টেনিদার চার মূর্তি ও নির্বাচন পর্যবেক্ষক

আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচন যারা পর্যবেক্ষণ করবেন, তাদের ‘নড়াচড়া’ করতে নিষেধ করে দিয়েছেন নির্বাচন কমিশন সচিব। অনিয়ম দেখছেন, শুধু দেখবেন ‘মূর্তি’র মতো। সাংবাদিকরা এগিয়ে এসে জানতে চাইবেন, কী দেখলেন?
গ্রাফিকস-প্রথম আলোর সৌজন্যে

‘ভাস্কর্য’ না ‘মূর্তি’- আলোচনায় মাঝেমধ্যে সব সরগরম হয়ে ওঠে বাংলাদেশের রাজনীতি। সিদ্ধান্তে পৌঁছানোর আগেই, আবার তা চাপাও পড়ে যায়। মূর্তি ইস্যু চাপা দিতে হিমশিম খাচ্ছেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। পৃথিবীর সর্বোচ্চ উচ্চতার মূর্তি বানিয়ে, যেন সর্বোচ্চ বিপদে পড়েছেন। তিন হাজার কোটি রুপি ব্যয় করে বল্লভ ভাই প্যাটেলের মূর্তি না বানিয়ে, গরিব ভারতীয়দের জন্যে আর কী কী করা যেত সেই হিসাবে পুরো বিজেপি দিশেহারা। প্রতিবেশী বন্ধু দেশে মূর্তি নিয়ে যখন এত আলোচনা, বাংলাদেশ আর বাদ থাকবে কেন!

নির্বাচন কমিশনের সচিব ‘মূর্তি’ শব্দটি আলোচনায় নিয়ে এসেছেন। মূর্তিকে কেন্দ্র করে বাংলা ভাষায় বহু গল্প- উপন্যাস লেখা হয়েছে।

বাংলা ভাষার বুদ্ধিদীপ্ত রসিকতার মহান কারিগর নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায় যার অনবদ্য সৃষ্টি ‘টেনিদা’। বহুল পঠিত- জনপ্রিয় ‘চার মূর্তি’ উপন্যাসের চার চরিত্রের একজন টেনিদা। আজকের লেখার সঙ্গে হয়ত খুব একটা প্রাসঙ্গিক মনে নাও হতে পারে। তারপরও কয়েকটি লাইন উদ্ধৃত করছি-

... চারজনে পরীক্ষা দিয়েছি। লেখাপড়ায় ক্যাবলা সবচেয়ে ভালো—হেডমাস্টার বলেছেন। ও নাকি স্কলারশিপ পাবে। ঢাকাই বাঙাল হাবুল সেনটাও পেরিয়ে যাবে ফাস্ট ডিভিশনে। আমি দুবার অঙ্কের জন্যে ডিগবাজি খেয়েছি—এবার থার্ড ডিভিশনে পাস করলেও করতে পারি। আর টেনিদা—

তার কথা না বলাই ভালো। সে ম্যাট্রিক দিয়েছে কে জানে এনট্রান্সও দিয়েছে কি না। এখন স্কুল ফাইনাল দিচ্ছে—এর পরে হয়তো হায়ার সেকেন্ডারিও দেবে। স্কুলের ক্লাস টেন-এ সে একেবারে মনুমেন্ট হয়ে বসে আছে—তাকে সেখান থেকে টেনে এক ইঞ্চি নড়ায় সাধ্য কার!’

‘মনুমেন্ট’ হয়ে বসে নয়, মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে থাকার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে নির্বাচন পর্যবেক্ষকদের।

আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচন যারা পর্যবেক্ষণ করবেন, তাদের ‘নড়াচড়া’ করতে নিষেধ করে দিয়েছেন নির্বাচন কমিশন সচিব। অনিয়ম দেখছেন, শুধু দেখবেন ‘মূর্তি’র মতো। সাংবাদিকরা এগিয়ে এসে জানতে চাইবেন, কী দেখলেন?

