শেয়ারবাজারের বিনিয়োগকারীদের জন্য ‘হৃদয় কাঁদে না’
পুঁজিবাজারের বিনিয়োগ নিয়ে চরম হতাশায় পড়েছেন ক্ষুদ্র শেয়ার বিনিয়োগকারীরা। একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে অনেকে আশায় বুক বেঁধেছিলেন এই ভেবে যে, যদি নির্বাচনের পর রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা থাকে তবে তাদের বিনিয়োগ থেকে কিছুটা মুনাফার দেখা পাবেন। ফলে নির্বাচনের পর পর অনেকেই নতুন করে বিনিয়োগ করেছেন। কিন্তু, তাদের সে আশার গুড়ে বালি।
নির্বাচনের পর রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা না থাকলেও, শেয়ারবাজার তাদের মুখে হাসি ফুটাতে পারেনি। অথচ এবারের আগে গত চারটি নির্বাচনের পর বাজার ছিলো অনেক বেশি ঊর্ধ্বমুখী। ১৯৯৬ সালের নির্বাচনের পর সে সময়কার প্রধান সূচক (ডিজেন) তিন মাসের মধ্যে বেড়েছিল ৭৮ শতাংশ বা ১,৬০৫ পয়েন্ট। ২০০১, ২০০৮ এবং ২০১৪ সালের নির্বাচনের পর একই সময়ে প্রধান সূচক (২০১৩ তে প্রধান সূচক ডিজেনকে পরিবর্তন করে শুরু করা হয় ডিএসইএক্স) বেড়েছিলো যথাক্রমে ২৬.০৯ শতাংশ, ৪.৯৮ শতাংশ এবং ৬.৩৭ শতাংশ।
সুতরাং এবারও বিনিয়োগকারীদের আশাবাদী হওয়াটা স্বাভাবিক ছিল। কিন্তু গত ১০ সপ্তাহ ধরে বাজারে (সাপ্তাহিক বিশ্লেষণে) টানা দরপতন চলছে। এ সময়ে বাজার হারিয়েছে ৬২৩ পয়েন্টেরও বেশি, যা শতাংশের হিসাবে ১০.৪৭ শতাংশ। একই সময়ে বিনিয়োগকারীদের শেয়ারের মূল্য কমেছে প্রায় ১৮, ৩৫০ কোটি টাকারও বেশি। চোখের সামনে শেয়ার মূল্যের এরকম ধসে অনেকেই চরম হতাশার মধ্যে পড়ে গেছেন।
কিন্তু বাজারে এমন দরপতন কেন? বাজার সংশ্লিষ্টদের মতামত হচ্ছে, এবারের নির্বাচনের ইতিবাচক প্রভাব যতটা না পড়েছে বাজারের ওপর, তার চেয়ে বেশি নেতিবাচক প্রভাব রেখেছে অন্য আনুসঙ্গিক সূচকগুলো। এরমধ্যে অন্যতম হলো- ব্যাংকিং সেক্টরের তারল্য সংকট। ব্যাংকিং সেক্টরে নগদ অর্থের টান থাকলে পুঁজিবাজার কখনোই গতিশীল থাকতে পারে না। কারণ পুঁজিবাজারের লেনদেনের একটি বড় অংশ আসে আর্থিক খাত বা প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীদের কাছ থেকে। তাছাড়া আর্থিক খাতে টাকার কমতি থাকলে আমানতের সুদের হার বেড়ে যায়, তখন বিনিয়োগকারীরা পুঁজিবাজারের পরিবর্তে ব্যাংকে টাকা রাখতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন। আর ব্যাংকিং সেক্টরে নগদ টাকার সঙ্কট এতোটাই বেশি যে, সুদের হার এক অংকে নামানোর ঘোষণা দিয়েও ব্যাংকগুলো তা বাস্তবায়ন করতে পারেনি। বরং গত কয়েকমাসে তা বেড়েছে। ব্যাংকিং সেক্টরে নগদ টাকার সংকটের আরেকটি উদাহরণ হলো: গত ফেব্রুয়ারিতে বেসরকারি খাতের ঋণের প্রবাহের প্রবৃদ্ধি ৫৩ সপ্তাহের মধ্যে সর্বনিম্ন ১২.৫৪ শতাংশে নেমে এসেছে। যার লক্ষ্যমাত্রা ছিল ১৬.৫ শতাংশ।
