বরইতলা বধ্যভূমি: বিচারের আশায় ৩৬৫ শহীদ পরিবার

১৯৭১ সালে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ও এদেশীয়দের সহযোগিতায় পরিকল্পিত গণহত্যা ও নির্যাতন শুরু করে প্রথম থেকেই। যার মাধ্যমে তারা বাঙালি জাতীয়তাবাদী আন্দোলনকে দমন করতে চেয়েছিল। তাদের আসল উদ্দেশ্য ছিলো ২৬ মার্চের মধ্যে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের সব বড় শহর দখল করে নেওয়া এবং রাজনৈতিক ও সামরিক বিরোধীদের এক মাসের ভেতর নিশ্চিহ্ন করে দেওয়া।
Kishoreganj slaughter ground
কিশোরগঞ্জ সদর উপজেলার যশোদল ইউনিয়নের বরইতলায় গণহত্যায় নিহতদের স্মরণে নির্মিত স্মৃতিস্তম্ভ (ডানে) এবং শহিদদের নাম খচিত বেদি (বামে)। ছবি: ইমরান মাহফুজ

১৯৭১ সালে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ও এদেশীয়দের সহযোগিতায় পরিকল্পিত গণহত্যা ও নির্যাতন শুরু করে প্রথম থেকেই। যার মাধ্যমে তারা বাঙালি জাতীয়তাবাদী আন্দোলনকে দমন করতে চেয়েছিল। তাদের আসল উদ্দেশ্য ছিলো ২৬ মার্চের মধ্যে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের সব বড় শহর দখল করে নেওয়া এবং রাজনৈতিক ও সামরিক বিরোধীদের এক মাসের ভেতর নিশ্চিহ্ন করে দেওয়া।

বাঙালির সবচেয়ে গৌরবময় ইতিহাস ১৯৭১। আর এই ৭১-এর সবচেয়ে বেদনাদায়ক স্মৃতি হলো পাকিস্তানি সেনাদের বর্বরোচিত, পৈশাচিক গণহত্যা। পাকিস্তানি সেনা ও তাদের এদেশীয় দোসরদের অনেক নির্মমতা-নৃশংসতাই আমাদের এখনো অজানা। দেশের বিভিন্ন জনপদ ঘুরে নিবিড় অনুসন্ধানের মাধ্যমে গণহত্যার নানা ঘটনা লিপিবদ্ধ করেছেন স্বাধীনতা পদকপ্রাপ্ত লে. কর্নেল (অব.) কাজী সাজ্জাদ আলী জহির (বীরপ্রতীক)। সেই সাথে ‘দেশটাকে ভালোবেসে’ এই শিরোনামে একটি ধারাবাহিক গবেষণা অনুষ্ঠানও করে থাকেন তিনি।

এমনই একটি বধ্যভূমি কিশোরগঞ্জের সদর উপজেলার ‘বরইতলা বধ্যভূমি’। ১৯৭১ সালের ১৩ই অক্টোবর আশপাশের বিভিন্ন গ্রাম থেকে মোট ৩৬৫ জন নিরীহ গ্রামবাসীকে ধরে এখানে এনে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। বরইতলা কিশোরগঞ্জ জেলা সদরের যশোদল ইউনিয়নের অন্তর্ভুক্ত। কিশোরগঞ্জ সদর থানার সবচেয়ে বড়ো বধ্যভূমি হিসেবে বরইতলা স্থানীয় ইতিহাসে উল্লেখিত।

মোহাম্মদ সাইদুর ও মোহাম্মদ আলী খান সম্পাদিত ‘কিশোরগঞ্জের ইতিহাস’ ও জাহাঙ্গীর আলম জাহান রচিত ‘রক্তে ভেজা কিশোরগঞ্জ’ গ্রন্থে বরইতলা গণহত্যা সম্পর্কে কিছুটা তথ্যবিভ্রাট ছিলো। পরবর্তীকালে জাহাঙ্গীর আলম জাহান রচিত ‘মুক্তিযুদ্ধে কিশোরগঞ্জের ইতিহাস’ গ্রন্থে সঠিক তথ্য নিয়ে প্রকাশ করা হয়েছে।

