হোলি আর্টিজান ঘটনার সঙ্গে ‘শনিবার বিকেল’র গল্পের কোনো মিল নেই: ফারুকী
মোস্তফা সরয়ার ফারুকীর প্রথম চলচ্চিত্র ‘ব্যাচেলর’ মুক্তির পর আলোচনা-সমালোচনার ঝড় উঠেছিলো। একদিকে দর্শক দলবেঁধে হলে গিয়েছিলেন, অন্যদিকে বোদ্ধাদের একটি অংশ বলেছিলেন ‘ইহা কিছু হয়নি’। কেউ কেউ আরও একধাপ এগিয়ে বলেছিলেন ‘শিল্প ধ্বংস হয়ে গেলো’। ‘ব্যাচেলর’র কারণে কিছু দর্শক হলমুখী হয়েছিলেন, চলচ্চিত্র শিল্প ধ্বংস হয়ে যায়নি।
নির্মাতা ফারুকী সেদিকে সামান্য কর্ণপাত না করে, একের পর এক চলচ্চিত্র নির্মাণ করছেন। বিতর্কও তার নামের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে যুক্ত হয়ে গেছে। কিন্তু, দর্শকের ভালোবাসা ফারুকীর প্রতি বাড়ছেই। তার প্রতিটি নির্মাণ দর্শক গ্রহণ করছেন। ‘ব্যাচেলর’র পর ‘টেলিভিশন’, ‘মেড ইন বাংলাদেশ’, ‘থার্ড পারসন সিঙ্গুলার নাম্বার’ এবং ‘ডুব’ সবক্ষেত্রেই তা প্রমাণিত হয়েছে। ‘শনিবার বিকেল’ মোস্তফা সরয়ার ফারুকীর নতুন চলচ্চিত্র। নিয়ম করেই যেনো বিতর্ক শুরু হয়েছে।
‘শনিবার বিকেল’ মুক্তি পাওয়ার আগেই চলচ্চিত্রটি নিয়ে জনমনে যে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করা হয়েছে তা দূর করতে অনুমানের ওপর নির্ভর করে নয়, প্রমাণের ভিত্তিতে আলোচনা করার আহ্বান জানিয়েছেন ছবিটির পরিচালক মোস্তফা সরয়ার ফারুকী।
দ্য ডেইলি স্টার অনলাইনের সঙ্গে আলাপকালে তিনি বলেন, “যারা আমার সর্বশেষ চলচ্চিত্রটি নিয়ে ভুল বুঝাবুঝি সৃষ্টি করছেন তারা কেউই ছবিটি দেখেননি। অথচ, তারা বললেন যে এই চলচ্চিত্রটিতে জাহিদ হাসান ও তিশাকে ‘সন্ত্রাসী’ হিসেবে দেখানো হয়েছে। কিন্তু, আমরা সবসময়ই বলে আসছি- না, তারা সন্ত্রাসীর চরিত্রে অভিনয় করেননি। তারপরও অভিনয়শিল্পীদের সম্পর্কে অনলাইনে ভুল প্রচারণা চালানো হচ্ছে।”
‘ব্যাচেলর’-খ্যাত এই পরিচালক বলেন, “আমি আসলেই জানি না আমার চলচ্চিত্রগুলো নিয়ে কেনো বিতর্ক সৃষ্টি হয়। তবে আমি মনে করি, চলচ্চিত্র মুক্তির আগে যে বিতর্ক সৃষ্টি হয় তা শিল্পের জন্যে মঙ্গলজনক নয়।”
