রাজশাহীর দুই শিক্ষার্থীর মৃত্যু, পূর্বের পুলিশি তদন্ত ও ময়নাতদন্ত ভুল
রাজশাহীতে তিন বছর আগে ‘হোটেল নাইস ইন্টারন্যাশনাল’-এ দুজন বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীর মৃত্যুর ঘটনায় গতকাল (২৮ এপ্রিল) নগরীর এক আদালতে অভিযোগপত্র দাখিল করেছে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই)।
এতে পূর্বের একটি পুলিশি প্রতিবেদন ও একটি ময়নাতদন্ত প্রতিবেদনকে অগ্রাহ্য করে ছয় ব্যক্তির বিরুদ্ধে খুন ও নারী নির্যাতনের জন্য দুটি পৃথক অভিযোগ আনা হয়েছে।
আদালতে পিবিআই কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, অভিযুক্তদের মধ্যে চারজন বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজের শিক্ষার্থী। তারা হলেন- সিরাজগঞ্জের রাহাত মাহমুদ (২১), পাবনার আহসান হাবীব রনি (২০), নাটোরের বোরহান কবির উৎস (২২) এবং রাজশাহীর আল আমিন (২০)। বাকী দুজন হোটেলের কর্মচারী- বখতিয়ার (৩২) এবং নয়ন হোসেন (৩২)।
গতকাল বিকেল পাঁচটায় রাজশাহীর সিএমএম আদালতের পুলিশ পরিদর্শক আবুল হাশেমের নিকট অভিযোগপত্র দুটি জমা দেন পিবিআইয়ের তদন্তকারী কর্মকর্তা মহিদুল ইসলাম। আবুল হাশেম জানান, আগামী ৩০ মে মামলার পরবর্তী শুনানির দিনে অভিযোগপত্রগুলো আদালতে উত্থাপিত হবে।
মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা মহিদুল ইসলাম জানান, ঘটনার দিন ওই হোটেলের ভেতর এক নারী শিক্ষার্থীকে ধর্ষণের পর তাকে ও তার ছেলে বন্ধুকে হত্যা করেন অভিযুক্ত চার শিক্ষার্থী। পরে ঘটনাকে ভিন্নখাতে প্রবাহিত করার জন্য ছেলেটিকে সিলিংয়ে ঝুলিয়ে দেন তারা।
তিনি আরও জানান, অভিযুক্ত রাহাত মাহমুদের সঙ্গে প্রেমের সম্পর্ক ছিন্ন করে নতুন সম্পর্কে জড়ালে ঈর্ষাকাতর হয়ে তার (রাহাত) বন্ধুরা মিলে ওই নারী শিক্ষার্থী এবং তার ছেলে বন্ধুকে হত্যার পরিকল্পনা করে।
“মামলাটির তদন্ত করা ছিল খুব কঠিন, কারণ আমাদের পাওয়া তথ্য-উপাত্ত অনেক বিশেষজ্ঞের মতামতকে সমর্থন করছিলো না। কিন্তু যেভাবে আমরা সত্য উদঘাটন করেছি তাতেই প্রমাণ হয় যে- এটা ছিল পূর্ব পরিকল্পিত হত্যা”, মহিদুল ইসলাম দি ডেইলি স্টারকে বলেন।
২০১৬ সালের ২২ এপ্রিল রাজশাহীর ‘হোটেল নাইস ইন্টারন্যাশনাল’-এর একটি কক্ষে দুজন শিক্ষার্থীকে মৃত অবস্থায় উদ্ধার করে পুলিশ। তারা হলেন- রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী সিরাজগঞ্জের মিজানুর রহমান (২২) এবং পাবনা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থী সিরাজগঞ্জের সুমাইয়া নাসরিন (২০)।
এ ঘটনায় সুমাইয়ার বাবা বোয়ালিয়া থানায় অজ্ঞাত আসামিদের বিরুদ্ধে একটি হত্যা মামলা দায়ের করেন।
দশ মাস ধরে তদন্ত করে বোয়ালিয়া থানার পুলিশ এ মামলায় চূড়ান্ত প্রতিবেদন দাখিল করে। প্রতিবেদনে বলা হয় যে, সুমাইয়াকে ধর্ষণ করে হত্যা করার পরে সিলিংয়ে ঝুলে আত্মহত্যা করেন মিজানুর। এই প্রতিবেদনের ভিত্তি ছিল মিজানুরের ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন, যেখানে মিজানুরের মৃত্যু ‘আত্মহত্যা প্রকৃতির’ বলে উল্লেখ রয়েছে।
