ট্রাম্পের জয়ে ‘প্রশ্নবিদ্ধ’ মূলধারার গণমাধ্যমের বিশ্বাসযোগ্যতা
সমস্ত অভিযোগ আর বিতর্ক সঙ্গে নিয়েও প্রত্যাবর্তনের অবিশ্বাস্য গল্প লিখে দ্বিতীয় দফায় যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়েছেন ডোনান্ড ট্রাম্প।
অথচ কেলেঙ্কারির শেষ ছিল না এই খ্যাপাটে-খেয়ালি মানুষটির। তিনি ফৌজদারী অপরাধে দোষী। পৃথিবীজুড়ে নিন্দুকের অভাব নেই তার। এবারও নির্বাচনী প্রচারের সময় নানা বিদ্বেষমূলক মন্তব্য, রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকের নিয়ে আক্রমণাত্মক কৌতুক আর প্রতিহিংসার হুমকি দিয়ে গেছেন তিনি।
প্রথম দফায় 'বিশৃঙ্খলা আর সমালোচনার' মেয়াদ শেষে ২০২০ সালের নির্বাচনে জো বাইডেনের কাছে হারের পর অনেকে ট্রাম্পের রাজনৈতিক ক্যারিয়ার শেষ বলে ধরে নিয়েছিলেন। এসব কারণেই এবারের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে লড়তে তার অনড় অবস্থানের প্রতি আস্থা রাখতে পারেননি তার নিজ দলের ভেতরের অনেকেই।
একইভাবে বিশ্বজুড়ে মূলধারার গণমাধ্যমগুলোও কমলা হ্যারিসের সম্ভাব্য জয় ও ট্রাম্পের পরাজয় নিয়ে যেসব পূর্বাভাস দিয়ে গেছে ক্রমাগত, সেগুলোও মিথ্যা প্রমাণিত হয়েছে।
তাতে প্রশ্ন উঠেছে মূলধারার গণমাধ্যমগুলোর বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়েও।
নির্বাচনে ট্রাম্প জিতে যাওয়ার পর তার ভক্ত ও ভোটারটা এখন দাবি করছেন, এই জয় সংবাদমাধ্যমের বিরুদ্ধেও। এই নির্বাচনে ভেতর দিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের কোটি কোটি ভোটার প্রথাগত সংবাদমাধ্যমের বয়ানকে প্রত্যাখ্যান করেছেন।
বুধবার সকালে অনলাইন সংবাদমাধ্যম 'দ্য ফেডারেলিস্টের' শিরোনামে ট্রাম্প ছিলেন না। শিরোনামটি ছিল, 'করপোরেট গণমাধ্যম শিল্প ২০২৪ সালের সবচেয়ে বড় পরাজিত শক্তি।'
ডেইলি ওয়্যারের পডকাস্টার ম্যাট ওয়ালশ সামাজিক মাধ্যম এক্সে লিখেছেন 'প্রথাগত গণমাধ্যমের মৃত্যু হয়েছে। তাদের বস্তুনিষ্ঠ সংবাদ পরিবেশনের সক্ষমতা ধ্বংস হয়েছে। ২০১৬ সালে গণমাধ্যমের বিরুদ্ধে ট্রাম্প যুদ্ধ ঘোষণা করেছিলেন। আজ রাতে তিনি তাদের একেবারে উড়িয়ে দিয়েছেন। তারা আর কখনোই প্রাসঙ্গিক হতে পারবে না।'
অনেকেই বলবেন, ওয়ালশের এই দাবি পুরোপুরি সত্য নয়; অতিরঞ্জিত। মঙ্গলবার বস্তুনিষ্ঠতার সঙ্গে গণমাধ্যমগুলো নির্বাচনের সংবাদ প্রকাশ করেছে এবং এতে প্রমাণ হয়েছে তাদের প্রাসঙ্গিকতার কোনো ক্ষয় হয়নি। তবে ট্রাম্পভক্তদের অনেকেই ওয়ালশের সঙ্গে একমত—তারা বিশ্বাস করেন মূলধারার গণমাধ্যমের কারণে যুক্তরাষ্ট্রের অনেক ক্ষতি হচ্ছে।
তারা যা পড়েন, তাতে ভরসা পান না। অনেক ট্রাম্পভক্ত এ ধরনের সংবাদমাধ্যমের পাঠক বা দর্শকও নন। তাদের কাছে সংবাদমাধ্যম হিসেবে টিকটক বা ফেসবুকের গ্রহণযোগ্যতা রয়টার্স, সিএনএনের চেয়ে বেশি।