১৯৭১ সালের ১৩ই অক্টোবর (১৩৭৮ সনের ২৮শে আশ্বিন), বুধবার। দুপুর প্রায় আড়াইটার সময় কালো পোশাক পরিহিত প্রায় ২০ জন পাকিস্তানি সৈন্য ও খাকি পোশাক পরিহিত আরও প্রায় ২০ জন রাজাকার তিন-বগি সংবলিত একটি বিশেষ ট্রেনে করে কিশোরগঞ্জ থেকে যশোদল রেল স্টেশন পার হয়ে বরইতলায় এসে থামে। পাকিস্তানি সৈন্য ও রাজাকাররা ট্রেন থেকে নেমে বরইতলার পাশের গ্রাম দামপাড়ায় প্রবেশ করে হাফেজ আবদুল তৌহিদের বাড়িসহ গ্রামের অন্যান্য বাড়িঘরে নির্বিচারে অগ্নিসংযোগ করতে থাকে। গ্রামের গুরুদয়াল নমদাশ, কডু নমদাশ, ডেঙ্গু নমদাশ ও আবদুল খালেকের পুত্র আবদুল মান্নানকে হত্যা করে তারা।

পাকিস্তান সেনাবাহিনী কর্তৃক সংঘটিত গণহত্যায় সন্ত্রস্ত হয়ে দামপাড়া, চিকনীরচর, কালিকাবাড়ি, তিলকনাথপুর, গোবিন্দপুর এবং আরও কয়েকটি গ্রামের প্রায় শ’পাঁচেক নিরীহ গ্রামবাসী তাদের বাড়িঘর ছেড়ে কিশোরগঞ্জের আজিমউদ্দিন উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষক মো. আজিজুল হকের বাড়ি সংলগ্ন নরসুন্দা নদীর বাঁকে একটি আখ ক্ষেতে আশ্রয় নেন। কিন্তু, পাকিস্তান সেনাবাহিনী ও রাজাকাররা সেখান থেকেও তাদেরকে ধরে এনে বরইতলা সংলগ্ন রেললাইনের পাশে জড়ো করে।

ইতোমধ্যে দল থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে একজন পাকিস্তানি সৈন্য লুটপাটের উদ্দেশ্যে গ্রামে প্রবেশ করে বাড়িঘর থেকে স্বর্ণালংকার, টাকাপয়সা লুট করে জিনারাই গ্রাম হয়ে শহরতলির মণিপুরঘাট এলাকা দিয়ে কিশোরগঞ্জ শহরে চলে আসে। দল থেকে বিচ্যুতির বিষয়টি পাকিস্তান সেনাবাহিনী বা রাজাকার কেউই জানত না। হঠাৎ দলে নিজেদের লোক কম দেখে তারা চিন্তিত হয়ে নিখোঁজ সদস্যকে খুঁজতে থাকে।

কিন্তু, চিকনীরচর গ্রামের রাজাকার আ. হাশিম পাকিস্তানি সৈন্যদেরকে জানায় যে, পার্শ্ববর্তী গ্রামের জনগণ একজন পাকিস্তানি সৈন্যকে হত্যা করেছে। এটা শুনেই পাকিস্তানি সৈন্যরা সংবাদের সত্যতা যাচাই না করে বরইতলার সমবেত অসহায় ও সন্ত্রস্ত গ্রামবাসীদেরকে বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে, লোহার শাবল দিয়ে পিটিয়ে ও গুলি করে নির্মমভাবে হত্যা করে।

কয়েকজন গ্রামবাসী নামাজ পড়ার অনুমতি নিয়ে পার্শ্ববর্তী মসজিদে আশ্রয় নেন এবং সৌভাগ্যক্রমে এখনও বেঁচে আছেন অনেকে। অনেকে আজও বয়ে বেড়াচ্ছেন নৃশংস নির্যাতনের চিহ্ন। কান্না থামছে না শহীদদের স্বজনদের।

একাত্তরে মানবতাবিরোধী অপরাধে জড়িত যুদ্ধাপরাধীদের বিচার শেষ হয়নি। বরইতলা হত্যাকাণ্ডে স্বজনহারা শত শত পরিবার এখনও মানবেতর জীবন-যাপন করছেন। তাদের খবর রাখে না কেউ। এখনও মিলেনি শহীদ পরিবারের মর্যাদা।

কিশোরগঞ্জ জেলা সদর থেকে প্রায় চার কিলোমিটার দক্ষিণ-পূর্ব দিকে চলে গেছে কিশোরগঞ্জ-নিকলী সড়ক। এ সড়কের পাশেই বড়ইতলা ময়দান। বড়ইতলার পাশেই মুক্তিযুদ্ধকালীন অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলামের বাড়ি। ফলে হানাদার ও রাজাকারদের শ্যেন দৃষ্টি পড়ে এলাকাটির উপর।

