হীনমন্যতা, নায়ক ও হিরো আলম

আমেরিকার কোন রাষ্ট্রপতি প্রথম জীবনে বাদাম বিক্রি করতেন, তা নিয়ে বাঙালি মানসিকতায় গর্বের শেষ নেই। নরেন্দ্র মোদি চা বিক্রি করতেন, তাও তাদের কাছে গর্বের। নায়ক রাজ্জাকের এই ঢাকা নগরে থাকার জায়গা ছিল না, তা নিয়ে চলচ্চিত্র অঙ্গনের সবাইকে গর্ব করতে দেখা যায়। সমস্যা সিডি বা ডিশ ব্যবসায়ী হিরো আলমের ক্ষেত্রে। তিনি কেন মিউজিক ভিডিও বানাবেন, নিজেকে হিরো হিসেবে দাবি করবেন? তিনি কেন সংসদ নির্বাচনে প্রার্থী হবেন?

তাকে নিয়ে হইচই, আলোচনা, সমালোচনা। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম, গণমাধ্যম সর্বত্র। বলছি হিরো আলমের কথা।

কিন্তু তাকে নিয়ে কিছু লিখিনি, বলিনি। বলতে বা লিখতে চাচ্ছিলামও না। ইদানীং অবশ্য অনেক বিষয় নিয়েই বলি না বা লিখি না। দেখি আর ভাবি, লিখব, কি লিখব না? লেখা ঠিক হবে কি না? আজ ইচ্ছে হলো হিরো আলমের মধ্য দিয়ে আমাদের চারপাশটা আরেকবার দেখার।

১.

ধারণা করি সবাই জানেন, তারপরও দু’একটি তথ্য। আশরাফুল আলম সাঈদ বগুড়ার এক দরিদ্র পরিবারের সন্তান। সপ্তম শ্রেণি পর্যন্ত পড়াশোনা করা আশরাফুল আলম সাঈদ সিডি ব্যবসা, ডিশ ব্যবসার এক পর্যায়ে মিউজিক ভিডিও বানিয়ে হয়ে উঠেছেন হিরো আলম। নিজের বানানো মিউজিক ভিডিওতে নিজেই হিরো, হিরো আলম।

সদ্য অনুষ্ঠিত একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে প্রার্থী হয়েছিলেন হিরো আলম। এই সমাজে নিজেদের যারা হর্তাকর্তা বলে মনে করেন, তারা বিষয়টি স্বাভাবিকভাবে নিতে পারলেন না। কোনো কোনো গণমাধ্যমও সরাসরি তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করতে শুরু করল, অমুকে তো জনপ্রিয়, আপনিও কেন তার মতো নির্বাচনে এলেন? নাম কেন হিরো আলম? ইসি সচিব বললেন ‘হিরো আলমও...’।

এসব প্রশ্নের অত্যন্ত বুদ্ধিদীপ্ত জবাব দিতে দেখা গেল হিরো আলমকে।

নির্বাচনে আরও অনেকে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছেন। কিন্তু সকল রসিকতা, তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য কেন শুধু হিরো আলমকে নিয়ে হলো?

প্রচলিত অর্থে নায়ক বলতে যা বোঝায়, বাহ্যিকভাবে হিরো আলম তেমন নয়। তিনি বগুড়ার আঞ্চলিক ভাষায় কথা বলেন। চোখের সান গ্লাসটি দামি নয়। বর্তমান সময়ের সঙ্গে মানানসই নয় তার চুলের স্টাইল, পোশাক। তাকে নিয়ে রসিকতা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ছাড়িয়ে মূলধারার গণমাধ্যমেও স্থান করে নিতে দেখা গেছে।

২.

প্রাক্তন বা বর্তমান কৃষকের সন্তানরা শহরে এসে সভ্য- সংস্কৃতিবান, আধুনিক হয়ে উঠেছেন। ধুয়ে-মুছে ফেলতে চাইছেন শেকড়। গ্রামীণ আঞ্চলিক ভাষায় কথা বলাকে অসম্মানজনক ভাবতে শিখেছেন।

এমন মানসিকতার কারণ মূলত দুটি হতে পারে। প্রথম কারণ, অন্তরের ভেতরে বিরাজ করছে শ্রেণিগত বিভাজন। শহরে এসে ভাবছেন শ্রেণিগত উত্তরণ ঘটিয়েছেন।

দ্বিতীয় কারণ, হীনম্মন্যতাবোধ। ইতিহাস-ঐতিহ্য আড়াল বা অস্বীকার করার সঙ্গে সম্পর্ক আছে হীনম্মন্যতাবোধের।

