একটি পা, না গোটা একটি জীবন!
বিচক্ষণ-বিদগ্ধ রসিক প্রখ্যাত লেখক সৈয়দ মুজতবা আলী নির্মম-নির্দয়-নিষ্ঠুর সত্যকে রসিকতার ঢঙ্গে উপস্থাপন করে, আঘাতটা করতেন মানুষের বিবেকে। তার তেমন একটি বিখ্যাত গল্প ‘পাদটীকা’। দলবল নিয়ে স্কুল পরিদর্শনে এসেছিলেন লাট সাহেব। সঙ্গে ছিলো ট্রেনের নিচে একটি পা কাটা যাওয়া, লাট সাহেবের তিন ঠাঙওয়ালা একটি কুকুর। যে কুকুরের জন্যে মাসে বরাদ্দ ৭৫ টাকা। লাট সাহেব চলে যাওয়ার পর শিক্ষার্থীদের পণ্ডিত মশাই বললেন, “অপিচ আমি, ব্রাহ্মণী, বৃদ্ধা মাতা, তিন কন্যা, বিধবা পিসি, দাসী একুনে আটজন। আমাদের সকলের জীবন ধারণের জন্য আমি মাসে পাই পঁচিশ টাকা। এখন বল তো দেখি, তবে বুজি তোর পেটে কত বিদ্যে, এই ব্রাহ্মণ পরিবার লাট সায়েবের কুকুরের ক’টা ঠ্যাঙের সমান?”
এই গল্পের সময়কাল ব্রিটিশ শাসনামল। এবার ফিরে আসি বর্তমানে।
গত বছরের ২৮ এপ্রিল ঢাকার মেয়র হানিফ ফ্লাইওভারে গ্রিনলাইন পরিবহনের একটি বাস একজন ব্যক্তিগত গাড়িচালক রাসেল সরকারের পায়ের ওপর তুলে দিলে তার পা বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। এরপর, আদালত পরিবহন মালিককে ৫০ লাখ টাকা ক্ষতিপূরণ দেওয়ার আদেশ দেন। তারপর গ্রিনলাইন পরিবহনের ম্যানেজার আব্দুস সাত্তার একটি সংবাদমাধ্যমকে বলেন, “একটা পায়ের দাম ৫০ লাখ টাকা দিলে তো বাজারে এর একটা দাম নির্ধারণ হয়ে যাবে।”
একটি পা, না গোটা একটা জীবন! এ কেমন মানুষ, কেমন মানসিকতা- মানবিকতা? দ্য ডেইলি স্টারের পক্ষ থেকে আজ (৯ এপ্রিল) এ বিষয়ে জানতে চেয়েছিলাম বিশিষ্ট লেখক-গবেষক সৈয়দ আবুল মকসুদ এবং মানবাধিকারকর্মী অ্যাডভোকেট সুলতানা কামালের কাছে।
সৈয়দ আবুল মকসুদ বলেন, “যদি তারা এ কথা বলে থাকে যে- একটা পায়ের জন্যে ৫০ লাখ টাকা- তাহলে এর চেয়ে নিষ্ঠুর কথা আমি আর শুনিনি। তাহলে বলতে হবে দুই পায়ের জন্যে ১ কোটি টাকা। চার হাত-পায়ের জন্যে ২ কোটি টাকা। মেয়র হানিফ ফ্লাইওভারে যে ধরনের ঘটনা ঘটেছে তার জন্যে তাদের (গ্রিনলাইন পরিবহন কর্তৃপক্ষ) ভেতরে কোনো অনুশোচনা নেই- তা বোঝা যাচ্ছে তাদের এমন বক্তব্য থেকে।”
গ্রিনলাইন পরিবহন কর্তৃপক্ষের এমন মন্তব্যে ক্ষিপ্ত হয়ে এই বিশিষ্ট লেখক বলেন, “আমি কথাটি শুনে খুব বিরক্ত হয়েছি। একজন মানুষের একটা পায়ের দাম তো ৫০ লাখ টাকা নয়, এর দাম ৫০ কোটি টাকার চেয়েও বেশি।… এই বিষয়টিকে মানবিক দিক থেকে দেখা উচিত ছিলো।”
এর মাধ্যমে পরিবহন খাতের মালিকদের “নিষ্ঠুর বাস্তবতা উঠে এসেছে” বলেও মন্তব্য করেন তিনি। বলেন, “যদি উনার (পরিবহন মালিকের) ছেলের পা কাটা পড়তো, অথবা নিজের পা কাটা পড়তো… এটি কি গবাদি পশুর পা যে এর বাজার মূল্য নির্ধারণ করতে হবে? আদালত যে রায় দিয়েছেন তা গ্রিনলাইন পরিবহনকে শাস্তি হিসেবে দিয়েছেন। তাদের অবহেলার শাস্তি। মানুষটিতো মারাও যেতে পারতো।”
তিনি মনে করেন, পরিবহন খাতের যারা মালিক তাদের ভেতরের নিষ্ঠুরতারই বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে গ্রিনলাইন পরিবহন কর্তৃপক্ষের বক্তব্যে। “তারা কোনো দুঃখ প্রকাশ করেনি। তাদের মধ্যে কোনো অনুশোচনা নেই। আবার বলছে- পায়ের দাম কতো?” যোগ করেন আবুল মকসুদ।
অ্যাডভোকেট সুলতানা কামাল বলেন, “অপরাধের গুরুত্ব হিসেবে ক্ষতিপূরণ নির্ধারণ করা হয়। কেউ মারা গেলে ক্ষতিপূরণ হিসেবে যে টাকা দেওয়া হয়- সেটি কি কারো প্রাণের দাম? তাই এটাকে পায়ের দাম হিসেবে বলা যায় না।”
তার মতে, “গ্রিনলাইন পরিবহন কর্তৃপক্ষের এধরনের বক্তব্য থেকে বোঝা যায় যে তাদের কোনো মানবিক বোধ নেই। আমাদের দেশে অপরাধীরা বেপরোয়া হয়ে গেছে এবং যেকোনো কথা বলে তারা পার পেয়ে যায়- এর একটি নিদর্শন হলো তাদের এমন বক্তব্য।”
“এর জন্যে তাদের ধিক্কার জানানো উচিত” বলেও মন্তব্য করেন এই মানবাধিকারকর্মী। বলেন, “কীভাবে তিনি এমন মন্তব্য করার আস্পর্ধা রাখলেন। এর থেকে বোঝা যাচ্ছে যে গ্রিনলাইন পরিবহন কতো মানবতাবোধহীন প্রতিষ্ঠান।”
সুলতানা কামাল বলেন, “পরিবহন খাতের লোকজনরা যে কতো বেপরোয়া ও উদ্ধত হয়ে গেছেন এমন বক্তব্যেই তার প্রমাণ মেলে। তারা মনে করেন- তাদের কোনো ধরনের জবাবদিহিতার অবকাশ নেই। তারা নিজেদেরকে সবার চেয়ে বেশি শক্তিশালী মনে করছেন।”
আরও পড়ুন:
গ্রিনলাইনের বাস নিলামে তুলে হলেও রাসেলকে ক্ষতিপূরণ দিতে হবে: হাইকোর্ট
ক্ষতিপূরণ না দিলে ১১ এপ্রিল টিকিট বিক্রি করতে পারবে না গ্রিনলাইন: হাইকোর্ট
Comments