১৩ অক্টোবর স্থানীয় রাজাকাররা এখানে চালায় নির্মম গণহত্যা। প্রায় চারশ গ্রামবাসীকে তারা প্রথমে বরইতলা মাঠে জমায়েত করে। পরে প্রত্যেককে হাত-পা বেঁধে নির্মমভাবে হত্যা করে। তাদের কয়েকজন নামাজ পড়ার ওসিলায় স্থানীয় মসজিদে গিয়ে রক্ষা পান। এই মসজিদটি কালের সাক্ষী হয়ে আজও দাঁড়িয়ে রয়েছে।

সে সময় আব্দুল আজিজ কিশোরগঞ্জ শহরের আজিম উদ্দিন উচ্চ বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক ছিলেন। বর্তমানে তিনি বয়সের ভারে নুয়ে পড়েছেন। কিন্তু, সেদিনের বর্বরোচিত ঘটনার প্রসঙ্গ উঠতেই লাল হয়ে উঠে তার চোখ। যেনো আগুন ঝরে তাঁর দুচোখ দিয়ে। শহরে থাকায় তিনি প্রাণে বেঁচে গেলেও হারাতে হয়েছে তার ভাই, চাচাসহ পরিবারের চারজনকে।

আবদুল আজিজ জানান, সেদিন সারা এলাকায় যেনো কিয়ামত নেমে আসে। লাশ দাফন করার মতো কেউ ছিলো না। মিলিশিয়া আর রাজাকারের ভয়ে অনেকে নদীতে স্বজনের মরদেহ ভাসিয়ে দিতে বাধ্য হয়েছিলেন। নিজের চোখে ২৫/৩০টি লাশ নরসুন্দা নদীতে ভাসতে দেখেছি- বলেন এ সাবেক শিক্ষক।

এ রকম অসংখ্য শহীদ পরিবারের ভয়াল স্মৃতি বেদনাগাঁথা মিশে আছে কর্ষাকড়িয়াইল ইউনিয়নের কয়েকটি গ্রামের ঘরে ঘরে। বিনা অপরাধে শত শত গ্রামবাসীকে নৃশংসভাবে হত্যার ক্ষত ভুলতে পারছেন না তাদের স্বজনেরা।

জানা যায় যে, বরইতলার এই গণহত্যায় মোট ৩৬৫ জন গ্রামবাসী শহিদ হন। সেদিন যারা শহিদ হয়েছিলেন তাদের সকলের নাম-ঠিকানা সংগ্রহ করা সম্ভব হয়নি। অনেকের লাশ তাদের আত্মীয়স্বজনরা ধর্মীয় বিধি মোতাবেক দাফনও করতে পারেননি। কেননা, এতোগুলো পুরুষ শহিদ হওয়ার পর গ্রামটি প্রায় পুরুষশূন্য হয়ে পড়ে। তাই দাফন করার মতো মানুষ ছিলো না বললেই চলে। পাকিস্তান সেনাবাহিনী ও রাজাকারদের হুমকির ভয়ে শহিদদের আত্মীয়স্বজনরা এলাকা ত্যাগ করেন। অসংখ্য লাশ সেখানে পড়ে ছিলো। নরসুন্দা নদীতে অনেক লাশ ভেসে যায়। তাছাড়াও নদীর তীরের আখ ক্ষেতে পড়ে থাকা আরও অনেক লাশ শেয়াল-কুকুর ভক্ষণ করে। ইতিহাসের সাক্ষী হিসেবে নরসুন্দা নদীর পানি এখনো বয়ে চলেছে।

স্বাধীনতার পর এলাকাবাসী শহিদদের স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে বরইতলা গ্রামের নাম পরিবর্তন করে শহিদনগর এবং বধ্যভূমির পাশে একটি স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ করেন। পরবর্তীকালে সেখানে শহিদদের নাম-ঠিকানাসংবলিত দৃষ্টিনন্দন একটি স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ করা হয়।

Comments

The Daily Star  | English

Abu sayed’s death in police firing: Cops’ FIR runs counter to known facts

Video footage shows police shooting at Begum Rokeya University student Abu Sayed, who posed no physical threat to the law enforcers, during the quota reform protest near the campus on July 16. He died soon afterwards.

9h ago