অনুমতি ছাড়াই ৭ কোটি মোবাইল ফোন ব্যবহারকারীর ব্যক্তিগত তথ্য নিলো বিটিআরসি
অনুমতি ছাড়াই ৭ কোটি মোবাইল ফোন ব্যবহারকারীর ব্যক্তিগত তথ্য নিয়েছে বাংলাদেশ টেলিকমিউনিকেশন রেগুলেটরি কমিশন বিটিআরসি।
ভুতুড়ে জরিপের নামে সেসব তথ্য আবার দেওয়া হয়েছে সরকারী এজেন্সির কাছে। জাতীয় নির্বাচনের কয়েক সপ্তাহ আগে ফোন অপারেটরদের কাছ থেকে গ্রাহকদের ব্যক্তিগত তথ্য নেওয়া হলো।
প্রথমে চারটি ফোন অপারেটর এসব তথ্য বিটিআরসি’কে দিতে রাজি না হলেও পরে চাপের মুখে দিতে বাধ্য হয়। আইন অনুযায়ী গ্রাহকদের সঙ্গে বিশ্বাসভঙ্গ করা হয়েছে।
দেশে প্রাইভেসি ও তথ্য সংরক্ষণ আইন এখনো হয়নি। প্রচলিত আইনে রয়েছে- মোবাইল কোম্পানিগুলো গ্রাহকদের তথ্য কাউকে দিতে পারবে না- যদি না আদালতের কোনো নির্দেশ থাকে অথবা জাতীয় নিরাপত্তা ও আইন-শৃঙ্খলার বিষয় আসে।
মোবাইল কোম্পানির সূত্রে জানা যায়, এমন তথাকথিত জরিপের নামে তাদের কাছ থেকে গ্রাহকদের তথ্য নেওয়ায় তারা বিব্রত বোধ করছে।
অবাক করার বিষয় হচ্ছে, কোন সরকারী এজেন্সির কাছে এসব তথ্য দেওয়া হয়েছে সে বিষয়ে বিটিআরসি দুই দিনের মধ্যে দুই রকমের কথা বলেছে।
গত ১১ ডিসেম্বর কমিশনের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান জহুরুল হক বলেন, “আমরা বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয় থেকে জরিপের বিষয়ে একটি চিঠি পেয়েছিলাম। সেই জরিপের জন্যে তথ্য প্রয়োজন। আমি জানি না এর কারণে কোনো আইন-ভঙ্গ হয়েছে কী না।”
গত রাতে তিনি বলেন, আসলে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) এই তথ্যগুলো নিয়েছে।
তবে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে দ্য ডেইলি স্টারের সন্দেহ আরও ঘনীভূত হয়। কেননা, বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ জানান, বিটিআরসি’র কাছ থেকে কোনো তথ্যই নেওয়া হয়নি।
তিনি বলেন, “এই মুহূর্তে আমাদের এ ধরণের কোনো জরিপ চালানোর পরিকল্পনা নেই।”
এদিকে, পরিসংখ্যান ব্যুরোর মহাপরিচালক কৃষ্ণা গায়েনের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি জানান, সাম্প্রতিককালে বিটিআরসি’র কাছ থেকে কোনো মোবাইল ফোন ব্যবহারকারীর তথ্য নেওয়া হয়নি।
বিদ্যুৎ বিভাগের মহাপরিচালক মোহাম্মদ হোসেন জানান, তারা বিটিআরসি’র কাছ থেকে মোবাইল ফোনের গ্রাহকদের কোনো তথ্য নেয়নি।
তিনটি বিশ্বস্তসূত্র দ্য ডেইলি স্টারকে নিশ্চিত করেছে যে, বাস্তবতা হচ্ছে- প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিদ্যুৎ ও জ্বালানি বিষয়ক উপদেষ্টা ড. তৌফিক-ই-ইলাহী বিটিআরসি থেকে তথ্য সংগ্রহ করে তা পরিসংখ্যান ব্যুরোর কাছে হস্তান্তর করেছেন।
গত রাতে তার সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি বিটিআরসি’র কাছ থেকে তথ্য নেওয়ার কথা স্বীকার করে বলেন এর মাধ্যমে ফোন ব্যবহারকারীদের কাছ থেকে বিদ্যুতের সন্তুষ্টির বিষয়ে জরিপ করা হবে।
