প্রশাসনের প্রস্তাব নির্বাচন কমিশন মানতে বাধ্য নয়
নির্বাচন কমিশন আয়োজিত আইনশৃঙ্খলা সমন্বয় সভায় প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কর্মকর্তারা গত ১৩ ডিসেম্বর যেসব প্রস্তাব দিয়েছেন সেগুলো ‘অপপ্রচার ঠেকানো ও নির্বাচন সুষ্ঠু করার স্বার্থে’ বলা হলেও সেগুলো সুষ্ঠু এবং গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের জন্যে নেতিবাচক প্রস্তাব।
এসব প্রস্তাবের মধ্যে রয়েছে ভোটকেন্দ্র থেকে টেলিভিশনে সরাসরি সম্প্রচার নিয়ন্ত্রণ, ভোটের আগে ইন্টারনেটের গতি কমানো, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম নিয়ন্ত্রণ। এসব পদক্ষেপ নেওয়া হলে নির্বাচনের স্বচ্ছতা এবং বিশ্বাসযোগ্যতা বড় ধরণের প্রশ্নের মুখে পড়বে।
প্রশাসনের পক্ষ থেকে কেনো এসব প্রস্তাব দেওয়া হচ্ছে সেটা যেমন প্রশ্ন তৈরি করে তেমনি দেখার বিষয় হচ্ছে নির্বাচন কমিশন এসব প্রস্তাব মানছে কী না। এসব প্রস্তাব কমিশনের বিবেচনায় নেওয়ার কোনও বাধ্যবাধকতা নেই। কেননা, সংবিধান অনুযায়ী কমিশনের হাতেই প্রশাসনের নিয়ন্ত্রণ থাকার কথা।
বাংলাদেশ সংবিধানের ১১৯ ধারায় অবাধ, নিরপেক্ষ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য সর্বময় ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে নির্বাচন কমিশনকে; সংবিধানের ১২০ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, ‘নির্বাচন কমিশনের ওপর ন্যস্ত দায়িত্ব পালনের জন্য যেরূপ কর্মচারীদের প্রয়োজন হইবে, নির্বাচন কমিশন অনুরোধ করিলে রাষ্ট্রপতি নির্বাচন কমিশনকে সেইরূপ কর্মচারী প্রদানের ব্যবস্থা করিবেন।’ সংবিধানের ১২৬ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, ‘নির্বাচন কমিশনের দায়িত্ব পালনে সহায়তা করা সকল নির্বাহী কর্তৃপক্ষের কর্তব্য হইবে।’ আরপিওর ৫ ধারায় আছে, ইসি যেকোনো ব্যক্তি বা কর্তৃপক্ষকে তার প্রয়োজন অনুযায়ী চাইতে পারবে।
গত কয়েক বছর ধরেই ক্ষমতাসীন দলের পক্ষ থেকে বারবার বলা হয়েছে যে, “জাতীয় নির্বাচনের সময় প্রশাসনের কর্তৃত্ব থাকবে নির্বাচন কমিশনের হাতে।” আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য মোহাম্মদ নাসিম গত ২৩ মার্চ এক জনসভায় এমনও বলেছিলেন যে, “নির্বাচনকালীন তিন মাস প্রশাসন প্রধানমন্ত্রীর কথা শুনবে না, প্রশাসন নির্বাচন কমিশনের নিয়ন্ত্রণে থাকবে।” গত ১৬ জুলাই প্রধান নির্বাচন কমিশনার এ কে নূরুল হুদা বলেছিলেন যে, “সরকার কী হবে সেটা আমাদের দেখার বিষয় নয়। নির্বাচনের সময় প্রশাসনিক নিয়ন্ত্রণ থাকবে আমাদের হাতে।”