শ্রেণিগত বিভাজনের কারণে হিরো আলমকে ‘হিরো’ ‘নায়ক’ হিসেবে মেনে নিতে কষ্ট হচ্ছে। তাদের কাছে বগুড়ার আঞ্চলিক ভাষায় কথা বলাটা ‘হাসির উপাদান’। তারা নোয়াখালী বা বরিশালের আঞ্চলিক ভাষায় কথা বললে, তার মধ্যেও হাসির উপাদান খুঁজে পান। তারাই আবার কুমার বিশ্বজিত বা তামিম ইকবাল যখন চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ভাষায় কথা বলেন, মুগ্ধ হয়ে মুখের দিকে তাকিয়ে থাকেন। কী বললেন, তা বোঝার চেষ্টা করেন। কুমার বিশ্বজিত বা তামিম ইকবালদের শ্রেণিগত অবস্থানের কারণে কেউ তাদেরকে নিয়ে রসিকতা করার সাহস দেখাতে পারেন না। যারা প্রতিনিয়ত রসিকতা করেন, হিরো আলমের আঞ্চলিক ভাষা নিয়ে। প্রতিটি আঞ্চলিক ভাষা যে, ভাষার প্রকৃত সৌন্দর্য, ভাসমান সংস্কৃতির ধারকদের ভেতরে তা গড়ে ওঠে না।

আমেরিকার কোন রাষ্ট্রপতি প্রথম জীবনে বাদাম বিক্রি করতেন, তা নিয়ে বাঙালি মানসিকতায় গর্বের শেষ নেই। নরেন্দ্র মোদি চা বিক্রি করতেন, তাও তাদের কাছে গর্বের। নায়ক রাজ্জাকের এই ঢাকা নগরে থাকার জায়গা ছিল না, তা নিয়ে চলচ্চিত্র অঙ্গনের সবাইকে গর্ব করতে দেখা যায়। সমস্যা সিডি বা ডিশ ব্যবসায়ী হিরো আলমের ক্ষেত্রে। তিনি কেন মিউজিক ভিডিও বানাবেন, নিজেকে হিরো হিসেবে দাবি করবেন? তিনি কেন সংসদ নির্বাচনে প্রার্থী হবেন?

৩.

হিরো আলমের যেসব মিউজিক ভিডিও ইউটিউবে আছে, সেগুলো নিয়ে সমালোচনার নানা দিক নিশ্চয়ই আছে। ক্যামেরার কাজ মানসম্পন্ন নয়। হিরো আলম ও তার নায়িকাদের অভিনয়, অঙ্গভঙ্গি অনেক ক্ষেত্রে দৃষ্টিকটু। কোনো বিবেচনাতেই তা মানসম্পন্ন শিল্প হয়ে ওঠেনি।

তা নিয়ে সমালোচনা অবশ্যই হতে পারে। সেই সমালোচনায় এই প্রশ্নও আসতে হবে, দায় কি শুধু হিরো আলমের না এই সমাজেরও?

মূলধারার সাংস্কৃতিক অঙ্গন, চলচ্চিত্র অঙ্গনের যারা মোড়ল, এক্ষেত্রে তাদের দায় কতটা?

‘যাত্রা’র মতো একটি শিল্পকে যে অশ্লীলতার মঞ্চ বানিয়ে প্রায় বিলুপ্ত করে দেয়া হলো, তার দায় তো হিরো আলমদের নয়।

দায় কার, কাদের?

মাঝের একটি লম্বা সময় বাংলা সিনেমায় যে অশ্লীলতার আমদানি করা হলো, সেই দায়ও তো হিরো আলমদের নয়।

দায় কার, কাদের?

হিরো আলমের সামান্য বাজেটের মিউজিক ভিডিও আর বাংলা সিনেমার মানে কী খুব বেশি পার্থক্য আছে? হিরো আলমের নাচ আর বাংলা সিনেমার নায়কের নাচের তুলনামূলক আলোচনায়, হয়ত হিরো আলম পিছিয়ে থাকবেন। কিন্তু খুব বেশি কি পিছিয়ে থাকবেন?

একজন নায়কের সিনেমা ছাড়া, অন্য কারো সিনেমা মানুষ দেখেন না কেন?

দর্শক সিনেমা হলে যাওয়া বন্ধ করে দিয়েছেন। হলগুলো একে একে বন্ধ হয়ে গেছে।

দায় কার, কাদের?