দাঁড়িয়ে থাকবেন মূর্তির মতো মুখ বন্ধ করে, কোনো কথা বলবেন না। কেন্দ্র দখল করে যদি ব্যালটে সিল মারতে দেখেন, সেই দৃশ্য দেখতে পারবেন, ধারণ করতে পারবেন না, মানে ছবি তুলতে পারবেন না। যদিও ছবি তোলা পৃথিবীর কোনো দেশের পর্যবেক্ষকদের জন্যেই নিষিদ্ধ নয়।

নির্বাচন কমিশনের সচিব পর্যবেক্ষকদের মনে করিয়ে দিয়েছেন যে, আপনাদের অনেকের প্রতিষ্ঠান এনজিও হিসেবে কাজ করছে। সুতরাং যদি ‘মূর্তি’র মতো দাঁড়িয়ে না থাকেন, যদি ছবি তোলেন, যদি কথা বলেন, যদি এক কেন্দ্রে একজনের বেশি থাকেন, আমরা রিপোর্ট দিলেই বাতিল হয়ে যাবে আপনার এনজিও’র ‘নিবন্ধন’। যা কিছু ঘটতে দেখবেন, চুপ থাকবেন। নির্বাচন কমিশনকে জানাতে পারেন। পরে প্রতিবেদন দেবেন। প্রতিবেদন দিলে কী হয় বা হবে? তারও নজির আছে।

নির্বাচন পর্যবেক্ষক মোর্চা ‘ইলেকশন ওয়ার্কিরং গ্রুপ (ইউব্লিউজি)’। তারা গাজীপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচন পর্যবেক্ষণ করে একটি প্রতিবেদন দিয়েছিলেন। মোট ৪২৫টি কেন্দ্রের মধ্যে ৫৭টি ওয়ার্ডের ১২৯টি কেন্দ্র তারা পর্যবেক্ষণ করেছিলেন। ৪৬ দশমিক ৫ শতাংশ কেন্দ্রে তারা ব্যালট পেপারে জোর করে সিলমারাসহ নানা রকমের অনিয়ম দেখেছিলেন।

খুলনা সিটি করপোরেশন নির্বাচনেও বহুবিধ অনিয়ম দৃশ্যমান হয়েছিল। নির্বাচন কমিশনের সচিব ভোট গ্রহণের সময় শেষ হওয়ার পরপরই বলেছিলেন ‘চমৎকার নির্বাচন’। গাজীপুর বিষয়ে বলেছিলেন ‘সুষ্ঠু নির্বাচন’।

কোনো রকম তদন্ত বা অনুসন্ধান ছাড়াই নির্বাচন কমিশন ইডব্লিউজি’র প্রতিবেদন প্রত্যাখ্যান করেছিল। নিজেরাও কোনো তদন্ত করেনি। সিটি করপোরেশন নির্বাচনগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি অনিয়ম হয়েছিল বরিশালে। বলা হয়, আর যাই হোক এটাকে নির্বাচন বলা যায় না। একজন নির্বাচন কমিশনার তা স্বীকারও করেছেন। প্রধান নির্বাচন কমিশনার সেই নির্বাচন কমিশনারকে একটি রিপোর্ট দিতে বলেছিলেন। কমিশনার বহু পরিশ্রম করে যে রিপোর্ট দিয়েছিলেন, প্রধান নির্বাচন কমিশনার তা যত্ন করে তুলে রেখেছেন। কাউকেই জানাননি কী আছে রিপোর্টে।

খুলনা, গাজীপুর বা বরিশালের ক্ষেত্রে পর্যবেক্ষকরা ‘মূর্তি’র মতো দাঁড়িয়ে থাকেননি। কিছুটা নড়াচড়া করেছিলেন। এগিয়ে আসা সাংবাদিকদের কিছু প্রশ্নে মুখও বন্ধ করে থাকেননি। যা ইসি সচিবের ‘চমৎকার নির্বাচন’র সঙ্গে সাদৃশ্যপূর্ণ ছিল না। সুতরাং এখন থেকে মুখ বন্ধ, আর খোলা যাবে না, ছবিও তোলা যাবে না।

হাতি তো এভাবেই জঙ্গলে এবং উট পাখি বালুতে মুখ লুকিয়ে নিজেদের আড়াল করে!

২.

নির্বাচন পর্যবেক্ষকদের বিরুদ্ধে বহুবিধ অভিযোগ, তাদের অনেকে দলীয় মতাদর্শ ধারণ করেন। পর্যবেক্ষণকালে ‘নিরপেক্ষ’ না থেকে ‘পক্ষপাতিত্ব’ করেন। তাদের প্রশিক্ষণেরও ঘাটতি আছে। অভিযোগগুলো হয়ত অসত্য নয়! একজন পর্যবেক্ষকের পরিচয় দেওয়া যায় এভাবে।

একটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, নিয়োগ পেয়েছেন ঢাকার বাইরের আরেকটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য হিসেবে। কোনো মাসে দু’চারদিন বিশ্ববিদ্যালয়ে যান, কোনো মাসে যান না। উড়োজাহাজে সকালে উড়ে গিয়ে আবার দুপুর, বা বিকেলেই ফিরে আসেন। নিয়োগ পরীক্ষা তদারকি করেন টেলিফোনে। ঢাকায় থেকে তিনি তার প্রতিষ্ঠানের কাজ নিয়ে ব্যস্ত থাকেন। ইসি সচিব যখন ‘মূর্তি’র মতো দাঁড়িয়ে পর্যবেক্ষণের নির্দেশনা দিচ্ছিলেন শিক্ষক কাম উপাচার্য কাম পর্যবেক্ষকও সামনের সারিতেই বসা ছিলেন। এখন তিনি ইসি সচিবের বক্তব্যের ব্যাখ্যা দিচ্ছেন ‘না মানে ইসি সচিব ঠিক এভাবে বলতে চাননি... তিনি এটা মিন করেননি... তিনি বলতে চেয়েছেন...।’

পর্যবেক্ষকদের মধ্যে ভালো পর্যবেক্ষক যেমন আছেন, বহুবিধ অভিযোগের পর্যবেক্ষকও আছেন। তাদের সবাইকে পর্যবেক্ষণের অনুমতি নির্বাচন কমিশনই দিয়ে থাকেন। পর্যবেক্ষকদের যে দুর্বলতাগুলো আছে, সে বিষয়ে প্রশিক্ষণ বা অন্য কোনো কার্যকর উদ্যোগ নিতে দেখা যায় না নির্বাচন কমিশনকে। নির্বাচন কমিশন শিক্ষক বা পরীক্ষকের ভূমিকায় থেকে পরীক্ষার আয়োজন করে। সাম্প্রতিক সিটি করপোরেশন নির্বাচনগুলোর আলোকে বলা যায়, নিজেরা সেই পরীক্ষা নকল মুক্ত করতে পারছেন না। নকল মুক্ত করতে চান, সেই চেষ্টাটাই দৃশ্যমান হচ্ছে না। অন্যরা নকল মুক্ত পরীক্ষা ও পাস করানোর ক্ষেত্রে সহায়তা করতে চাইলেও, নির্বাচন কমিশন পাস করতে ইচ্ছুক নন বলেই তাদের কর্মকাণ্ডে প্রতীয়মান হয়। তারা সহায়তাকারীদেরও তাদের কাতারেই রাখতে চান।

সমস্যা বা সঙ্কট দূর না করে নিজেরা ‘চমৎকার নির্বাচন’ বলে পর্যবেক্ষকদের মূর্তি বানিয়ে ‘মুখ বন্ধ’ রাখতে বাধ্য করাতেই সকল মুশকিল আসান, নীতিতে অটল নির্বাচন কমিশন!

৩.

টেনিদার ‘চার মূর্তি’র এক মূর্তি পরীক্ষায় পাস করার সম্ভাবনা জাগিয়ে তুলেছিল। টেনিদা তাতে মহা-বিরক্ত হয়েছিলেন।

‘...টেনিদা বললে, চুপ কর, মেলা বকিসনি! তোর ওপরে আমার আশা-ভরসা ছিল—ভেবেছিলুম, আমার মনের মতো শিষ্য হতে পারবি তুই। কিন্তু দেখছি তুই এক-নম্বর বিশ্বাসঘাতক! কোন্ আক্কেলে অঙ্কের খাতায় ছত্রিশ নম্বর শুদ্ধ করে ফেললি? আর ফেললিই যদি, ঢ্যারা দিয়ে কেটে এলিনে কেন?

আমি ঘাড়-টাড় চুলকে বললাম, ভারি ভুল হয়ে গেছে!’

একজন নির্বাচন কমিশনার পাস করার উদ্যোগ নিয়ে ‘ভারি ভুল’ করে ফেলেছিলেন।

নির্বাচন পর্যবেক্ষকরা কড়া হুমিকর ‘নিবন্ধন’ বাতিলের ঝুঁকি নিয়ে ছত্রিশ নাম্বার পেয়ে পাস করার চেষ্টা করবেন, না ঘাড়-টাড় চুলকে বলবেন ‘ভারি ভুল হয়ে গেছে!’

Comments

The Daily Star  | English

Sea-Level Rise In Bangladesh: Faster than global average

Bangladesh is experiencing faster sea-level rise than the global average of 3.42mm a year, which will impact food production and livelihoods even more than previously thought, government studies have found.

21m ago