‘ওসি চালাকি করেছেন, এসপি ওসিকে বাঁচানোর চেষ্টা করছেন, আবার তারাই তদন্ত করছেন’
ফেনীর সোনাগাজীর মাদরাসা শিক্ষার্থী নুসরাত জাহান রাফিকে আগুনে পুড়িয়ে হত্যা করা সম্পর্কে এখন পর্যন্ত উঠে আসা তথ্যে দেখা যাচ্ছে পুলিশ অপরাধীদের ধরার পরিবর্তে আড়াল করার চেষ্টা করেছিল। ওসি ‘হত্যা’ না ‘আত্মহত্যা’ বলে বিভ্রান্তি তৈরি করেছেন। জেলা প্রশাসন অধ্যক্ষের পক্ষে কাজ করেছে। এসপি পুলিশ সদরদপ্তরকে চিঠি দিয়ে নুসরাতের পরিবারের ওপর দায় চাপিয়েছে।
সম্প্রতি একটি তদন্ত কমিটিও গঠন করা হয়েছে পুলিশ বিভাগ থেকে। প্রশ্ন হলো এই তদন্ত কতটা সঠিক হবে?
বিষয়টি নিয়ে পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক এনামুল হক, মানবাধিকারকর্মী সুলতানা কামাল এবং সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ব্যারিস্টার জ্যোতির্ময় বড়ুয়ার সঙ্গে কথা বলেছি।
আজ (১৭ এপ্রিল) পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক (আইজিপি) এনামুল হক দ্য ডেইলি স্টার অনলাইনকে বলেন, “সঠিক তথ্য বের হয়ে আসতে পারে যদি আমরা সঠিক কথা বলি। আমরা নিজেরা ঠিক কথা বলি না, অন্যদের বলতে দেই না- এটিই আমাদের সবচেয়ে বড় দোষ।”
তার মতে, “শুধু পুলিশ, প্রশাসন, কারাগার বা বিচার বিভাগকে দোষ দিয়ে লাভ নেই। আসল দোষ হচ্ছে নীতিনির্ধারকদের- যারা ঠিক করছেন দেশ কীভাবে চলবে। তাদের যেসব নীতির কারণে দেশের মঙ্গল হচ্ছে তার জন্যে আমি তাদেরকে আন্তরিকভাবে কৃতজ্ঞতা জানাই। আর যেসব নীতির কারণে দেশের অমঙ্গল হচ্ছে সেগুলোর জন্যেও তারা দায়িত্ব এড়াতে পারেন না।”
পুলিশের এই সাবেক শীর্ষ কর্মকর্তা বলেন, “যেহেতু প্রধানমন্ত্রী নিজে নুসরাত হত্যা মামলাটিকে প্রত্যক্ষ তদারকিতে রেখেছেন আমি আশা করবো যে সত্যিকারের তথ্য বেরিয়ে আসবে। সেটি বিচার বিভাগীয় তদন্ত হোক বা পুলিশের তদন্ত হোক।”
নুসরাত হত্যা মামলার সত্যিকারের তদন্ত হবে আশা প্রকাশ করে বলেন, “যেটাকে বলা হয় নিরপেক্ষ তদন্ত। কে কোন পার্টি করে বা কোন গোত্রের লোক- সেটি যেনো বড় কথা না হয়। এবং অপরাধীর যেনো দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হয়। যেখানে পরিকল্পনা করে এমন হত্যা সেখানে শাস্তি হবে দৃষ্টান্তমূলক। যাতে অন্যরা এ ধরনের খারাপ কাজে না যায়।”
অ্যাডভোকেট সুলতানা কামাল বলেন, “আমরা সবসময় বলে আসছি যে পুলিশের বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ আসলে সেটি তদন্ত করানো হয় পুলিশকে দিয়েই। ফলে পুলিশের বিরুদ্ধে যতো অভিযোগ এসেছে এর সিংহভাগেরই কোনো বিচার হয়নি। কারণ যখন তদন্ত করা হয়েছে তখন তাদের লোকদের দিয়েই তদন্ত করা হয়েছে। সেখানে দোষ ঢাকার একটা প্রবণতা দেখা গেছে।”
ফেনীর পুলিশ বিভাগের কর্মকর্তাদের উদাহরণ টেনে তিনি আরও বলেন, “আজকে ফেনীর পুলিশ সুপারের (এসপি) যে কার্যকলাপ সেটির মধ্য দিয়ে নুসরাত হত্যার ঘটনাটি অন্য খাতে প্রবাহিত করা নিয়ে সন্দেহ দেখা দিয়েছে। কারণ, তিনি যেসব কথা বলছেন সেগুলো মোটামুটিভাবে অপ্রাসঙ্গিক। আমি যতোটুকু জানি ফৌজদারি মামলায় দেরি বলে কিছু নেই। এসপি বলছেন- দেরি করে মামলা করা হয়েছে। বা নুসরাতের ভাই এজাহার বদল করেছে- এমন কথাও বলা হয়েছে। এটি তো কোনো গুরুত্বপূর্ণ বিষয় না। আমরা যতোটুকু জেনেছি- এজাহারে যা লিখা হয়েছিলো নুসরাতের ভাই তাতে আপত্তি জানিয়েছিলেন। কারণ এজাহারে মূল অপরাধী মাদ্রাসার অধ্যক্ষের নাম ছিলো না। নুসরাতের ভাইয়ের পীড়াপীড়িতে অধ্যক্ষের নাম যুক্ত করা হয়েছে।”
