ডাকসু নির্বাচন: গণমাধ্যমের ওপর বিধিনিষেধ ও অস্বচ্ছ ব্যালটবাক্স বিতর্ক

১১ মার্চ অনুষ্ঠিত হতে যাওয়া ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (ডাকসু) নির্বাচনে গণমাধ্যমের ওপর বিধিনিষেধ আরোপ এবং অস্বচ্ছ ব্যালটবাক্স ব্যবহার করা নিয়ে সৃষ্টি হয়েছে নতুন বিতর্ক। বিশ্ববিদ্যালয়ের এমন সিদ্ধান্তে নির্বাচনের স্বচ্ছতা নিয়েও সন্দেহ সৃষ্টি হয়েছে।
Collage
(ঘড়ির কাঁটা অনুযায়ী) মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম, অধ্যাপক আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক, অধ্যাপক আসিফ নজরুল, অধ্যাপক ফাহমিদুল হক, অধ্যাপক কামরুল হাসান মামুন এবং অধ্যাপক শফিউল আলম ভূঁইয়া। ছবি: সংগৃহীত

১১ মার্চ অনুষ্ঠিত হতে যাওয়া ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (ডাকসু) নির্বাচনে গণমাধ্যমের ওপর বিধিনিষেধ আরোপ এবং অস্বচ্ছ ব্যালটবাক্স ব্যবহার করা নিয়ে সৃষ্টি হয়েছে নতুন বিতর্ক। বিশ্ববিদ্যালয়ের এমন সিদ্ধান্তে নির্বাচনের স্বচ্ছতা নিয়েও সন্দেহ সৃষ্টি হয়েছে।

এ বিষয়ে আজ (১০ মার্চ) দ্য ডেইলি স্টার অনলাইনের কথা হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঁচজন শিক্ষক এবং রাজনীতিবিদ ও ডাকসুর সাবেক ভিপির সঙ্গে।

বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির (সিপিবি) সভাপতি এবং স্বাধীনতা-পরবর্তী বাংলাদেশে ডাকসুর প্রথম সহ-সভাপতি (ভিপি) মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম বলেন, “মানুষ স্বাভাবিকভাবেই সন্দেহ করছে যে সম্প্রতি জাতীয় নির্বাচনকে ভুয়া ভোটের মাধ্যমে যেভাবে একটি প্রহসনে রূপান্তরিত করা হয়েছিলো সেভাবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নির্বাচনকেও সেই নীল-নকশার বাইরে থাকতে দেওয়া হবে না।”

তিনি মনে করেন, “(কেন্দ্রের) ভেতরে তারা কী ধরনের অঘটনগুলো ঘটাবে, সেগুলো যাতে বাইরের মানুষ না জানতে পারে, সেই উদ্দেশ্যেই সেগুলো করা হচ্ছে কী না- সেটা সন্দেহ করার যথেষ্ট কারণ রয়েছে। এরকম একটা পরিস্থিতি আইয়ুব খানের আমলেও ছিলো। আইয়ুব খান পুরো দেশ নিয়ন্ত্রণ করলেও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে কিন্তু নিয়ন্ত্রণ করতে পারেনি।”

স্বচ্ছ ব্যালটবাক্সের বিষয়ে তিনি বলেন, “ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন বর্তমান প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে পরামর্শ করতে পারে। প্রধানমন্ত্রীসহ আমরাও সেই সংগ্রামে সামিল ছিলাম। স্বচ্ছ ব্যালটবাক্স ছাড়া ভোট কারচুপির আশঙ্কা দূর করা যায় না।”

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য এবং গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের শিক্ষক অধ্যাপক আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক বলেন, “গণমাধ্যমের ওপর বিধিনিষেধ আরোপ করা ঠিক না। আমরা যারা গণমাধ্যমের স্বাধীনতায় বিশ্বাস করি এবং সাধারণ মানুষের তথ্যের অধিকারে বিশ্বাস করি- তারা মনে করি, গণমাধ্যমের অভিগম্যতা নিশ্চিত করা উচিত। এর ওপর কোনো বিধিনিষেধ আরোপের প্রয়োজন নেই।”