কিন্তু, বাস্তবে তা ঘটছে বলে প্রতীয়মান হয় না। নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা থেকে শুরু করে এখন পর্যন্ত প্রশাসন বা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর আচরণের ওপরে কমিশনের কতটা প্রভাব আছে সেটা প্রশ্ন-সাপেক্ষ হয়ে পড়েছে। বিরোধীদলের প্রার্থীদের বিরুদ্ধে নতুন মামলা দিয়ে আটকের ঘটনা ঘটছে প্রতিদিনই। বিরোধীদলের একাধিক নেতার গাড়িতে হামলার খবর ছাপা হচ্ছে, কোথাও কোথাও দলীয় কার্যালয়েও হামলা হয়েছে।
অথচ, ১৩ ডিসেম্বর নির্বাচন কমিশন (ইসি) আয়োজিত আইনশৃঙ্খলা সমন্বয় সভায় এসব উপর্যুপরি হামলার বিষয় নিয়ে কার্যকর আলোচনা হয়নি। কমিশনের পক্ষ থেকে এ নিয়ে কতটা জানতে চাওয়া হয়েছে সেটা স্পষ্ট নয়। এমনকি, আজ (১৪ ডিসেম্বর) শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবসে শ্রদ্ধা জানাবার পরে বুদ্ধিজীবী স্মৃতিসৌধে ঐক্যফ্রন্টের নেতা কামাল হোসেনের গাড়িবহর হামলার শিকার হয়েছে। এসব হামলা, এমনকি, কামাল হোসেনের গাড়ি বহরে হামলার সময়েও, পুলিশ নিষ্ক্রিয় ছিলো। নির্বাচন কমিশন এসব হামলার বিষয়ে প্রশাসনকে বলার বদলে এখন প্রশাসনই কমিশনকে বলছে কী করতে হবে– অবস্থাদৃষ্টে এমন ধারণাই জন্মায়।
গণমাধ্যমের ওপরে যেসব নিয়ন্ত্রণের প্রস্তাব করা হয়েছে বা ইন্টারনেটের গতি কমানোর যে কথা বলা হচ্ছে সেগুলো নির্বাচনে স্বচ্ছতা থাকলে সমস্যা হবার কথা নয়। ২০০৮ সালের নির্বাচনে এই ধরণের পদক্ষেপ নেওয়ার প্রয়োজন হয়নি।
মনে রাখা দরকার যে, তথ্যের অবাধ প্রবাহ নিয়ন্ত্রিত হলেই গুজব ছড়ানোর সুযোগ থাকে। সমন্বয় কমিটির ঐ বৈঠকে কোনো কোনো কর্মকর্তা এই আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন যে, কেউ ভোট কেন্দ্রের ভিডিও সম্পাদনা করে ফেসবুকে ছড়িয়ে দিতে পারেন যাতে করে ‘ভুল তথ্য প্রচার হয়ে অপ্রীতিকর পরিস্থিতি তৈরি’ হওয়ার আশঙ্কা থাকে। ইসির সচিব হেলালুদ্দিন আহমেদ সাংবাদিকদের বলেছেন যে, “সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভোটের সময় অনেক ভুয়া খবর দেওয়া হয়, অপব্যবহার করা হয়। তাই ভোটের সময় এটা নিয়ন্ত্রণের কথা ভাবা হচ্ছে।” কিন্তু, এই ধরণের যুক্তি গ্রহণযোগ্য বলে মনে হয় না। এই ধরণের পরিস্থিতি মোকাবেলার সবচেয়ে কার্যকর এবং গ্রহণযোগ্য উপায় হচ্ছে সব ধরনের গণমাধ্যমকে সরাসরি প্রচারে বাধা না দেওয়া। কেউ ভুল তথ্য প্রচার করলে গণমাধ্যমগুলো সাথেই সাথেই প্রকৃত চিত্র তুলে ধরে বিভ্রান্তি দূর করতে সক্ষম হবে। সামাজিক এবং গণমাধ্যমের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে এসব কথাবার্তার আরেকটি দিক হচ্ছে- তাতে করে ভোটারদের মনে আস্থার ঘাটতি তৈরি হবে। যত আস্থা কমবে ভোটারদের সংখ্যাও হ্রাস পাওয়ার আশঙ্কা ততই বৃদ্ধি পাবে। ভোটারদের কেন্দ্রে আসতে উৎসাহী করতে চাইলে এ ধরণের পদক্ষেপের প্রস্তাবে সায় না দেওয়াই হবে কমিশনের যথাযথ ভূমিকা।
Comments