১৯৭১ সালের গণহত্যার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতির আহ্বান
বাংলাদেশের ‘জাতীয় গণহত্যা দিবস’ পালন উপলক্ষে জাতিসংঘে বাংলাদেশ স্থায়ী মিশনের বঙ্গবন্ধু মিলনায়তনে ১৯৭১ সালে বাংলাদেশে সংঘটিত ইতিহাসের বর্বরতম গণহত্যার স্মরণে গণহত্যা প্রতিরোধবিষয়ক একটি আন্তর্জাতিক প্যানেল আলোচনা অনুষ্ঠিত হয়।
গতকাল (২৫ মার্চ) জাতিসংঘে নিযুক্ত বাংলাদেশের স্থায়ী প্রতিনিধি মিশনের এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, আজ অনুষ্ঠিত আলোচনায় মডারেটর, প্যানেলিস্ট ও বিষয় বিশেষজ্ঞগণ স্ব স্ব দেশ ও বিশ্বের বিভিন্ন দেশের গণহত্যার উদাহরণ টেনে বলেন, বাংলাদেশে ১৯৭১ সালে সংঘটিত গণহত্যার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি অবশ্যই হওয়া প্রয়োজন। এছাড়া, এই স্বীকৃতি এতোদিনেও না হওয়ায় দুঃখ প্রকাশ করেন তারা।
আলোচনা অনুষ্ঠানটিকে ‘অতীত থেকে শিক্ষা গ্রহণ এবং ‘ভবিষ্যৎ গণহত্যা প্রতিরোধ’ এই দুই প্যানেলে ভাগ করা হয়।
প্রথম প্যানেলটি সঞ্চালনা করেন গ্লোবাল সেন্টার ফর দ্য রেসপন্সিবিলিটি টু প্রটেক্ট এর পরিচালক ড. সাইমন অ্যাডামস। এতে আলোচনায় অংশ নেন জাতিসংঘে নিযুক্ত আর্মেনিয়ার স্থায়ী প্রতিনিধি রাষ্ট্রদূত মহের মার্গারিয়ান, কম্বোডিয়ার স্থায়ী প্রতিনিধি রাষ্ট্রদূত সোভান কে, ক্রোয়েশিয়ার স্থায়ী প্রতিনিধি রাষ্ট্রদূত ভ্লাদিমির দ্রোবনজ্যাক এবং বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ম্যারিটাইম অ্যাফেয়ার্স ইউনিটের সচিব মো: খুরশেদ আলম।
জাতিসংঘে নিযুক্ত লিচেস্টেইন এর স্থায়ী প্রতিনিধি রাষ্ট্রদূত ক্রিচিয়ান উইনেসের এর সঞ্চালনায় দ্বিতীয় প্যানেলটিতে আলোচক ছিলেন রুয়ান্ডার স্থায়ী প্রতিনিধি ভ্যালেনটাইন রাগয়োবিজা, আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের অ্যাসিম্বিলি অব দ্য স্টেট পার্টির ভাইস-প্রেসিডেন্ট এবং শ্লোভাকিয়ার স্থায়ী প্রতিনিধি রাষ্ট্রদূত মাইকেল মিলিনার এবং রাটগারস বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ও গণহত্যা বিশেষজ্ঞ অ্যালেক্স হিনটন।
আন্তর্জাতিক এই প্যানেল আলোচনার শুরুতে উদ্বোধনী ভাষণ দেন জাতিসংঘে নিযুক্ত বাংলাদেশের স্থায়ী প্রতিনিধি রাষ্ট্রদূত মাসুদ বিন মোমেন। ২৫ মার্চ জাতীয় গণহত্যা দিবস পালনের ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট তুলে ধরেন তিনি।
তার বক্তব্যে উঠে আসে ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চের কালরাতে ‘অপারেশন সার্চলাইট’ এর নামে রাজধানী ঢাকায় পাকিস্তানের সামরিক বাহিনীর দ্বারা সংঘটিত নির্মম ও উদ্দেশ্য প্রণোদিত গণহত্যার কথা।
তিনি বলেন, “১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাজধানী ঢাকাকে মৃত্যু উপত্যকায় পরিণত করার সেই নারকীয় হত্যাযজ্ঞের মধ্য দিয়ে পাকিস্তানী বাহিনী বাংলাদেশে গণহত্যা শুরু করে। তাই এটি শুধু বাংলাদেশের জন্যই নয়, বিশ্ব ইতিহাসের জন্যও এক কালো দিন। একারণে এই দিনটিকেই ২০১৭ সালের মার্চ মাসে বাংলাদেশ জাতীয় সংসদ ‘গণহত্যা দিবস’ হিসেবে ঘোষণা দেয়।”
রাষ্ট্রদূত বলেন, “এরপর ৯ মাসের রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধে শহীদ হয় ৩০ লাখ মানুষ। এতো কম সময়ে এতো মানুষকে হত্যা করার ঘটনা পৃথিবীতে আর কোথাও খুঁজে পাওয়া যাবে না। আর একারণেই এটি পৃথিবীর সবচেয়ে ভয়াবহতম গণহত্যার ঘটনা। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়, বিশেষজ্ঞ, ইতিহাসবিদ, কূটনীতিক ও বিদেশী সাংবাদিকগণ তথ্য-প্রমাণসহ পরিষ্কারভাবে এটিকে গণহত্যা বলে অভিহিত করেছেন। এ কারণে এই গণহত্যার তথ্য প্রমাণের কোনো অভাব নেই।”