তার মতে, “গণমাধ্যম এসে শুধু নির্বাচন দেখবে। তারা তো কোনো কর্মকাণ্ডে যুক্ত হবে না। তাই সেই দেখার ওপর বিধিনিষেধ আরোপ করলে স্বাভাবিকভাবেই সন্দেহ এসে যায়।”

বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের এমন সিদ্ধান্তে সন্দেহ সৃষ্টি হচ্ছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, “বিধিনিষেধ দিয়ে খামাখা একটা বিতর্ক ও সন্দেহ সৃষ্টি করা হলো। সেই সন্দেহ যেনো না থাকে সে জন্যে গণমাধ্যমের ওপর যে বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়েছে- আমার মনে হয় তা তুলে নেওয়াটা যুক্তিসঙ্গত। নির্বাচনকে সবদিক থেকে বিশ্বাসযোগ্য করার স্বার্থেই এটা করা দরকার।”

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক আসিফ নজরুল বলেন, “গণমাধ্যমের ওপর কড়াকড়ি কেনো? গত সংসদ নির্বাচনে দেখা গেছে- নির্বাচনটিকে পর্যবেক্ষণের বাইরে রাখার জন্যে বিভিন্ন ধরনের পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছিলো। সেই ব্যবস্থাটিই এখন পুরোপুরি অনুসরণ করা হচ্ছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মডেলে যতোটুকু করা যায়।”

তিনি মনে করেন, “(ডাকসু নির্বাচনকে কেন্দ্র করে) অনেকটা অভূতপূর্বভাবে কড়াকড়ি আরোপ করা হয়েছে।… নির্বাচনে কারচুপি এড়ানোর জন্যে একমাত্র সেফগার্ড হতে পারতো গণমাধ্যম। গণমাধ্যমের ওপর যে বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়েছে এবং পোলিং এজেন্ট থাকার বিষয়ে বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়েছে তা এই নির্বাচনটিকে বৃহদাংশে পর্যবেক্ষণের বাইরে রাখার জন্যে।”

অস্বচ্ছ ব্যালটবাক্সের ব্যাপারে তিনি বলেন, “এর একটাই কারণ থাকতে পারে তারা হয়তো আগেই কিছু ব্যালটবাক্স ভরে রাখতে চায় এবং সেটা কেউ দেখুক তা তারা চায় না। এছাড়া, অন্য কোনো কারণ তো হতে পারে না। বাংলাদেশের নির্বাচনে বহু বছর থেকে প্রতিষ্ঠিত যে স্বচ্ছ ব্যালটবাক্স দরকার।”

এ বিষয়ে জানতে চাওয়া হলে গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের অধ্যাপক শফিউল আলম ভূঁইয়ার প্রশ্ন, “গণমাধ্যমের ওপর কড়াকড়ি কোথায়? পৃথিবীর কোথায় ভোটকেন্দ্রের ভেতর থেকে ভোটগ্রহণের চিত্র সরাসরি সম্প্রচার করা হয়?” তিনি জানান, “সাংবাদিকরা ভোটকেন্দ্রে যেতে পারবে। কিন্তু, বুথে তো তাদের ঢুকতে পারার কথা না।।”

তিনি আরও জানান, “সাধারণত পৃথিবীর কোথাও ভোটকেন্দ্রের ভেতর থেকে লাইভ করা যায় না। আমি অনেক জায়গায় নির্বাচনে ভোট দিয়েছে, অনেক জায়গায় দেখেছি- কোথাও ভোটকেন্দ্রের ভেতর থেকে লাইভ করা যায় না।”

