ট্রাম্পনামা: যত গর্জে তত বর্ষে না

গত রাতে ফ্লোরিডার পাম বিচের বিলাসবহুল ‘মার-আ-লাগো’ বাসভবনের বলরুমে সমর্থক ও মিত্রদের উদ্দেশ্যে বক্তব্য দেন ট্রাম্প। ছবি: রয়টার্স
গত রাতে ফ্লোরিডার পাম বিচের বিলাসবহুল ‘মার-আ-লাগো’ বাসভবনের বলরুমে সমর্থক ও মিত্রদের উদ্দেশ্যে বক্তব্য দেন ট্রাম্প। ছবি: রয়টার্স

ম্যানহাটনের আদালতে সাবেক প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের বিরুদ্ধে আনা ৩৪ ফৌজদারি অভিযোগের বিস্তারিত তথ্য জানা গেছে। তবে গত মার্চে ট্রাম্প 'গ্রেপ্তার হতে পারি' ঘোষণা দেওয়ার পর যে রাজনৈতিক সংকট সৃষ্টির আশঙ্কা করা হয়েছিল বাস্তবে তা দেখা যায়নি।

ঘটনাপ্রবাহ পর্যালোচনা করে এ প্রসঙ্গে বাংলা প্রবাদ 'যত গর্জে তত বর্ষে না' স্মরণ করা যেতে পারে।

গতকাল মঙ্গলবার সারাদিনই বিশ্ব গণমাধ্যমের দৃষ্টি ছিল ট্রাম্প ও তাকে ঘিরে ঘটনাগুলোর ওপর।

আজ বুধবার আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমে বলা হয়, ১৩ পৃষ্ঠার নথিতে ট্রাম্পের বিরুদ্ধে ঘুষের বিনিময়ে পর্ণ তারকার মুখ বন্ধ রাখার বিষয়ে পরিচালিত তদন্তের সর্বশেষ তথ্য অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।

ম্যানহাটন ডিস্ট্রিক্ট অ্যাটর্নি অ্যালভিন ব্রাগের নেতৃত্বে তদন্তে এই প্রথম কোনো সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্টের বিরুদ্ধে ফৌজদারি অপরাধের অভিযোগ আনা হলো।

ম্যানহাটনের ডিস্ট্রিক্ট অ্যাটর্নি অ্যালভিন ব্রাগ। ছবি: রয়টার্স
ম্যানহাটনের ডিস্ট্রিক্ট অ্যাটর্নি অ্যালভিন ব্রাগ। ছবি: রয়টার্স

ট্রাম্পকে গ্রেপ্তার ও তাকে আদালতে নিয়ে আসার পর কী হবে, তা নিয়ে চলছিল ব্যাপক জল্পনা-কল্পনা ও বিশ্লেষণ।

ঘটনাপ্রবাহ থেকে ৫টি উল্লেখযোগ্য বিষয় সংবাদমাধ্যম আল জাজিরার প্রতিবেদনে তুলে ধরা হয়েছে—

সাদামাটা আত্মসমর্পণ ও গ্রেপ্তার

নিউইয়র্কের স্থানীয় সময় দুপুর ১টার কিছুটা পরে (বাংলাদেশ সময় রাত ১১টা) সাবেক প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প টাওয়ার থেকে ম্যানহাটনের আদালতে রওনা দেন।

ম্যানহাটনের ফৌজদারি আদালতে যাওয়ার পথে তিনি সমর্থকদের উদ্দেশ্যে হাত নাড়েন। আদালতে পৌঁছানোর পর তাকে হাতকড়া পরানো হয়নি। এমনকী, সাধারণ অপরাধীদের মতো এক পাশ থেকে ছবি তোলা বা সবার সামনে দিয়ে হাঁটিয়ে নিয়ে যাওয়ার প্রচলিত রীতিও অনুসরণ করা হয়নি। তাকে আনুষ্ঠানিকভাবে 'গ্রেপ্তার' ও 'পুলিশের হেফাজতে' নেওয়া হলেও, পুরোটা সময় তিনি আইনজীবীদের সঙ্গে ছিলেন।

আইন অনুসারে তার আঙুলের ছাপ নেওয়া হয়। এরপর, ট্রাম্পকে তার আইনজীবীদের পাশে চুপচাপ বসে তার বিরুদ্ধে আনা অভিযোগগুলো শুনতে দেখা যায়। তিনি ৩৪টি ফৌজদারি অভিযোগের সবগুলোতেই নিজেকে নির্দোষ দাবি করেন।

এক পর্যায়ে নিউইয়র্কের বিচারক হুয়ান মেরচান ট্রাম্পকে আদালতের কার্যক্রমে বিঘ্ন সৃষ্টি হতে পারে, এরকম আচরণ না করার জন্য সতর্ক করেন। ট্রাম্প বিচারকের মন্তব্য মেনে নেন।

প্রায় ১ ঘণ্টার মধ্যে আদালতের কাজ শেষ হলে ট্রাম্প সংবাদমাধ্যমের সঙ্গে কথা না বলে সেখান থেকে চলে যান।