এক সময় কলকাতার দর্শক বাংলাদেশের টেলিভিশন নাটক দেখতেন, দেখার চেষ্টা করতেন। এখন যে বাংলাদেশের মানুষ, বাংলাদেশের টেলিভিশনের নাটক-সিনেমা দেখেন না, কারণ কী? টেলিভিশনের নাটক-সিনেমায় তো হিরো আলমদের দেখায় না।

৪.

টেলিভিশন বা সিনেমার পর্দায় যার চরিত্র যেমন থাকে, তার ভিত্তিতে মানুষ নায়ক বা ভিলেন বা কৌতুক অভিনেতাকে বেছে নেয়। হিরো বা নায়ক সব সময় নীতি-নৈতিকতা ধারণ করেন। ন্যায় ও সত্যের পথে থাকেন। দর্শক ভিলেনের পরাজয় প্রত্যাশা করেন। কৌতুক অভিনেতারা মানুষের হাসির উপাদান যোগান দেন। নায়ক বা হিরোর সঙ্গে থাকেন, ন্যায় ও সত্যের পক্ষে থাকেন।

পর্দার চরিত্রের প্রতিবাদী নায়ককে দর্শক বাস্তব জীবনেও ন্যায় ও সত্যের পক্ষে প্রতিবাদী চরিত্রেই দেখতে চান।

হিরো আলমকে নিয়ে যারা রসিকতা করছেন, আপনারা কি একটু ভেবে দেখবেন আপনাদের নায়কদের কারও কারও বর্তমান ভূমিকা কেমন?

নির্বাচনে যা ঘটেছে-আপনি যা দেখেছেন, মাঠে-ঘাটে ঘোরা আপনাদের নায়করা কি তা দেখছেন?

তারা যা বলছেন, আপনি হয়ত তা বিশ্বাস করতে পারছেন না। কারণ আপনি দেখেছেন, তারা যা দেখেছেন বলে বলছেন তার উল্টোটা। সিনেমায় ভিলেন থাকেন বিত্তবান বা বিত্তবানের সন্তান। অর্থ ও সামাজিক প্রভাবে অন্যায়- অপকর্ম করেন ভিলেন। অবস্থান করেন অসত্য ও নীতিহীনতার পক্ষে। নায়করা তো কখনো অসত্য বা অন্যায় বা অনৈতিকতার পক্ষে অবস্থান নেন না, নিতে পারেন না। তাহলে তিনি আর নায়ক থাকতে পারেন না।

কে কি করছেন, একটু নির্মোহভাবে ভেবে দেখুন তো!

হিরো আলম নোয়াখালীর সুবর্ণচরে নিপীড়িত নারীর পাশে গিয়ে দাঁড়িয়েছেন। দেখেছেন, আপনাদের কোনো নায়ককে যেতে?

বলতেই পারেন, এটা হিরো আলমের লোক দেখানো ব্যাপার।

হতে পারে। তাহলে এও হতে পারে, আরও অনেকের অনেক কিছু লোক দেখানো ব্যাপার।

বর্তমান সময়ের প্রেক্ষিতে বিচার করুন তো, কে সত্য বলছেন? হিরো আলম, না আপনাদের নায়কেরা? সত্য বলে, অন্যায়ের প্রতিবাদ করে নিপীড়িত হচ্ছেন হিরো আলম। সিনেমার নায়কদের ক্ষেত্রে তো এমনটাই ঘটে। রাস্তা-ঘাটে ছুটে বেড়াতে দেখা কোনো নায়ককে অন্যায় বা অসত্যের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করতে দেখছেন?

একথা সত্যি যে হিরো আলমের যে কাজ, তা এত আলোচনার দাবি রাখে না। আলোচিত হওয়ার মত উল্লেখযোগ্য কাজ তিনি করেননি। তাহলে প্রশ্ন আসতে পারে, তাকে নিয়ে এই লেখাই বা কেন? কারণ হিরো আলম বাংলাদেশের একজন মানুষ। স্বাধীনভাবে কাজ করার অধিকার তার আছে। আছে রাজনীতি করার বা যেকোনো নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার অধিকার। ক্ষমতার দাম্ভিকতায় তাকে অপমান, অসম্মান বা নিপীড়ন করার অধিকার কারো নেই। হিরো আলমকে ছোট করতে গেলে, তার কাছে নিজেরা ছোট হয়ে যেতে হয়।

Comments

The Daily Star  | English

Fire breaks out at shoe factory in Ctg

A fire broke out at a factory that produces shoe accessories on Bayezid Bostami Road in Chattogram city this afternoon

10m ago