যা ভাবছেন ট্রাম্পভক্তরা
নিউ ইয়র্ক ম্যাগাজিনের এক কলামে সম্প্রতি এই প্রশ্নটি তোলা হয়। এক নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক টিভি কর্মকর্তা বলেন, 'যদি দেশের অর্ধেক মানুষ মনে করে, প্রেসিডেন্ট হিসাবে ট্রাম্পই যোগ্য, তার অর্থ হল তারা এসব গণমাধ্যম একেবারেই পড়ছেন না। অর্থাৎ, আমরা গণমাধ্যম হিসেবে এই দর্শকদের পুরোপুরি হারিয়ে ফেলেছি।'
ওই টিভি কর্মকর্তার ভাষ্য, 'ট্রাম্পের জয়ের অর্থ হল মূল ধারার গণমাধ্যম এখন মৃত্যুর পথে যাত্রা শুরু করেছে। দ্রুত কোনো পরিবর্তন আনা না হলে একে বাঁচানো যাবে না'।
বড় বড় প্রাতিষ্ঠানিক গণমাধ্যমগুলোকে ট্রাম্পভক্তরা বরাবরই সন্দেহের চোখে দেখে আসছিলেন। এবারের নির্বাচনের ফলের পর এই সন্দেহ এখন অনাস্থা-অবিশ্বাসে রূপ নিয়েছে।
ট্রাম্পের নির্বাচনী শিবিরের এক কর্মকর্তা টেক্সট মেসেজে মন্তব্য করেন, গণমাধ্যমের উচিত আরও নম্র-ভদ্র থাকা।
এ ক্ষেত্রে পরবর্তী প্রশ্নটি হলো, ট্রাম্পভক্তরা যে ধরনের মতামত পোষণ করেন, সে বিষয়ে লিখতে চান বা লিখবেন, এমন কতজন কলাম লেখক বা সংবাদকর্মী রয়েছেন যুক্তরাষ্ট্রে?
ট্রাম্পের ওই কর্মকর্তা বলেন, 'বাইডেনের স্বাস্থ্য বা সীমান্ত পরিস্থিতি নিয়ে "বিভ্রান্তিকর তথ্য" পরিবেশন করা হলেও এ ক্ষেত্রে সেই তকমা কখনো দেওয়া হয়নি। হয়তো সাংবাদিকরা যে বিষয়গুলোকে "আপত্তিকর" মনে করে, সেগুলো আদতে বেশিরভাগ মানুষের কাছে আপত্তিকরই নয়।'
প্রভাব কমছে মূলধারার গণমাধ্যমের
সংবাদমাধ্যম সেমাফরের ডেভ ওয়েগেল বুধবার সকালে বলেন, 'মূলধারার গণমাধ্যমের প্রভাব প্রতি চার বছর পর পর কমছে। (কমলা) হ্যারিসবান্ধব সংবাদে সাবেক রিপাবলিকানরা ট্রাম্পকে নিয়ে ভয়ঙ্কর সব গল্প বলতে থাকেন। অপরদিকে রিপাবলিকানবান্ধব নব্য গণমাধ্যম ও সামাজিক গণমাধ্যমে ওই বয়ানকে "বিরক্তিকর আলাপ" ও অপ্রাসঙ্গিক বক্তব্য হিসবে অভিহিত করা হয়।'
সিএনএনের রাজনৈতিক বিশ্লেষক স্কট জেনিংস বলেন, ট্রাম্পের জয়ের মাধ্যমে 'বিদ্যমান রাজনৈতিক তথ্য প্রবাহ প্রক্রিয়াকে কাঠগড়ায় তোলা হয়েছে।'
জেনিংস বলেন, 'গত কয়েক সপ্তাহ আমাদের (গণমাধ্যম) যেসব গল্প শুনিয়েছে, তা একেবারেই সত্য নয়। আমরা শুনেছিলাম পুয়ের্তোরিকো, লিজ চেনি ও নিক্কি হ্যালির ভোটার এবং স্বামীর কাছে মিথ্যা বলেন এমন নারীরা নির্বাচনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। এর আগে টিম ওয়ালজ ও তার ক্যামো হ্যাটের সমালোচনা শুনেছি। রাতের পর রাত আমাদেরকে এসব আষাঢ়ে গল্প শুনিয়ে কমলা হ্যারিসের প্রতি সহানুভূতিশীল করে তোলার চেষ্টা চলেছে। কিন্তু এ ক্ষেত্রে আমরা মূল্যস্ফীতির মতো মৌলিক বিষয়গুলোকে উপেক্ষা করেছি। অনেক মানুষ খেয়ে না খেয়ে জীবনযাপন করছেন। এগুলোই হওয়া উচিত ছিল নির্বাচনের মূল আলোচ্য বিষয়।'