অভিযোগ পর্ন তারকাকে ঘুষ দেওয়াতেই সীমাবদ্ধ নয়

আদালত কক্ষে প্রবেশের সময় ডোনাল্ড ট্রাম্প। ছবি: এএফপি

ট্রাম্পের বিরুদ্ধে আনা ৩৪টি ফৌজদারি অভিযোগ মূলত ব্যবসায়িক জালিয়াতির ওপর ভিত্তি করে তৈরি করা হয়েছে।

এর আগে ম্যানহাটন গ্র্যান্ড জুরির তদন্ত মূলত পর্ণ তারকা স্টর্মি ড্যানিয়েলসের মুখ বন্ধ রাখতে দেওয়া ১ লাখ ৩০ হাজার ডলারকে ঘিরে পরিচালিত হচ্ছে বলে ধারণা করা হয়েছিল।

সেসময় স্টর্মি দাবি করেন, তিনি ও তৎকালীন প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থী ট্রাম্প ২০০৬ সালে বিবাহবহির্ভূত সম্পর্কে জড়িয়েছিলেন। এ ঘটনা সম্পর্কে মুখ বন্ধ রাখার জন্য ট্রাম্পের আইনজীবীরা তাকে ২০১৬ সালে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের আগে ঘুষ দেন।

তবে ম্যানহাটনের ডিস্ট্রিক্ট অ্যাটর্নির কার্যালয়ের আনা অভিযোগ আরও বেশি গুরুতর। আদালত সাবেক প্রেসিডেন্টের বিরুদ্ধে 'বারবার জালিয়াতির' ও 'মিথ্যা তথ্য' দেওয়ার অভিযোগ এনেছে।

ট্রাম্পের বিরুদ্ধে 'ক্যাচ অ্যান্ড কিল' প্রতারণার অভিযোগও আনা হয়েছে। অভিযোগে বলা হয়, তিনি আমেরিকান মিডিয়া ইঙ্ক (এএমআই) প্রতিষ্ঠানের প্রধানের সঙ্গে যোগসাজশে তার ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ হতে পারে এমন ভিডিও ও তথ্য প্রচারে বাধার সৃষ্টি করেছেন অথবা সেগুলোকে কিনে নিয়েছেন।

এক হোটেলকর্মী দাবি করেছিলেন, সাবেক প্লেবয় মডেল ক্যারেন ম্যাকডুগালের সঙ্গে ট্রাম্প বিবাহবহির্ভূত সম্পর্ক থেকে ১ সন্তানের জন্ম হয়। তার পরিচয় ও বিস্তারিত তথ্য তিনি জানেন বলেও দাবি করেন সেই হোটেলকর্মী।

সহিংসতার আশংকা অমূলক

ট্রাম্প টাওয়ার ও ম্যানহাটনের ফৌজদারি আদালতের বাইরে শত শত বিক্ষোভকারী ট্রাম্প ও সরকারের পক্ষে সমর্থন জানায়।

২ পক্ষের মধ্যে ছোটখাটো সংঘর্ষ ছাড়া বিক্ষোভ শান্তিপূর্ণ ছিল। অনেক বিশ্লেষক ২০২১ সালের ৬ জানুয়ারিতে ক্যাপিটল হিলের সহিংসতার মতো ঘটনার আশংকা করলেও তা অমূলক প্রমাণিত হয়েছে।

নিউইয়র্কের ম্যানহাটনের আদালতে আইনজীবীদের সঙ্গে ডোনাল্ড ট্রাম্প। ছবি: রয়টার্স

সেসময় ট্রাম্পের বিরুদ্ধে সমর্থকদের উসকানি দেওয়ার অভিযোগ আসে। অভিযোগ গঠন ও গ্রেপ্তারের আগে তিনি আবারও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সমর্থকদের জেগে ওঠার আহ্বান জানান।

গত ১৮ মার্চ তিনি ট্রাম্প নিজস্ব সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ট্রুথ সোশালে লেখেন, 'শীর্ষ রিপাবলিকান প্রেসিডেন্ট প্রার্থী ও সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্টকে গ্রেপ্তার করা হবে। বিক্ষোভ করুন, দেশের নিয়ন্ত্রণ নিজেদের কাছে ফিরিয়ে নিন!'

গতকাল ম্যানহাটনে ৩৫ হাজার পুলিশ মোতায়েন করা হয় উল্লেখ করে সংবাদ প্রতিবেদনে বলা হয়, কড়া নিরাপত্তা পরিস্থিতির মধ্যে কোথাও উল্লেখযোগ্য অপ্রীতিকর ঘটনার সংবাদ পাওয়া যায়নি।

অভিযোগ নিয়ে ভিন্ন প্রতিক্রিয়া

স্বভাবতই ট্রাম্পের বিরুদ্ধে অভিযোগ নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের ২ প্রধান রাজনৈতিক দলে ভিন্ন প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছে।

রিপাবলিকানরা একে আইনি ব্যবস্থার অপব্যবহার হিসেবে দেখছেন। অপর দিকে, ডেমোক্র্যাটরা দেখছেন একে আইনের শাসনের জয় হিসেবে।

