শতবর্ষী গাছের বন ধ্বংস করে প্রশিক্ষণ একাডেমি

রাজশাহীর কারাগার মাঠের কথা হয়ত জানা আছে অনেকেরই। ছোটবেলায় বড়দের হাত ধরে ওই মাঠে গিয়েছি, খেলেছি। ছায়ায় বসে অন্যদের খেলা দেখেছি। আজ এক অগ্রজ সাংবাদিক সে মাঠের কথা পুনরায় মনে করিয়ে দিলেন।
rajshahi trees
কারা প্রশিক্ষণ একাডেমি নির্মাণের জন্য সিপাইপাড়া এলাকায় গাছ কাটছে রাজশাহীর কারাগার কর্তৃপক্ষ। ছবি: সংগৃহীত

রাজশাহীর কারাগার মাঠের কথা হয়ত জানা আছে অনেকেরই। ছোটবেলায় বড়দের হাত ধরে ওই মাঠে গিয়েছি, খেলেছি। ছায়ায় বসে অন্যদের খেলা দেখেছি। আজ এক অগ্রজ সাংবাদিক সে মাঠের কথা পুনরায় মনে করিয়ে দিলেন।

কারা কর্তৃপক্ষের মালিকানায় থাকলেও সেই ব্রিটিশ আমল থেকেই মাঠটি স্থানীয়রা ব্যবহার করতেন। নব্বইয়ের দশকের শেষে প্যারেড গ্রাউন্ড করার জন্য কারাগার কর্তৃপক্ষ মাঠটি করায়ত্ত করতে চাইলে, ফুসে উঠেছিল স্থানীয় মানুষ। মাঠটি সর্বসাধারণের ব্যবহারের দাবিতে মিছিল-মিটিংয়ে সরগরম হয়েছিল রাজশাহী। পালন করা হয়েছিলো হরতাল। মাঠ বাঁচাতে এক মুক্তিযোদ্ধা নিজের শরীরে আগুন ধরিয়ে দেওয়ার হুমকিও দিয়েছিলেন। সেসব ঘটনার খবর স্থান পেয়েছিল স্থানীয় ও জাতীয় পত্রিকায়। ওই অবস্থায় তৎকালীন রাজশাহীর মেয়র বাধ্য হয়ে নোটিস ঝুলিয়ে দিয়েছিলেন, মাঠটি সাধারণেরই থাকবে। যদিও শেষ পর্যন্ত আর থাকেনি।

পদ্মাপাড়ের শহরটির কারাগার কর্তৃপক্ষ আবারো আলোচনায় এসেছে সিপাইপাড়া এলাকায় তাদের একটি বাগান ধ্বংস করতে গিয়ে। একবারে ৫৬১টি গাছ কেটে ফেলা হচ্ছে। গাছ কেটে সেখানে কারা প্রশিক্ষণ একাডেমি নির্মিত হবে। একাডেমিটি ময়মনসিংহে হওয়ার কথা ছিল। রাজশাহীর মেয়র এএইচএম খায়রুজ্জামান লিটনের উদ্যোগের কারণে সেটি রাজশাহীতে হচ্ছে। কারা কর্মকর্তাদের বাসভবন, কারারক্ষীদের ব্যারাকও হবে এখানে। এখানকার গাছের অনেকগুলো শতবর্ষের ঐতিহ্য বহন করছে। কড়ই, মেহগনি, তেঁতুল গাছই বেশি। দামি দামি গাছ। ৫৬১টি। মাত্র ১৯ লাখ টাকায় নিলামে বিক্রি করা হয়েছে।

যতদূর জানা গেছে গত এক সপ্তাহে ৬৬টি গাছ কেটে ফেলা হয়েছে। নানান গাছের এই ঐতিহ্যবাহী বন এখন কাটা গাছের গুড়ির মাঠে পরিণত হয়েছে। হাজার হাজার পাখী বাসা বেঁধেছিল সে গাছগুলোতে। স্থানীয়ভাবে পাখি কলোনি নামেও পরিচিত ছিল এই বন। রং-বেরঙের পাখি। তিন ধরনের টিয়া পাখী ছিল। টিয়া পাখীগুলো যখন দল বেঁধে পদ্মা নদীর চরে ভুট্টা ক্ষেতে বসত, সেটি দেখার জন্য অনেকে ভিড় জমাতেন। গাছগুলোর চূড়ায় বসত অগুনতি শামখোল ও নিশিবক।