জেনিংস আরও জানান, 'আমরা যারা নির্বাচনী সংবাদ নিয়ে কাজ করেছি অথবা বিশ্লেষকের ভূমিকায় ছিলাম, বিশেষত, যারা প্রতিদিনই এ কাজে নিয়োজিত থাকেন, তাদেরকে বুঝতে হবে কোন বিষয়গুলো নিয়ে দেশের অর্ধেক মানুষ কথা বলছে। আমাদেরকে এই জনগোষ্ঠীর কথা বুঝতে হবে, শুনতে হবে। তারা আজ রাতে এক চরম বার্তা দিয়েছেন। তারা বলেছেন, "যথেষ্ঠ হয়েছে, আর সহ্য করব না"।'
উদারপন্থী বিশ্লেষক অ্যাশলি অ্যালিসন বলেন, 'আমি মনে করি, সবার কথাই শুনতে হবে। যারা কমলাকে ভোট দিয়েছেন, তারাও এখন সংগ্রামের মধ্য দিয়ে যাচ্ছেন। তারাও উপেক্ষিত। রিপাবলিকানের বেদনার চেয়ে ডেমোক্র্যাটের বেদনা কোনো অংশে কম-বেশি নয়।'
গণমাধ্যমের ভবিষ্যৎ ও কিছু প্রশ্ন
ইতিহাস বলছে, ট্রাম্প কখনোই সংবাদমাধ্যমের কার্যকারিতায় সন্তুষ্ট হন না। তিনি আরও বেশি সরকারবান্ধব গণমাধ্যম চান। ট্রাম্প সমর্থক গণমাধ্যম হিসাবে পরিচিত হলেও ফক্স নিউজের বিষয়েও নিয়মিত অভিযোগ করেন তিনি। গত মাসে ফক্স নিউজের সত্ত্বাধিকারী রুপার্ট মারডকের কাছে তিনি 'অতিরিক্ত ডেমোক্র্যাটিক বিজ্ঞাপন' প্রচারের অভিযোগ করেন।
সবমিলিয়ে, প্রেসিডেন্ট হিসেবে ট্রাম্প ফিরে আসায় মূলধারার গণমাধ্যমের সঙ্গে বিদ্বেষমূলক সম্পর্ক সৃষ্টির সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে। এক্ষেত্রে নিরপেক্ষ ও ট্রাম্পবিরোধী—উভয় ধারার গণমাধ্যমের প্রতি তিনি বিরূপ মনোভাব দেখাতে পারেন।
এ পর্যায়ে নতুন কিছু প্রশ্নও উঠেছে। সেটা হলো—ট্রাম্প প্রশাসন কি এসব গণমাধ্যমের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক পদক্ষেপ নেবে?
এ বছর অন্তত ১০-১২ বার 'প্রেসিডেন্ট হলে' এক বা একাধিক টিভি স্টেশনের লাইসেন্স বাতিলের হুমকি দিয়েছেন ট্রাম্প। এখন কি তার প্রশাসন এই হুমকির বাস্তবায়ন করবে? তিনি কী হোয়াইট হাউসে সাংবাদিক প্রবেশের ওপর বিধিনিষেধ আরোপ করবেন? তার অপছন্দের সাংবাদিকদের সেখানে ভিড়তে দেবেন না?
পাশাপাশি, গণমাধ্যমগুলো কী ট্রাম্পকে তুষ্ট করতে নিজেরাই নিজেদের কাজ সেন্সর করতে শুরু করবে? যদি তাই হয়, তাহলে ট্রাম্পবিরোধী দর্শক ও পাঠকদের প্রতিক্রিয়া কি হবে?
বুধবার সকালে বিভিন্ন মূলধারার সংবাদপত্রের সত্ত্বাধিকারী ও বার্তাকক্ষের কর্তারা তাদের কর্মীদের নতুন বাস্তবতা সম্পর্কে ধারণা দিয়েছেন। এক্ষেত্রে ধরেই নেওয়া যায় যে, আগামী মাসগুলোতে তারা অনিশ্চিত অবস্থার মধ্য দিয়ে যাবেন।
কর্মীদের কাছে পাঠানো বার্তায় কনডে নাস্টের প্রধান রজার লিঞ্চ বলেন, 'অন্য যেকোনো সময়ের তুলনা আমরা এখন নিরপেক্ষ সাংবাদিকতার ভিত্তিমূলগুলোর ধারক ও বাহক হিসাবে নিজেদের ভূমিকায় অটল থাকব। সংবিধানের প্রথম সংশোধনী মতে, আমরা একটি প্রগতিশীল, নিরপেক্ষ গণমাধ্যম এবং আমাদের কার্যকারিতা গণতন্ত্র ও সার্বিকভাবে যুক্তরাষ্ট্রে ভবিষ্যতের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।'
Comments