‘মুকুটটা তো পড়েই আছে, রাজাই শুধু নেই'

Manna Dey
মান্না দে। ছবি: সংগৃহীত

যৌবনে প্রেমে পড়েছে আর বিরহের গান গায়নি গুনগুনিয়ে এমন বাঙালি ছেলে বা মেয়ে কি পাওয়া যাবে? আর বিরহের গান মান্না দে ছাড়া!- চিন্তাই করা যায় না।

আড্ডাপ্রিয় বাঙালির তো আড্ডাতে কফি হাউজের গানটি রীতিমত আড্ডা-সংগীত। বাঙালির অনুভূতির যতো ধরনের প্রকাশ রয়েছে তা মান্না দে ছাড়া আর কে এতো দরদ দিয়ে গেয়েছেন- জানা নেই। ভক্তিগীত, পল্লীগীতি, ক্ল্যাসিক, টপ্পা, ভজন, চটুল গান- কী গাননি তিনি? সমস্ত সুধা ঢেলে দিয়েছেন ভক্তদের তৃষ্ণা মেটাতে। তিনি তো গেয়েছেনই অভিনন্দন নয়, প্রশংসা নয়, নয় কোনো সংবর্ধনা, মানুষের ভালোবাসা পেতে চাই আমি- চাই শুধু শুভকামনা। মানুষ দিয়েছেনও দুহাত ভরে। তাইতো তার জন্মশতবার্ষীকিতে শুধু কলকাতাতেই একশোর বেশি অনুষ্ঠান হচ্ছে।

মান্নার শারীরিক বিদায় হয়েছে তাও ছয় বছর হতে চললো। কিন্তু, এখনো মনে হয় তিনি বলছেন ‘আবার হবে তো দেখা, এ দেখাই শেষ দেখা নয়তো।’ সত্যিই তাই। প্রতিদিন দেখি প্রায়ই শুনি, মানুষকে শুনতে বলি।

এতো বড় মাপের মহান শিল্পী তার ৯৪ বছর বয়সে গেয়েছেন মাত্র ৪,০০০ এর মতো গান। তার বড় কারণ সে সময়টাতে মোহাম্মদ রফি, কিশোর কুমার, মুকেশ এদের সুরেলা কণ্ঠের দাপট বলিউডে, মিউজিক ইন্ডাস্ট্রিতে। এদের জনপ্রিয়তা যখন তুঙ্গে সে সময় নিজের জন্যে আলাদা জায়গা করা ছিলো তার জন্যে বড় চ্যালেঞ্জ। তারপরও অনেক সংগীতবোদ্ধা ও ভক্তরা বলেন, ‘মান্না দে বড্ড কম গান গেয়েছেন।’

ব্যাপারটি তার কানেও বহুবার গিয়েছে। নিজের আত্মজীবনী ‘আমি নিরালায় বসে’ বইয়ে তিনি বলেছেন, “শ্রোতারা আমাকে অত্যন্ত ভালোবাসেন বলেই তাদের এমন মনে হয়, আমি বেশি গান গাইবার সুযোগ পাইনি। আমার নিজের তো ধারণা আমি আমার যোগ্যাতার অনেক বেশি পেয়েছি- মানুষের এতো স্বীকৃতি, এতো ভালবাসা।”

তবে এক ধরণের খারাপলাগা তার ছিলো যা তিনি তার বইয়ে লিখেছেন। তার ভাষায়, “প্রতিভা থাকাটাই বোধহয় প্রতিষ্ঠা পাওয়ার শেষ কথা নয়। যোগাযোগ এবং সেই সঙ্গে কমার্শিয়াল অ্যাটিচুড থাকাটাও বোধহয় প্রতিষ্ঠা পাওয়ার জন্য অবশ্যই একটা মেজর ফ্যাক্টর।”

অনেক গান হয়তো গেয়ে যেতে পারেননি, কিন্তু যা গেয়েছেন তা অনেক বিখ্যাত শিল্পী কয়েক জন্ম সাধনা করেও গাইতে পারবেন কী না আমার সন্দেহ রয়েছে।  মোহাম্মদ রফি একবার বলেছিলেন, “আপনারা আমার গান শোনেন, আর আমি শুনি শুধু মান্না দের গান।”