কিন্তু রাজশাহীর একটি আদালত পুলিশের এই প্রতিবেদন গ্রহণ করতে অস্বীকৃতি জানান, কারণ ওই আদালতের পাবলিক প্রসিকিউটর প্রশ্ন তোলেন যে, মৃত ব্যক্তিদের সুরতহালের সময় বিভিন্ন জব্দকৃত আলামতের সঙ্গে ময়নাতদন্ত ও পুলিশের প্রতিবেদনের ভিন্নতা রয়েছে।
২০১৭ সালের ১৭ এপ্রিল আদালত মামলাটি পুনরায় তদন্তের জন্য পিবিআইকে নির্দেশ দেন।
দায়িত্ব পেয়ে তদন্তকারী কর্মকর্তা প্রথমেই নজর দেন পুলিশের প্রতিবেদনে উল্লেখ করা একটি সুইসাইড নোটের দিকে।
তদন্তকারী কর্মকর্তা মহিদুল ইসলাম বলেন, “পুলিশের প্রতিবেদনে বলা হয়েছিল যে, মিজানুর আত্মহত্যার আগে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে একটি সুইসাইড নোট দিয়েছিলেন। কিন্তু পিবিআইয়ের সাইবার ক্রাইম ইউনিট মতামত দেয় যে, মিজানুর নিজে এ ধরণের কোনো পোস্ট দেননি।”
“পিবিআই ক্রাইম সিন ইউনিটের তোলা ঘটনাস্থলের ছবিগুলো পর্যালোচনা করে দেখা যায় যে, মিজানুরের মৃতদেহ সুমাইয়ার একটি ওড়নায় ঝুলছিলো, কিন্তু সুমাইয়ার আরেকটি ওড়নায় তার দুহাত পিছনে বাধা ছিলো। হাত বাধা অবস্থায় একজন মানুষ আত্মহত্যা করতে পারে না”, যোগ করেন মহিদুল।
মিজানুরের ময়নাতদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে যে, তার গলায় যে দাগ দেখা গেছে সেটি আত্মহত্যাই প্রমাণ করে। কিন্তু ময়নাতদন্তে নিহতের গলার দু’পাশের গুরুত্বপূর্ণ রক্তজমাট কালশিরা জখমের কোনো উল্লেখ ছিলো না বলে পিআইবির অভিযোগপত্রে বলা হয়েছে।
অপরদিকে ক্রাইম সিন ইউনিট সুমাইয়াকে একটি বিছানায় শায়িত অবস্থায় পেয়েছিলো এবং তার মুখে বালিশ চাপা দেওয়া ছিলো। বালিশের সাদা কভারে খুনির রক্তমাখা হাতের স্পষ্ট ছাপ পাওয়া গিয়েছিলো, কিন্তু মিজানুরের হাতে রক্তের কোন চিহ্ন ছিলো না। এ কারণে পুলিশের পূর্বের তদন্তে বলা হয়েছিলো যে, মিজানুর আত্মহত্যার আগে সুমাইয়াকে হত্যা করেছিলো- সেটা ভুল প্রমাণ হয়।
এছাড়াও হোটেলের কক্ষে চারটি ভিন্ন ব্রান্ডের সিগারেটের টুকরা পাওয়া গিয়েছিলো, যা ওই কক্ষে খুনিদের উপস্থিতি প্রমাণ করে।
তদন্তকালীন সময়ে পিবিআই নিহতদের ফোনের এবং আরও কয়েকজন সন্দেহভাজন ব্যক্তির কল রেকর্ড পর্যালোচনা করে অভিযুক্ত ব্যক্তিদের চিহ্নিত করে এবং তাদের গ্রেফতার করে।
অভিযুক্তদের মধ্যে হাবীব ও উৎস আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দী প্রদান করে হত্যাকাণ্ডে নিজেদের জড়িত থাকার কথা স্বীকার করেন। পরে আরও একজন অভিযুক্ত নয়ন দোষ স্বীকার করে জবানবন্দী দেন।
তদন্তে উঠে আসে, ঘটনার দিন ২১ এপ্রিল হোটেল কর্মচারীদের ঘুষ দিয়ে প্রধান চার অভিযুক্ত শীতাতপ নিয়ন্ত্রণ যন্ত্রের গ্রিল কেটে নিহতদের হোটেল কক্ষে প্রবেশ করেন। তারা চারজন মিজানুরের সামনেই সুমাইয়াকে ধর্ষণ করেন এবং পরে তাদের দুজনকে নির্যাতন করে হত্যা করেন।
পিবিআইয়ের অভিযোগপত্রে ভুল পুলিশি প্রতিবেদন ও ময়নাতদন্ত প্রতিবেদনের জন্য কাউকে অভিযুক্ত করা হয়নি। পিবিআই কর্মকর্তারা জানান, এটি তাদের তদন্তের বিষয় ছিলো না।
“পূর্বের প্রতিবেদনগুলো ছিল তথ্যগত ভুল এবং আমাদেরকে এ বিষয়ে কোনো তদন্ত করতে বলা হয়নি’, বলেন তদন্তকারী কর্মকর্তা মহিদুল ইসলাম।
Comments