গাছগুলোর কারণে নদী-পাড়ের ওই এলাকার পরিবেশ শহরের সব এলাকা থেকে ভিন্ন ছিল। সময় পেলেই মানুষ প্রাকৃতিক সৌন্দর্যমন্ডিত ওই এলাকায় ছুটে যান। এত মানুষের ভিড় হয় যে ছুটির দিনে সেখানে পা ফেলা যায় না। মানুষের সমাগমে সেখানে বেশকয়টি ক্যাফেটেরিয়া তৈরি হয়েছে। স্বাভাবিকভাবেই গাছগুলো কেটে ফেলা ঠেকাতে বর্তমান সময়ে যাদের সুমতি আছে তারা ফুসে উঠলেন। রাজশাহীবাসী ব্যানারে তারা কাটা গাছগুলোর সামনে রাস্তায় দাঁড়ালেন, বললেন- “গাছ ও পরিবেশের জন্য আমরা, পরিবেশ বিধ্বংসী উন্নয়ন চাই না।” দেখা করলেন শহরের মেয়রের সঙ্গে। মেয়রের অনুরোধে কারা কর্তৃপক্ষ বন্ধ করলেন গাছ কাটা।

rajshahi trees
শতবর্ষের ঐতিহ্য বহনকারী গাছগুলোকে বাঁচাতে স্থানীয়দের মানববন্ধন। ছবি: সংগৃহীত

তবে জানা গেল এ সিদ্ধান্ত সাময়িক। যারা বিরোধিতা করছেন তাদের বোঝানো না গেলে, একাডেমিটি ময়মনসিংহে স্থানান্তর করার কথাও প্রচার করা হচ্ছে। আসলে কর্তৃপক্ষ যে কোনো উপায়ে গাছগুলো কেটে ফেলতে চাইছেন। সেকারণেই প্রচারণা চালাচ্ছেন, বিরোধিতা করলে উন্নয়ন হবে না।

বোঝা যাচ্ছে কর্তৃপক্ষ গাছ, পাখী, পরিবেশ, স্থানীয় মানুষের মানবিক চাহিদা কোন কিছুই গায়ে মাখতে রাজি নয়। উন্নয়ন কর্মটি করবেনই। অপরদিকে আন্দোলনকারীরাও সতর্ক দৃষ্টি রাখছেন, যেন গাছ কাটা আবার শুরু না হয়।

উন্নয়নের অজুহাতে চারিদিকে গাছকাটার মত প্রকৃতি বিধ্বংসী ও অমননশীল কর্মকাণ্ড প্রায়শই ঘটছে। গত বছর যখন মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি বিজড়িত ঐতিহাসিক যশোর রোডের গাছগুলো কাটার কথা উঠেছিল, দেশের সবপ্রান্ত থেকে অনেক মানুষ সে সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করেছিলেন। নওগাঁ-রাজশাহী, রংপুর-সিরাজগঞ্জ রোডের দু’পাশের হাজার হাজার গাছ আজ আর নেই। সিলেট, চট্টগ্রামেও প্রকৃতি ধ্বংসের কথা শোনা যায়।

২০১৬ সালে জাতিসংঘের বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্যে বিশ্বের সবচেয়ে দূষণমুক্ত শহর হিসেবে যে রাজশাহীর নাম উঠে আসে, গাছ কাটার মহোৎসবে সেখানকার পরিবেশে আজকাল নিঃশ্বাস নেওয়াও কষ্টকর হয়ে উঠছে। শহরটির প্রধান সড়কগুলোর অন্যতম গ্রেটার রোডের গাছগুলো নেই। গাছও নেই, ছায়াও নেই। জাতীয় নেতা এএইচএম কামারুজ্জামানের নামে যে চিড়িয়াখানা রাজশাহীতে আছে সেখানে নিবিড় বন ছিল। গাছপালার ফাঁকে ফাঁকে ছিল পশু পাখীদের বাসা। এখন সে বন অর্ধেক হয়ে গেছে। বাকী অর্ধেক জমিতে অনেক শতবর্ষী গাছ কেটে তৈরি হচ্ছে বঙ্গবন্ধুর নামে একটি নভোথিয়েটার। একটি নভোথিয়েটার রাজশাহীতে হোক সেটি সেখানকার সকলেই চান। তাই বলে শতবছরের বন উজাড় করে করতে হবে?

লেখক: দ্য ডেইলি স্টারের নিজস্ব প্রতিবেদক, রাজশাহী

Comments

The Daily Star  | English

Abu sayed’s death in police firing: Cops’ FIR runs counter to known facts

Video footage shows police shooting at Begum Rokeya University student Abu Sayed, who posed no physical threat to the law enforcers, during the quota reform protest near the campus on July 16. He died soon afterwards.

10h ago