গানের গলা বিচারে মান্না দে হয়তো অনেকের কাছে খুব মিষ্টি গলার শিল্পী ছিলেন না। কিন্তু, সমসাময়িক সকলেই মান্না দে-কেই সুরের হিসাবে সেরা মেনে নিয়েছন। পদ্মশ্রী, পদ্মবিভূষণ, দাদা সাহেব ফালকেসহ অনেক সম্মাননায় তিনি সম্মানিত।

প্রবোধ চন্দ্র দে থেকে মান্না দে হয়ে উঠা মোটেও সহজ ছিলো না। একদম ছোটবেলাতেই কাকা বিখ্যাত শিল্পী কৃষ্ণ চন্দ্র দের কাছে সংগীতের হাতেখড়ি। তারপর বিখ্যাত ধ্রুপদী গায়ক দবির খানের কাছে হিন্দুস্তানি ক্ল্যাসিকালের তালিম নিয়েছেন। ১৯৪২ সালে কাকার হাত ধরে মুম্বাই শহরে গিয়ে তারই কাকার শিষ্য আরেক বিখ্যাত সংগীতজ্ঞ শচীন দেব বর্মনের অধীনে সহকারী সংগীত নির্দেশক হয়ে কাজ শুরু করেন৷ কিন্তু, তিনি সংগীতের প্রশিক্ষণ বন্ধ করেনি। হিন্দুস্থানি ক্ল্যাসিকালের দুজন বিখ্যাত শিল্পী উস্তাদ আমন আলি খান এবং উস্তাদ আবদুল রহমান খানের কাছে দীক্ষা নিয়েছেন নিয়মিত।

ফলে যেটা হলো যখনই কোন রাগাশ্রয়ী গান বা কঠিন কোনো সুরের গান হতো, ডাক পড়ত মান্না দের। তার হাত ধরেই মুলত উচ্চাঙ্গের ধ্রুপদী গায়কী জনপ্রিয়তা পায়। যারা উচ্চাঙ্গ সংগীত বোঝেন না, রাগ-রাগীনি সম্পর্কে ধারণা নেই তারাও মান্নাদের কঠিন কঠিন সব গান শুনে আন্দোলিত হন। হোক সেটা ঠুমরী কিংবা গজল কিংবা কাওয়ালি কিংবা যাত্রাপালার গান।

দেহত্যাগ করার আগ পর্যন্ত মান্না দে যখনই গান গেয়েছেন তার গলার স্বরে কিন্তু বার্ধক্য ধরা পড়েনি। তার কারণ মান্না দে নিজেই বলেছেন, “এটা স্বতন্ত্র উপস্থাপন, স্বতন্ত্র মনোভাবের বিষয়। আমি একটি সাধারণ গৃহস্থঘরের ছেলে। সেভাবেই মানুষ হয়েছি, লেখাপড়া করেছি, সেভাবেই জীবনকে দেখতে ও চলতে শিখেছি। তবে এটা ঠিক, কারও মধ্যে যদি প্রতিভা থাকে, তবে সে কিছু হতে পারবে। আমার কাকা আমার ভেতর হয়তো সে রকম প্রতিভা দেখেছিলেন। তিনিই আমাকে টেনে এনে একদিন বলেছিলেন, ‘গান শেখো।’ গানের জগতে এগিয়ে যাওয়ার জন্য তিনিই আমাকে রাস্তা দেখিয়েছিলেন। সে জন্য হয়তো আজও গাইছি।”

সারাজীবন গান গেয়েছেন, গানে খুঁজেছেন বৈচিত্র্য, সুরের রং, নাটকীয়তা। গান গেয়ে মানুষকে নাচিয়েছেন, আবার একই কন্ঠে বিরহের গান গেয়ে মানুষকে কাঁদিয়েছেন।

গানের রাজা, সুরের রাজা। গেয়েছেনও রাজার মতো ‘মুকুটটা তো পড়েই আছে, রাজাই শুধু নেই।’ সেই রাজার গান আজ সারাবিশ্বের কোথাও না কোথাও বাজছে, ‘মেরা সব কুছ মেরা গীত রে/ গীত বিনা কৌন মেরা মিত রে?’

Comments

The Daily Star  | English
Bangladesh RMG sector

RMG sector on edge as tariff talks make no headway

The diverging outcomes threaten to create a multi-tiered tariff landscape in Asia, placing nations like Bangladesh at a serious disadvantage in the US market.

10h ago