বাজারে দরপতনের কারণ হিসেবে অতি মাত্রায় প্লেসমেন্ট শেয়ার (বাজারের তালিকাভুক্তির আগে শেয়ার বিক্রি করা) বিক্রিকেও অনেকে বিবেচনা করছেন। ইদানিং বেশিরভাগ কোম্পানিই পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্তির আগে আইপিওর (প্রাথমিক গণপ্রস্তাব) মাধ্যমে পুঁজিবাজার থেকে যে মূলধন উত্তোলন করেন, তার চেয়ে বেশি টাকা উত্তোলন করেন প্লেসমেন্ট শেয়ার ছেড়ে। আর এসব প্লেসমেন্ট শেয়ারহোল্ডাররা কোম্পানিটি তালিকাভুক্তির মাস দুয়েকের মধ্যেই তাদের শেয়ার বিক্রি করে দিতে পারেন। কারণ আইনগতভাবে তারা কোম্পানির প্রসপেক্টাস অনুমোদনের এক বছরের মধ্যে শেয়ার বিক্রি করতে পারেন, কিন্তু কোম্পানিটি তালিকাভুক্ত হতে প্রসপেক্টাস অনুমোদনের পর প্রায় ১০ মাস লেগে যায়। এদিকে বাজার থেকে কোম্পানির মূলধন উত্তোলনের পাশাপাশি হঠাৎ করে প্লেসমেন্টের শেয়ারের মাধ্যমেও বড় অংকের টাকা চলে যাওয়ায় বাজার তারল্য সংকটে পড়ে।
বাজারে দরপতনের আরেকটি কারণ, বিদেশি বিনিয়োগকারীদের অংশগ্রহণ কমে যাওয়া। গেলো মাসে বিদেশি বিনিয়োগকারীদের নিট বিনিয়োগ কমেছে প্রায় ১২৩ কোটি টাকা। টাকার অংকে এ বিনিয়োগ যতোটা না বেশি, তার চেয়ে বেশি একটি সূচক হিসেবে। ডলারের বিপরীতে টাকার অবমূল্যায়ন এবং ভালো কোম্পানির শেয়ারের সরবরাহ কম থাকার পাশাপাশি খারাপ শেয়ারের সরবরাহ বেড়ে যাওয়ায়কে বিদেশি বিনিয়োগকারীদের অংশগ্রহণ কমার বড় কারণ হিসেবে উল্লেখ করা যেতে পারে। বর্তমানে বাজারে তালিকাভুক্ত প্রায় সাড়ে তিনশো কোম্পানির মধ্যে মাত্র ১৭টি কোম্পানিতে তাদের উল্লেখযোগ্য (অন্তত ১০ শতাংশ) বিনিয়োগ রয়েছে। আর ১৯৮টি কোম্পানিতে বিদেশিদের কোনো বিনিয়োগ নেই। কারণ- এর বাইরে অন্য কোম্পানিগুলোতে বিনিয়োগে তারা আস্থা পান না।
বাজারে দরপতনের আরেকটি কারণ- এ বাজারে জবাবদিহিতার বড় অভাব। বাজারের অনেক কোম্পানিই দিনের পর দিন ভালো মুনাফা করলেও বছর শেষে তারা ভালো লভ্যাংশ দেয় না। এতে বিনিয়োগকারীরা আস্থা হারিয়ে ফেলেন। একটি কোম্পানির যদি সত্যিকার অর্থেই প্রবৃদ্ধির সম্ভাবনা থাকে তখন সে আইনগতভাবেই কম লভ্যাংশ দিতে পারে। কিন্তু বেশিরভাগ কোম্পানির ক্ষেত্রেই দেখা যাচ্ছে প্রকৃতপক্ষে কোম্পানিগুলো লভ্যাংশ না দিয়ে টাকা রেখে দিলেও পরবর্তীতে তাদের মুনাফায় সে প্রবৃদ্ধি দেখা যায় না। ফলে বিনিয়োগকারীরা ভালো মুনাফা দেখে বিনিয়োগ করেও ঠকছেন।