শফিউল আলম ভূঁইয়া মনে করেন, “নানাজন নানাভাবে রাজনৈতিকভাবে অনুপ্রাণিত। সেভাবে তারা প্রতিবেদন লেখে। এটি আমাদের দেশে খুব স্বাভাবিক। তবে আমার বক্তব্য হলো: লিখিত আচরণবিধির ওপর সংবাদমাধ্যমের নির্ভর করা উচিত। একটা সংবাদ বিজ্ঞপ্তি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে গিয়েছে সেটার ওপর তাদের নির্ভর করা উচিত।”

অস্বচ্ছ ব্যালটবাক্সের বিষয়ে তিনি বলেন, “ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নিজস্ব ব্যালটবাক্স রয়েছে। আমরা কারো ব্যালটবাক্স ব্যবহার করি না। ঐতিহাসিকভাবে যে ব্যালটবাক্সগুলো রয়েছে সেগুলোই ব্যবহার করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। আমাদের শিক্ষকদের নির্বাচনসহ বিভিন্ন নির্বাচনে এগুলো ব্যবহার করা হয়। ভোট শুরুর আগে সবাইকে বাক্স উল্টিয়ে দেখানো হয়।”

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক কামরুল হাসান মামুনের বক্তব্য, “গণমাধ্যমের ওপর এতো কড়াকড়ি কেনো?- সে বিষয় বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের কী যুক্তি তা শিক্ষার্থীদের কাছে তুলে ধরা হচ্ছে না। শিক্ষার্থীরা তো এ বিষয়টির ব্যাখ্যা চায়। এটি নির্বাচনকে প্রশ্নবিদ্ধ করে ফেলবে। যেই জিতুক না কেনো প্রশ্নের সুযোগ থেকে যায়।”

তিনি মনে করেন, “মানুষের মনে এ ধরনের প্রশ্নও এখন আসতে পারে যে- এটি আবার জাতীয় নির্বাচনের নব্য-প্রতিফলন হবে কী না? সেখানকার কৌশলগুলো এই নির্বাচনে কাজে লাগানো হবে কী না?- এ ধরনের প্রশ্ন তো আমি এখনই অন্যদের কাছ থেকে শুনতে পাচ্ছি।”

অস্বচ্ছ ব্যালটবাক্স সম্পর্কে তিনি বলেন, “যেহেতু, নিকট অতীতে আমরা জাতীয় নির্বাচন দেখেছি। যার জন্যে মানুষের মধ্যে প্রশ্ন আসতেই পারে। আমরা শিক্ষকরাই কিন্তু প্রশ্নের মধ্যে পড়ে যাবো। যা শিক্ষার জন্যে খুব একটা ভালো বিষয় হবে না। শিক্ষকদের অবস্থানটি- বিশ্বাস, আস্থা, জ্ঞানের প্রবাহটি পানির প্রবাহের মতো। এটি যদি নড়বড়ে হয়ে যায় তাহলে তা কারোর জন্যে মঙ্গল হবে না,” যোগ করেন তিনি।

গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের অধ্যাপক ফাহমিদুল হক এক লিখিত বক্তব্যে জানান, “সংবাদপত্রের মাত্র দুজন সাংবাদিক এবং টেলিভিশনের ক্ষেত্রে চারটি ক্যামেরা ইউনিটের জন্য অনুমোদন সীমিত রাখা এবং সরাসরি টেলিভিশন সম্প্রচার ও ইন্টারনেট স্ট্রিমিং নিষিদ্ধ করার বিষয়গুলো নির্বাচনের স্বচ্ছতার পরিধিকে সীমিত করে ফেলেছে।”

“এছাড়া মাত্র ছয় ঘণ্টায় ৪৩ হাজার শিক্ষার্থীর ভোট কীভাবে নেওয়া সম্ভব, তা নিয়েও সংশয় থেকে যাচ্ছে,” মন্তব্য করেন তিনি।

Comments

The Daily Star  | English

One month of interim govt: Yunus navigating thru high hopes

A month ago, as Bangladesh teetered on the brink of chaos after the downfall of Sheikh Hasina, Nobel Laureate Muhammad Yunus returned home to steer the nation through political turbulences.

8h ago