বিষয়টি ব্যাখ্যা করে তিনি বলেন, “কারণ, যে মানুষটি ছবিটির পক্ষে বা বিপক্ষে অবস্থান নিচ্ছেন তারা উভয়ই ছবিটির প্রকৃত স্বাদ থেকে বঞ্চিত হন। তাদের কাছে ছবিটি একটি বিতর্কের বিষয়ই হয়ে থাকছে। তারা তখন ছবিটিতে তাদের বিতর্কের উপাদান খুঁজতে থাকেন। ছবিটি সম্পর্কে তাদের পূর্ববর্তী ধারনার কারণে তারা এটি উপভোগ করতে পারেন না। আমি বিশ্বাস করি যে একটি চলচ্চিত্র মুক্তির পর আলোচনা-বিতর্ক হওয়া উচিত। সেটিই মঙ্গলময়।”
সেন্সর বোর্ডে কেনো ‘শনিবার বিকেল’ আটকে দেওয়া হলো সে প্রসঙ্গে ফারুকী বলেন, “এক বছর আগে আমরা যখন শুটিং করছিলাম তখনই কিছু কিছু নিউজ পোর্টালে খবর আসতে শুরু করে যে হোলি আর্টিজান নিয়ে ছবি বানানো হচ্ছে। তখন আনুষ্ঠানিকভাবে বলেছি- আমি একটি ছবির শুটিং করছি। এখানে বিভিন্ন দেশের অভিনেতা-অভিনেত্রী বা কলাকুশলী রয়েছেন। বলেছি- ছবিটি হোলি আর্টিজান ঘটনা থেকে অনুপ্রেরণা নিয়ে তৈরি করা হচ্ছে কিন্তু, সে ঘটনার ওপর ভিত্তি করে নয়। হোলি আর্টিজান ঘটনার সঙ্গে ‘শনিবার বিকেল’র গল্পের কোনো মিল নেই। এই কথাগুলো বলেছি যাতে আর কোনো ধোঁয়াশা তৈরি না হয়। কিন্তু, তারপরও সেই ধোঁয়াশা তৈরি হলোই।”
অথচ, গত ৯ জানুয়ারি ‘শনিবার বিকেল’ সেন্সর বোর্ডে দেখানোর পর বোর্ডের কয়েকজন সদস্য বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে ছবিটির উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করেছিলেন। তারপরও কেনো এমন পরিস্থিতির সৃষ্টি হলো?- এ প্রশ্নে উত্তরে ফারুকী বলেন, “হ্যাঁ, এর পরদিন, আমাকে চলচ্চিত্র পরিচালক সমিতির সভাপতি ফোনে বললেন, ‘আমরা সবাই ছবিটির প্রশংসা করেছি। তবে এখন ছবিটিতে ছোট্ট একটি টেস্ট যোগ করতে হবে।’ আমি বললাম, অসুবিধে নেই। বোর্ডকে বলেন আমাকে চিঠি দিতে যে আপনারা কী যোগ করতে চান। তারপর আমি তা জুড়ে দিবো।”
এরপর যা ঘটেছিলো তা পরিচালকের ভাষায়, “১৪ জানুয়ারি সেন্সর বোর্ড থেকে ছবিটির প্রয়োজক জাজ মাল্টিমিডিয়ার আব্দুল আজিজকে জানানো হলো যে ১৫ জানুয়ারি তারা ছবিটি আবার দেখবেন। এমন ঘটনা সচরাচর দেখা যায় না। কেননা, প্রথমবার দেখার পর যদি কোনো চলচ্চিত্রে কোনো বিতর্ক সৃষ্টি হয় তারপর প্রয়োজক যদি বোর্ডকে বলেন যে, আপনারা আরেকবার দেখেন, তাহলে দ্বিতীয়বার চলচ্চিত্রটি দেখা হয়।”
“কিন্তু, আমাদের ‘শনিবার বিকেল’ নিয়ে কোনো বিতর্ক নেই। এমনকি, আমরা এটি দ্বিতীয়বার দেখার আবেদনও করিনি। তারপরও তারা এটি দ্বিতীয়বার দেখার কথা জানালেন। তখন আমরা আশঙ্কা করলাম এবং ১৫ জানুয়ারি দেখলাম তাই ঘটলো,” যোগ করেন ফারুকী।