বাজারে প্রায়ই দেখা যায় যে খারাপ কোম্পানিগুলোর শেয়ারদর বেশি হারে বৃদ্ধি পায় ভালো কোম্পানিগুলোর তুলনায়। এর পেছনে কারা কারসাজি করছেন সে বিষয়ে নিয়ন্ত্রক সংস্থা কিছু পদক্ষেপ নিলেও তা খুবই নগণ্য। কেউ বাজারে কারসাজি করে কতো টাকা হাতিয়ে নিলো সেটি জানানো হয় না। বরং তাদেরকে অল্প কিছু জরিমানা করেই ছেড়ে দেওয়া হচ্ছে- এতে কারসাজিকারীদের প্রভাব না কমে তা দিন দিন বাড়তেই দেখা যাচ্ছে।
এ অবস্থায় বাজারের ভালোর জন্য প্রয়োজন ব্যাংকিং সেক্টরের তারল্য সঙ্কট কাটানো। বাজারে কেউ কারসাজি করলে তাকে সমুচিত শাস্তির আওতায় আনা, যেন আর কেউ কারসাজি করতে সাহস না পায়। প্লেসমেন্ট শেয়ার হোল্ডাররা যেন কোম্পানি তালিকাভূক্তির তিন বছরের মধ্যে শেয়ার বিক্রি করতে না পারে সে ব্যবস্থা করা। ভালো কোম্পানিগুলো বাজারে নিয়ে আসা, কারণ ভালো কোম্পানি বাজারে আসলে তখন এমনিতেই বিদেশি বিনিয়োগ, প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগ বাজারে আসে।
২০০৯ সালে যখন গ্রামীণফোন বাজারে তালিকাভূক্ত হয়েছিল তখন একটি বড় সংখ্যক বিদেশি বিনিয়োগ ও প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগ আমাদের পুঁজিবাজারে প্রথমবারের মতো এসেছিল। এখনও প্রয়োজন ভালো কোম্পানিগুলোকে বাজারে নিয়ে আসা। যা বিদেশি বিনিয়োগ ও প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগসহ সাধারণ বিনিয়োগকারীদেরকে উৎসাহিত করবে। এর পাশাপাশি ভালো শেয়ারে বিনিয়োগের সুযোগ বাড়বে।
বিনিয়োগকারীরা বছরের পর বছর ধরে সুখবরের অপেক্ষায় আছেন। অনেকে তাদের সারাজীবনের জমানো অল্প কিছু টাকা বুঝে বা না বুঝে বিনিয়োগ করেছেন। সর্বস্ব হারানোর আশঙ্কায় দিন কাটছে তাদের। পূর্বে একজন উপদেষ্টা বলেছিলেন, “তাদের জন্যে আমার হৃদয় কাঁদে না।” নতুন অর্থমন্ত্রীর হৃদয় বিনিয়োগকারীদের জন্যে কাঁদে কি, কাঁদবে কি? নতুন অর্থমন্ত্রী পুঁজিবাজার সম্পর্কে খুবই ভালো জ্ঞান রাখেন। এমনকি তিনি পুঁজিবাজারেররই লোক হওয়ায় একেবারে খুঁটিনাটি সমস্যাগুলো সম্পর্কেও অবগত। দীর্ঘদিন তার একটি কোম্পানি পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত ছিল। তাই এই অর্থমন্ত্রীর কাছে পুঁজিবাজারের বিনিয়োগকারীদের আশাও অনেক বেশি। তিনি কি কার্যকর কিছু উদ্যোগ নিয়ে বিনিয়োগকারীদের পাশে দাঁড়াবেন?
আহসান হাবীব: স্টাফ রিপোর্টার, দ্য ডেইলি স্টার
Comments