স্থায়ী প্রতিনিধি ১৯৭১ সালে বাংলাদেশে সংঘটিত গণহত্যাকে আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃতি দিতে জাতিসংঘের প্রতি জোর আহ্বান জানান।
রাষ্ট্রদূত মাসুদ জানান, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বাংলাদেশে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল গঠনের মাধ্যমে ১৯৭১ সালের মানবতাবিরোধী যুদ্ধাপরাধী ও গণহত্যাকারীদের বিচারের ব্যবস্থা করেছেন। মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যসহ বিশ্বের কোথাও যেনো গণহত্যা ও নৃশংসতার মতো জঘন্য অপরাধের আর কোনো পুনরাবৃত্তি না ঘটে সেলক্ষ্যে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে দৃঢ় ভূমিকা রাখার আহ্বান জানান তিনি।
গণহত্যা প্রতিরোধে বাংলাদেশ সবসময়ই বিশ্ব সম্প্রদায়ের সাথে একাত্ম হয়ে কাজ করতে দৃঢ় প্রতিশ্রুতিবদ্ধ আর সেলক্ষ্যেই বাংলাদেশ ১৯৭১ সালের গণহত্যার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি প্রত্যাশা করে মর্মে অভিমত ব্যক্ত করেন রাষ্ট্রদূত মাসুদ।
জাতিসংঘ মহাসচিবের গণহত্যা প্রতিরোধবিষয়ক বিশেষ উপদেষ্টা অ্যাডামা দিয়েং বাংলাদেশ সফরে থাকায় আন্তর্জাতিক এই প্যানেল আলোচনায় তিনি ভিডিও বক্তব্য প্রদান করেন যা প্যানেল আলোচনা শুরুর আগে প্রচার করা হয়।
আলোচকদের বক্তব্যে উঠে আসে অতীতের সংঘটিত গণহত্যার তথ্য প্রমাণ ও উপাদান থেকে শিক্ষা নিয়ে কীভাবে সামনের দিনগুলোতে গণহত্যার মতো ভয়াবহ ঘটনাগুলোর পুনরাবৃত্তি রোধ করা যায় সে বিষয়গুলো।
এছাড়াও গণহত্যা সংগঠনকারীরা কোনো অবস্থায়ই যেনো আইনের হাত থেকে পার পেতে না পারেন তার ব্যবস্থা গ্রহণ এবং গণহত্যার পুনরাবৃত্তি বন্ধে সবাইকে একতাবদ্ধ হয়ে কাজ করার আহ্বান জানান তারা।
আর্মেনিয়া, কম্বোডিয়া, রুয়ান্ডা, বসনিয়া ও বাংলাদেশসহ বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে সংঘটিত গণহত্যা বন্ধে বিশ্ব নেতৃবৃন্দের ব্যর্থতার বিষয়টিও উঠে আসে আলোচনায়। মিয়ানমার কর্তৃক সংঘটিত দেশটির রাখাইন রাজ্যে রোহিঙ্গাদের জাতিগত নিধন ও গণহত্যার কথাও উল্লেখ করেন আলোচকগণ। এক্ষেত্রে উদার মানবিক সহায়তা প্রদানের জন্য তারা বাংলাদেশ সরকার ও জনগণকে ধন্যবাদ জানান।
অনুষ্ঠানে জাতিসংঘের সদস্য রাষ্ট্রসমূহের প্রতিনিধি ও জাতিসংঘের কর্মকর্তাগণ, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, শিক্ষার্থী ও গবেষক, থিংক ট্যাঙ্কসহ যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী মুক্তিযোদ্ধা, যুক্তরাষ্ট্র আওয়ামী লীগের নেতৃবৃন্দ এবং নিউইয়র্ক প্রবাসী বাঙালিসহ বিভিন্ন পর্যায়ের আমন্ত্রিত বিদেশী অতিথিরা উপস্থিত ছিলেন।
অনুষ্ঠানের শুরুতে বাংলাদেশ ও বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে সংঘটিত গণহত্যার শিকার মানুষের পবিত্র স্মৃতির উদ্দেশ্যে সম্মান জানিয়ে এক মিনিট নীরবতা পালন করা হয়। অনুষ্ঠানটিতে গণহত্যা দিবস উপলক্ষে দেওয়া রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর বাণীর অংশবিশেষ উপস্থিত বিদেশী অতিথিদের সামনে তুলে ধরেন রাষ্ট্রদূত মাসুদ।
অনুষ্ঠানটিতে অন্যান্যদের মাঝে উপস্থিত ছিলেন নিউইয়র্কস্থ বাংলাদেশ কনস্যুলেট জেনারেলের কনসাল জেনারেল সাদিয়া ফয়জুন নেছা।
আরও পড়ুন:
২৬ মার্চকে ‘বাংলাদেশ দিবস’ ঘোষণা দিলেন ওয়াশিংটন ডিসির মেয়র
স্বাধীনতা দিবসে মুক্ত হলো ১১টি বন্যপ্রাণী
Comments