ডেমোক্র্যাট পার্টির মিশিগান অঙ্গরাজ্যের প্রতিনিধি রাশিদা তাইব বিবৃতিতে বলেন, 'কেউই আইনের ঊর্ধ্বে নন। তিনি যতই ধনী ও শক্তিশালী হন না কেনো।' তার এই বক্তব্যের সঙ্গে বেশিরভাগ ডেমোক্র্যাট নেতা সুর মিলিয়েছেন।

রিপাবলিকানরা এ ঘটনাকে 'রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে আইনি ব্যবস্থাকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহারের' অভিযোগ আনেন। অনেকেই ট্রাম্পের সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ করে বলেন, ২০২৪ সালে সাবেক প্রেসিডেন্টের পুনর্নির্বাচন প্রক্রিয়ায় বাধা দেওয়ার জন্য এই আইনি কার্যক্রম পরিচালনা করা হচ্ছে।

রিপাবলিকান দলের নেতা ও ফ্লোরিডার সিনেটর মার্ক রুবিও বলেন, 'আজ আমাদের সবার জন্য একটি খারাপ দিন। আজ মার্কিন রাজনীতি এমন এক মাত্রা ছাড়িয়েছে, যা থেকে আর আগের অবস্থানে ফিরে আসা সম্ভব নয়।'

'আজকের পর, যুক্তরাষ্ট্রের যেকোনো আইনজীবী নাম কুড়াতে চাইলে অপর পক্ষের যে কারো বিরুদ্ধে আইনি লড়াই চালানোর অনুমতি পেয়ে গেল,' যোগ করেন তিনি।

মার-আ-লাগোর বক্তব্যে সুনির্দিষ্ট তথ্য নেই

গত রাতে ফ্লোরিডার পাম বিচের বিলাসবহুল 'মার-আ-লাগো' বাসভবনের বলরুমে সমর্থক ও মিত্রদের উদ্দেশ্যে বক্তব্য দেন ট্রাম্প।

তবে আদালতের কার্যক্রম নিয়ে আলাদা কিছু না বলে তিনি মোটা দাগে তার বিরুদ্ধে আনা অভিযোগগুলো পুনরাবৃত্তি করেন। তিনি মার্কিন সমাজে 'অবক্ষয়' ও বিচারকদের তার 'বিরুদ্ধে অবস্থান নেওয়ার' মতো বিষয়গুলো তুলে ধরেন।

ম্যানহাটনের আদালতে পৌঁছানোর পথে ভক্তদের উদ্দেশ্যে হাত নাড়েন ট্রাম্প। ছবি: রয়টার্স
রয়টার্স ফাইল ফটো

উপস্থিত জনতাকে ট্রাম্প বলেন, 'অবিশ্বাস্য মনে হলেও, আমরা এখন জাতি হিসেবে ব্যর্থ হতে যাচ্ছি। জাতি হিসেবে আমরা অবক্ষয়ের মধ্য দিয়ে যাচ্ছি। এখন এসব উগ্র বামপন্থি উন্মাদরা আইন প্রয়োগকারী সংস্থার মাধ্যমে নির্বাচনে হস্তক্ষেপ করতে চায়। আমরা তা হতে দিতে পারি না।'

ট্রাম্প ম্যানহাটন ডিস্ট্রিক্ট অ্যাটর্নি অ্যালভিন ব্রাগ ও গতকালকের বিচারিক কার্যক্রমের নেতৃত্ব দেওয়া বিচারক মেরচানের সমালোচনায় মুখর ছিলেন।

ট্রাম্প আরও বলেন, 'আমি এমন একজন বিচারক পেয়েছি, যিনি ট্রাম্পকে ঘৃণা করেন। এমনকী তার স্ত্রী ও পরিবারও ট্রাম্পকে ঘৃণা করে। তার মেয়ে একসময় বর্তমান ভাইস প্রেসিডেন্ট কমলা হ্যারিসের অধীনে কাজ করতেন।'

ঘটনাপ্রবাহ বিশ্লেষণ করে বলা যেতে পারে, ট্রাম্পকে ঘিরে যে হট্টগোলের আশঙ্কা করা হয়েছিল তা না হওয়ায় স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলা গেছে। তার বিরুদ্ধে আনা অভিযোগগুলো আইনি প্রক্রিয়ায় এগিয়ে যাবে।

বিশ্লেষকদের কেউ কেউ মনে করছেন, আপাত মুক্ত ট্রাম্প সমর্থকদের সামনে আরও জোরালোভাবে নিজের পক্ষে কথা বলার পাশাপাশি বিরোধীদের নাস্তানাবুদের চেষ্টা করে যাবেন, যা তার নির্বাচনী প্রচারণার পালে বাড়তি হাওয়া দিতে পারে।

 

Comments

The Daily Star  | English

Who are Iran’s allies? And would any help if the US joins Israel in its war?

So, as the pressure mounts on Iran, has it been left to fight alone? Or does it have allies that could come to its aid?

11m ago