‘আহমদ শফী যা বলেছেন, সেটা সম্পূর্ণভাবে সংবিধানবিরোধী’
![](https://tds-images-bn.thedailystar.net/sites/default/files/styles/big_202/public/feature/images/sultana-arefin-ayesha.jpg?itok=lOoq8gWT×tamp=1547287325)
হেফাজতে ইসলামের আমির শাহ আহমদ শফী মেয়েদের স্কুল-কলেজে না পাঠানোর জন্য ওয়াদা নিয়েছেন। আর পাঠালেও চতুর্থ কিংবা পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত পড়ানোর কথা বলেছেন। শিশুদের শিক্ষার অধিকার ও নারীর উন্নয়ন নিয়ে বাংলাদেশের সংবিধানের যে অঙ্গীকার সরাসরি তার বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছেন চট্টগ্রামের হাটহাজারীর দারুল উলুম মঈনুল ইসলাম মাদ্রাসার মহাপরিচালক।
এ ব্যাপারে আজ শনিবার দ্য ডেইলি স্টার অনলাইনকে প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন তত্তাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা ও মানবাধিকারকর্মী সুলতানা কামাল, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক ড. আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক ও বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের সভাপতি আয়েশা খানম।
সুলতানা কামাল তার প্রতিক্রিয়ায় বলেন, “হেফাজতে ইসলামের আমির আহমদ শফী যা বলেছেন সেটা সম্পূর্ণভাবে সংবিধানবিরোধী এবং নারীর ক্ষমতায়নে এই সরকারের যে অঙ্গীকার রয়েছে, সেটার প্রতিও সরাসরি চ্যালেঞ্জ। এখন সরকারেরই উচিত এই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করা। এর উত্তর দেওয়ার দায়িত্ব সম্পূর্ণভাবে সরকারের ওপর নির্ভর করে।”
হেফাজতে ইসলামের সঙ্গে সরকারের সুসম্পর্ক ও তাদের দাবি পূরণ করার বিষয়ে জানতে চাইলে সুলতানা কামাল বলেন, “সরকার আমাদের কাছে অঙ্গিকার করেছে নারীর ক্ষমতায়ন করবে। আমাদের সংবিধানেও সেটা রয়েছে অতএব এখন সরকারেরই দায়িত্ব এটার মোকাবিলা করা এবং কেউ সংবিধানবিরোধী-মানবাধিকারবিরোধী আচরণ করলে তার প্রতি রাষ্ট্রের যে দায় সেটা যেন রাষ্ট্র কার্যকর করে।”
“সরকার নিরঙ্কুশ ক্ষমতা নিয়ে রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব পেল, তাদের যে ইশতেহার সেটার বিরোধী বক্তব্য দিয়েছেন আহমদ শফী। আমি মনে করি, কেউ যদি সংবিধান বিরোধী কোনো কথা বলে সেক্ষেত্রে রাষ্ট্রের যে নীতিমালা রয়েছে সেই অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়ার দায়িত্বও রাষ্ট্রের ওপর বর্তায়”- যোগ করেন সুলতানা কামাল।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক ড. আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক বলেন, ‘আজকের একবিংশ শতাব্দীতে এসে কোনো মানুষ এ ধরনের কথা বলতে পারেন সেটাই আমার কাছে অবিশ্বাস্য মনে হচ্ছে। যেখানে আমরা নারীর অধিকার সমুন্নত রাখা, নারীর ক্ষমতায়নের মাধ্যমে প্রতিযোগিতামূলক বিশ্বের সঙ্গে এগিয়ে যাওয়া, নারী শিক্ষায় যত ধরনের সম্প্রসারণ ঘটানো যায় সেদিকে চেষ্টা করে চলেছি, সেখানে এদেশের কোনো ধর্মীয় নেতা এভাবে নারীদের অবরুদ্ধ করার কথা বলবে-তাদের যে মৌলিক ও সাংবিধানিক অধিকার রয়েছে সেটা থেকে তাকে বঞ্চিত রাখার কথা বলবে, এটা আমরা বুঝতে পারি না।’