দ্বিতীয়বার দেখার পর আপনাকে কী জানানো হলো?- উত্তরে তিনি বলেন, “আমাদেরকে চিঠি দিয়ে জানানো হলো- দেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ ও ইসলাম অবমাননাসহ তিনটি কারণে ছবিটির ছাড়পত্র প্রত্যাখ্যান করা হয়েছে।”
এখন ছবিটি নিয়ে আপনার করণীয় কী বলে মনে করছেন?- জানতে চাওয়া হলে পরিচালক বলেন, “ছবিটি নিয়ে আমাদের আবেদন করার শেষ তারিখ ১৬ ফেব্রুয়ারি। আমরা আইনজীবীদের সঙ্গে কথা বলছি যে কীভাবে আবেদন করা যায়।”
আপনার আগের কয়েকটি চলচ্চিত্র নিয়েও এমন পরিস্থিতির উদ্ভব হয়েছিলো উল্লেখ করলে তিনি বলেন, “আমার ‘ব্যাচেলর’ আটকে ছিলো ছয় মাস, ‘মেড ইন বাংলাদেশ’ আটকে ছিলো দেড় বছর, ‘থার্ড পারসন সিঙ্গুলার নাম্বার’ আটকে ছিলো নয় মাস। এরপর ‘ডুব’ আটকে ছিলো কয়েক মাস।”
এমন পরিস্থিতিতে নতুন ছবিটি নিয়ে কী ভাবছেন?- উত্তরে তিনি বলেন, “আমি যদি ছবিটি দেখাতে না পারি তাহলে তো আমাকে ইসলামবিরোধী হিসেবে চিহ্নিত করে ফেলবে। কিন্তু, আমি তো কখনোই ধর্মবিদ্বেষী ছিলাম না এখনো তা নই।”
‘শনিবার বিকেল’ নিয়ে ফারুকীর বক্তব্য, “আমরা বলেছি- এটি একটি ফিকশন (কল্পকাহিনী)। ছবির কোথাও বলা হয়নি যে এটি হোলি আর্টিজানের ঘটনা নিয়ে তৈরি করা হয়েছে। আমরা বলেছি- ছবিটির সব চরিত্র এবং ঘটনা পুরোপুরি কাল্পনিক। আমরা তো কখনই দাবি করিনি যে হোলি আর্টিজান নিয়ে ছবি বানাচ্ছি। তবে হ্যাঁ, আমি সাক্ষাৎকারে বলেছি- হোলি আর্টিজানের ঘটনা থেকে অনুপ্রাণিত। তবে এটিও বলেছি- এর সঙ্গে সত্যের কোনো সম্পর্ক নেই। যাতে এ নিয়ে কোনো ধরনের বিভ্রান্তি না সৃষ্টি হয়।”
ছবিটি দেশের বাইরে দেখানো হবে কী না জানতে চাইলে পরিচfলক বলেন, “এরই মধ্যে সেন্সর বোর্ডের ভাইস প্রেসিডেন্ট নিজামুল হক বার্তা সংস্থা এএফপি-কে বলেছেন, এই ছবি দেশে এবং দেশের বাইরে কোথাও দেখানো যাবে না। ফলে আমি কনফিউজড হয়েছি, বুঝতে পারছি না উনি কীসের ভিত্তিতে এমন মন্তব্য করলেন। তবে, ছবি বানানো যেহেতু শেষ, আমরা এখন দেশের বাইরে বিভিন্ন জায়গায় কথা বলতে শুরু করেছি।”
সবশেষে, এদেশে চলচ্চিত্রকার হিসেবে বেঁচে থাকাকে ‘ভালনেরেবল’ অভিহিত করে ফারুকী বলেন, “এমন পরিস্থিতিতে দেশের গণমাধ্যমগুলোতে ‘মত প্রকাশের স্বাধীনতার গুরুত্ব’ তুলে ধরা যেতে পারে।”
Comments