নামেন। দলের চিকিৎসক তাকে বাধা দিয়েছিলেন, তিনি কথা শোনেননি।
কিছুক্ষণ খেলার পর তিনি মাঠে শুয়ে পড়েন, তাকে স্ট্রেচারে ড্রেসিং রুমে আনতে হয়। তার শ্বাস বন্ধ হয়ে আসছিল। তার দম ফেরানোর সব চেষ্টা ব্যর্থ হয়। সেদিনই তাকে মৃত ঘোষণা করা হয়। ময়নাতদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়, উইলসনের মৃত্যুর কারণ হার্ট অ্যাটাক।

টমাস ব্ল্যাকস্টক (১৮৮২ - ১৯০৭): ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড দলের খেলোয়াড় টমি ব্ল্যাকস্টক নামে বেশি পরিচিত ছিলেন। ১৯০৭ সালের ৮ এপ্রিল দলের খেলা ছিল সেন্ট হেলেনসের বিরুদ্ধে। বল হেড করতে গিয়ে সংঘর্ষ হয়। তিনি মাঠেই পড়ে যান। মাঠ থেকে বের করার আর সুযোগ হয়নি। মাঠেই তার মৃত্যু হয়।
জন টমসন (২৮ জানুয়ারি ১৯০৯ - ৫ সেপ্টেম্বর ১৯৩১): ১৯৩০ দশকের বিখ্যাত স্কটিশ গোলরক্ষক জন টমসন। কেলটিক দলের খেলা চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী রেঞ্জারের বিরুদ্ধে। গ্লাসগোর ইবরক্স পার্ক স্টেডিয়ামে ৮০ হাজার দর্শকের উপস্থিতিতে খেলা হয়। রেঞ্জারের খেলোয়াড় স্যাম ইংলিশ বল নিয়ে গোলপোস্টের পাশে। টমসন বল ধরতে লাফ দিলেন, তার মাথা ধাক্কা খেল স্যামের হাঁটুতে। করোটির হাড় ভেঙে মাথা খানিকটা দেবে যায়। তার মৃত্যুর জন্য এটাই যথেষ্ট ছিল।
রেঞ্জারের এক খেলোয়াড় ছিলেন মেডিকেল কলেজের ছাত্র। তিনি মনে করলেন আর আশা নেই। স্ট্রেচারে তোলার পর টমসন মাথা তুলে গোল পোস্টের দিকে তাকালেন। ভিক্টোরিয়া ইনফার্মারি হাসপাতালে সেই রাতে তাকে মৃত ঘোষণা করা হয়।
এমন অনেক অনাকাঙ্ক্ষিত মৃত্যুর কারণ হয়ে আছে পৃথিবীর সবচেয়ে জনপ্রিয় খেলা ফুটবল।
Comments