মানবাধিকার কর্মী সুলতানা কামাল বলেন, “এ সমস্ত কার্যকলাপে স্পষ্টতই বোঝাই যাচ্ছে সোনাগাজী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মাদ্রাসার অধ্যক্ষের পক্ষ নিচ্ছিলেন। এছাড়াও, অধ্যক্ষকে যখন গ্রেপ্তার করতে বাধ্য করা হয় তখন তাকে বিশেষ ক্ষমতা আইনের ৫৪ ধারায় গ্রেপ্তার দেখানো হয়। নারী ও শিশু নির্যাতনের যে নালিশ সেটির সঙ্গে তো ৫৪ ধারার কোনো সম্পর্ক নেই। ৫৪ ধারার যে নয়টি শর্ত রয়েছে সেগুলো অধ্যক্ষের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়। তাহলে সেই ওসির নিশ্চয় চিন্তা ছিলো যে ৫৪ ধারায় অধ্যক্ষকে গ্রেপ্তার করার পর যখন তাকে আদালতে তোলা হবে এবং এই ধারার কোনো শর্ত তার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হবে না তখন তিনি ছাড়া পেয়ে যাবেন। এসব চালাকি ওসি করেছিলেন। এরপর আবার ওসিকে রক্ষা করার জন্যে এসপি চেষ্টা করছেন। তারাই আবার তদন্ত কমিটি গঠন করেছেন।”
সেই কমিটি নিরপেক্ষ প্রতিবেদন দিবে কি না তা নিয়ে নিজের শঙ্কার কথা উল্লেখ করার পাশাপাশি সুলতানা কামাল বলেন, “অথচ পুলিশের আরেকটি সংস্থা পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই) এতোদিন পর্যন্ত যে বর্ণনা দিয়ে যাচ্ছে সেখানে সেই অপরাধমূলক কাজের সঙ্গে ওসির সম্পৃক্ততা সম্পূর্ণ স্পষ্ট।”
তদন্ত কমিটির বিষয়ে তার মন্তব্য, “এ ধরনের ঘটনা যদি ঘটে তাহলে কম্পিটেন্ট অথরিটি ও নাগরিক সমাজে যারা এসব বিষয় নিয়ে কাজ করেন- যেমন, আইনজীবী, মানবাধিকার আইনজীবী, নারী আন্দোলনকর্মী তাদেরকে তদন্ত কমিটিতে সম্পৃক্ত করা উচিত।”
ব্যারিস্টার জ্যোতির্ময় বড়ুয়া মনে করেন, একটি বিচার বিভাগীয় তদন্ত হলে ভালো হয়। “কেননা, যে পুলিশ জড়িত ছিলেন তিনি তো আর একা জড়িত ছিলেন না। সেটি সিস্টেমের অন্তর্গত সমস্যা। ফলে একটি বিচার বিভাগীয় তদন্ত হলে বিষয়গুলো পরিষ্কারভাবে বের হয়ে আসতো বলে আমাদের ধারণা।”
তবে বিচার বিভাগীয় তদন্ত সম্পর্কে তার মত, “বিচার বিভাগীয় তদন্ত নিয়ে একটি সমস্যা হচ্ছে- এই তদন্ত প্রতিবেদনগুলো প্রকাশ করা হয় না। এর কারণে বিচার বিভাগীয় তদন্তের কার্যকারিতা তেমন পাওয়া যায় না। বিচার বিভাগীয় তদন্ত থেকে যে কিছুই হয়নি তা কিন্তু নয়। তবে প্রধান প্রধান ঘটনাগুলোর তদন্ত প্রতিবেদন প্রকাশিত না হওয়ায় সেগুলোর সুফল পাওয়া যায়নি- সেটিও সত্যি। এমন পরিস্থিতিতে যদি বিচার বিভাগের অধীনে একটি নিরপেক্ষ তদন্ত সংস্থা গঠন করা যেতো তাহলে সেটি একটি বিকল্প ব্যবস্থা হতে পারতো। কিন্তু, এই মুহূর্তে আমাদের সেরকম ব্যবস্থা নেই। সেরকম কোনো উদ্যোগও নেই।”
নুসরাত হত্যা মামলার বিষয়ে তিনি বলেন, “এ বিষয়ে আমাদের নজর রাখতে হবে। তদন্তটি কোনদিকে যাচ্ছে তা নিয়ে জোরালোভাবে কাজ করতে হবে। বিচার বিভাগীয় তদন্ত ও পুলিশি তদন্ত যদি সমান্তরালভাবে হয় তাহলে তাই হোক। তারপর দুটি তদন্ত প্রতিবেদনকে নিয়ে দেখতে হবে সেগুলোর মধ্যে মিল-অমিল কোথায় রয়েছে। তারপর এর ভিত্তিতে আদালত সিদ্ধান্ত নিতে পারেন।”
Comments