নির্বাচনের আগে গ্রাহকদের ব্যক্তিগত তথ্য সংগ্রহ করার কারণ কী জানতে চাওয়া হলে তিনি দাবি করেন যে বিটিআরসি’র কাছে এসব তথ্য অনেক আগেই চাওয়া হয়েছিলো কিন্তু, তারা তা দিতে দেরি করেছে।
তিনি আরও বলেন যে যদি আওয়ামী লীগ আবারো ক্ষমতায় আসে তাহলে আগামী জানুয়ারিতে এই জরিপ করা হবে। তিনি বলেন, প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা হিসেবে এসব তথ্য নেওয়ার কর্তৃত্ব তার রয়েছে।
গত ৪ ডিসেম্বর চারটি মোবাইল ফোন কোম্পানিকে চিঠি দেয় বিটিআরসি। তাদের কাছ থেকে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব গ্রাহকদের ব্যক্তিগত তথ্য চাওয়া হয়। চিঠিতে বলা হয় বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ের এসব তথ্য ব্যবহার করবে। তাদের ‘বিদ্যুৎ জরিপে’ ব্যবহার করার কথা চিঠিতে উল্লেখ করা হয়েছে। সেই চিঠির একটি কপি ডেইলি স্টারের হাতে এসেছে।
অপারেটররা গত ১০ ডিসেম্বর বিটিআরসি’র সেই অনুরোধ রাখে।
এই ব্যবস্থায় দেশের ১৮৪ উপজেলার সব মোবাইল ফোন ব্যবহারকারীর ব্যক্তিগত তথ্য নেওয়া হয়েছে। বিটিআরসি’র চিঠির সঙ্গে দেওয়া একটি তালিকায় এ তথ্য জানা যায়।
এই প্রথম বিটিআরসি এতো বিপুল তথ্য সংগ্রহ করলো। নির্বাচনের আগে এমন তথ্য সংগ্রহ করার ঘটনাটি সন্দেহজনক বলে বিভিন্ন সূত্র উল্লেখ করে। এসব তথ্য ফাঁস হওয়ারও ঝুঁকি রয়েছে। তথ্য হস্তান্তরের সময় বিটিআরসি’কে তথ্য নিরাপত্তার বিষয়টিও জানায় অপারেটররা। এমনকি, একে একে সরকারের অন্য বিভাগগুলোও ভবিষ্যতে তথ্য চাইতে পারে- তেমন আশঙ্কাও ব্যক্ত করে অপারেটররা।
বিটিআরসি মোবাইল গ্রাহকদের ৩৬ ধরণের তথ্যের মধ্যে দুই ধরণের তথ্য নিয়েছে। যেমন, গ্রাহকের অবস্থান ও তাদের লিঙ্গ-ভিত্তিক পরিচয়।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে একটি মোবাইল অপারেটরের শীর্ষ কর্মকর্তা বলেন, “আমরা এসব তথ্য সুরক্ষার জন্যে বছরে কোটি কোটি টাকা খরচ করি। কিন্তু, এর ফলে বিশ্বাসভঙ্গ হলো।”
টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ আইন-২০০১ এর বরাত দিয়ে সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী এবং বিটিআরসি’র সাবেক পরামর্শক আনিক আর হক বলেন, অনুমতি ছাড়া গ্রাহকদের তথ্য সংগ্রহ করা আইনবিরোধী কাজ।
তিনি আরও বলেন, “বিআরটিসি’র দায়িত্ব হলো গ্রাহকদের প্রাইভেসি নিশ্চিত করা। তারা কোনো পরিস্থিতিতেই তা এড়িয়ে যেতে পরে না।”
তিনি জানান, শুধুমাত্র জরুরি কাজে এই তথ্য সংগ্রহ করা যেতে পারে। যেমন, এখন দেশে কোনো জাতীয় সংকট তৈরি হয়নি যে এসব তথ্য সংগ্রহ করতে হবে।
কিন্তু, বিটিআরসি’র ভাষ্য প্রয়োজনে তারা এসব তথ্য সংগ্রহ করার এবং তা সরকারকে দেওয়ার ক্ষমতা রাখে।
Comments