এক্ষেত্রে সংবিধানের অঙ্গিকার সমুন্নত রাখতে সরকারের কী ভূমিকা রাখা উচিত বলে মনে করেন- জানতে চাইলে অধ্যাপক আরেফিন বলেন, ‘শিশু ছেলে না মেয়ে সেটা তো কোনো বিষয় না। সংবিধান নারী পুরুষ লিঙ্গ নির্বিশেষে শিক্ষার অধিকার দিয়েছে। সেই অধিকার রক্ষা কারার দায়িত্ব এখন সরকারের।
“কোনো ধর্মেই মানুষকে অশিক্ষিত রাখার কথা বলা হয়নি” উল্লেখ করে তিনি বলেন, “এ ধরনের বক্তব্যে কোনো শিশু যেন ক্ষতিগ্রস্ত না হয়, কোনো পরিবার যেন প্রভাবিত না হয় সেটা সরকারকে দেখতে হবে- আমাদের লক্ষ্য রাখতে হবে।”
“ইসলাম ধর্মে নারীদের শুধু শিক্ষাই নয়, সমানাধিকারের ওপরও গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে। ইসলামের গৌরবময় ইতিহাস বিস্মৃত হয়ে কূপমণ্ডূকতার দিকে দেশকে টেনে নিয়ে যাওয়ার এই চেষ্টা খুবই দুঃখজনক,” যোগ করেন তিনি।
বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের প্রতিষ্ঠাতা সহ-সাধারণ সম্পাদক ও বর্তমান সভাপতি আয়েশা খানম বলেন, “১৯৭৫ সালের পর থেকে গত সাড়ে তিন দশকে সামরিক সরকার, স্বৈরতান্ত্রিক সরকার, এমনকি নির্বাচিত সরকার যারা গণতান্ত্রিকভাবে অঙ্গীকারবদ্ধ তারাও নানা সমীকরণ, নানা কৌশল ও যুক্তিতে এ ধরনের ধর্মকে ব্যবহারকারী গোষ্ঠীগুলোকে আশ্রয়-প্রশ্রয় দিয়ে আসছে।”
“সরকারিভাবে এরা পৃষ্ঠপোষকতা পাচ্ছে”- অভিযোগ করে তিনি বলেন, “এটা শুধু আমাদের নারী সমাজ না, সকলের জন্যই দুর্ভাগ্যজনক। সরকারের উন্নয়নমুখী কর্মকাণ্ড ও অর্থনৈতিক বিকাশের সঙ্গে সঙ্গে আমাদের সামাজিক অগ্রগতি হচ্ছে না। পাঠ্যসূচি থেকে শুরু করে সর্বত্র আমরা এ বিষয়গুলো লক্ষ্য করছি।”
“হেফাজতের আস্ফালন আমরা কয়েক বছর আগে দেখলাম। আহমদ শফী নারীদের সম্পর্কে যে মন্তব্যগুলো করেছিলেন সেটি মধ্যযুগীয় ও পশ্চাৎপদ সমাজের কথা। এ ধরনের স্থূল, অশ্লীল ও নিম্নরুচির বক্তব্য তিনি দিয়ে যাচ্ছেন। নারী সমাজ তখন সমাবেশ করে এর প্রতিবাদ জানিয়েছে”-বলেন আয়েশা খানম।
তিনি বলেন, “সরকারের জাতীয় নারী উন্নয়ন নীতি, রাষ্ট্রীয় কর্মপরিকল্পনা, নারী শিক্ষায় অগ্রগতি, নারীর ক্ষমতায়নে অগ্রগতি তার সঙ্গে আহমদ শফীর এই বক্তব্য কতটুকু সামঞ্জস্যপূর্ণ সে ব্যাপারে আমি দেশের সকল রাজনৈতিক দল, বুদ্ধিজীবী সমাজ ও সর্বোপরী সরকারের কাছে জানতে চাই।বেগম রোকেয়া সাখাওয়াত, সুফিয়া কামাল থেকে শুরু করে পাকিস্তানি আমলেও আমাদেরকে এই ধরনের শক্তির সঙ্গে লড়াই করতে হয়েছে। সে কারণেই এখন আমাদের মেয়েরা ফুটবল খেলা থেকে শুরু করে সমাজের সর্বস্তরে তাদের অগ্রগতি অর্জন সম্ভব হয়েছে। এখানে বিশাল একটা আন্দোলনের ইতিহাস আছে। বর্তমান শিক্ষামন্ত্রী ডা. দিপু মনিকে আমি অভিবাদন জানিয়েই জানতে চাই, তারা কি ফোর-ফাইভ পর্যন্ত পড়িয়েই মেয়েদের ভেতরে ঢোকানোর সিদ্ধান্ত নিবেন? না হলে কোন শক্তি-সাহসের ওপর ভর করে তিনি এ ধরনের অত্যন্ত নেতিবাচক একটি মন্তব্য করতে পারেন?”
“আমার প্রশ্ন সরকারের কাছে, তারা এ ধরনের উক্তিকে কিভাবে দেখছেন, সেটাই আমি জানতে চাই। কারণ আমাদের প্রতিক্রিয়া সরকারের-দেশবাসীর জানা আছে।… যদি বিশাল জনগোষ্ঠীকে প্রতিনিয়ত তারা (হেফাজতে ইসলাম) এটা বোঝায়, তাহলে তাদের সঙ্গে সরকারের কী ধরনের রাজনৈতিক মৈত্রী বন্ধন থাকবে সেটাও আমাদের বোঝা দরকার।”- বলেন আয়েশা খানম।
আহমদ শফীর এই বক্তব্যের বিরুদ্ধে মহিলা পরিষদ কী অবস্থান নিচ্ছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, “সরকারের প্রতিক্রিয়া কী হয় সেটা আমরা জানতে চাই। আমরা বিস্ময়করভাবে লক্ষ্য করছি তাদের দাবিগুলোই মেনে নেওয়া হচ্ছে। পাঠ্যসূচির ক্ষেত্রেও তো সেটাই হয়েছে। সুতরাং আমরা সেজন্যই সরকারের কাছে জানতে চাই।”
উল্লেখ্য, ইতিপূর্বে হেফাজতে ইসলামের দাবি অনুযায়ী পাঠ্য পুস্তক পরিবর্তন করে একটা সাম্প্রদায়িক রূপ দেওয়া হয়েছে। অভিযোগ আছে, লেখক- শিক্ষক- বুদ্ধিজীবী- নারী নেতৃবৃন্দের পক্ষ থেকে জোরালো প্রতিবাদী অবস্থান নিতে দেখা যায়নি। সরকারের সঙ্গে হেফাজতের সুসম্পর্ক দৃশ্যমান হয়েছে। কওমি সনদকে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে সম্পূর্ণরূপে হেফাজতের শর্ত মেনে। প্রধানমন্ত্রীকে সংবর্ধনা দিয়ে ‘কওমী জননী’ উপাধী দিয়েছে হেফাজত মাওলানা আহমদ শফী।
আর এখন বলছেন, মেয়েদের স্কুলে পাঠানো যাবে না..
যা বলেছিলেন আহমদ শফী
শুক্রবার জুমার নামাজের পর চট্টগ্রামের হাটহাজারীর দারুল উলুম মঈনুল ইসলাম মাদ্রাসার বার্ষিক মাহফিলে আহমদ শফী বলেন, “আপনাদের মেয়েদের স্কুল-কলেজে দেবেন না। বেশি হলে ক্লাস ফোর বা ফাইভ পর্যন্ত পড়াতে পারবেন। বিয়ে দিলে স্বামীর টাকা পয়সা হিসেব করতে হবে। চিঠি লিখতে হবে স্বামীর কাছে। আর বেশি যদি পড়ান, পত্রপত্রিকায় দেখছেন আপনারা, মেয়েকে ক্লাস এইট, নাইন, টেন, এমএ, বিএ পর্যন্ত পড়ালে ওই মেয়ে আপনার মেয়ে থাকবে না। অন্য কেহ নিয়ে যাবে। পত্রপত্রিকায় এ রকম ঘটনা আছে কিনা? ওয়াদা করেন। বেশি পড়ালে মেয়ে আপনাদের থাকবে না। টানাটানি করে নিয়ে যাবে আরেকজন পুরুষ।”
Comments