শিক্ষকদের দলীয় আনুগত্য বিশ্ববিদ্যালয়ের মানোন্নয়নে বাধা
বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক নিয়োগের ক্ষেত্রে প্রার্থীদের ছাত্রজীবনে ভালো ফলাফল গুরুত্ব পাবার কথা থাকলেও তাদের বাদ দিয়ে দলীয় বিবেচনায় ‘ভোটার’ নিয়োগের প্রবণতা দিন দিন বাড়ছে। ১৯৭৩ এর অধ্যাদেশের বাইরে রয়েছে যেসব বিশ্ববিদ্যালয় সেখানে সব ক্ষমতা উপাচার্যের হাতে কেন্দ্রীভূত। সেই উপাচার্য যেহেতু দলীয় আনুগত্যে মনোনীত হন, তাই শিক্ষকদের স্বাভাবিক মত প্রকাশের স্বাধীনতা নেই। সব বিশ্ববিদ্যালয়েই গণতান্ত্রিক উপাদানের ঘাটতি রয়েছে ও প্রশাসনব্যবস্থা কেন্দ্রীভূত।
‘বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক নেটওয়ার্ক’-এর উদ্যোগে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে অনুষ্ঠিত ‘কেমন বিশ্ববিদ্যালয় চাই: উচ্চশিক্ষা, নীতিমালা, কাঠামো’ শীর্ষক দুই দিনব্যাপী এক কনভেনশন নিয়ে আজ শনিবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্লাবে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে এসব সংকটের কথা বলেছেন এই উদ্যোগের সঙ্গে যুক্ত শিক্ষকরা।
সংবাদ সম্মেলনে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ বলেন, দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে শিক্ষা বা গবেষণার চেয়ে সরকারদলীয় আনুগত্য প্রধান হয়ে দাঁড়িয়েছে। এতে শিক্ষকতার মান, শিক্ষার্থীদের সুযোগ ও গবেষণার মতো বিষয়গুলো বড় ধরনের বিপর্যয়ের মুখে পড়েছে।
তিনি বলেন, সরকার বিশ্ববিদ্যালয়কে ভয় পায়। সরকার মনে করে, বিশ্ববিদ্যালয়ে যে চিন্তা ও জ্ঞান তৈরি হয়, তাকে যদি নিয়ন্ত্রণ করে কর্তৃত্বের মধ্যে রাখা না যায়, সেই চিন্তা ও জ্ঞান তাদের পক্ষে না-ও যেতে পারে। এ কারণেই সব সরকারের আমলে বিশ্ববিদ্যালয়কে নিয়ন্ত্রণের একটি প্রবণতা দেখা যায়। সেই চেষ্টার অংশ হিসেবে উপাচার্যদের হাতে ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত করা হয়, সরকারদলীয় ছাত্রসংগঠনকে একচেটিয়া ক্ষমতা দেওয়ার চেষ্টা করা হয়।
বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে নিপীড়ন-বৈষম্যের বিরুদ্ধে ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতার পক্ষে কাজ করা শিক্ষকদের দ্বারা তৈরি ‘বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক নেটওয়ার্ক’ এই গত মাসের ১১-১২ তারিখে কনভেনশনের আয়োজন করেছিল। এতে বাংলাদেশে উচ্চশিক্ষায় নানা সংকট, সীমাবদ্ধতা নিয়ে যেমন আলোচনা হয়েছে তেমনি এ থেকে উত্তরণে কিছু সমাধান প্রস্তাবও দেওয়া হয়েছে।
বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের মূল্যায়ন প্রসঙ্গে বলা হয়, সব বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় সমরূপ বা হোমোজেনাস নয়। তাদের মধ্যে কয়েকটির মান যথেষ্ট উন্নত হলেও টিউশন ফি অত্যন্ত বেশি। বেশিরভাগেরই মান বেশ নিম্ন। এই বিশ্ববিদ্যালয়গুলো মুনাফামুখী, সে তুলনায় মান অর্জনে আগ্রহ কম। এই বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে গবেষণার পরিবেশ গড়ে ওঠেনি।
শিক্ষকদের কনভেনশনের বিভিন্ন অধিবেশনে বাংলাদেশে উচ্চশিক্ষায় যেসব সংকটের কথা উঠে এসেছে তার মধ্যে রয়েছে, বিশ্ববিদ্যালয়ের ওপর সরকারি কর্তৃত্ব; নয়া উদারবাদী নীতি ও ইউজিসির কৌশলপত্র; শিক্ষকদের স্বায়ত্তশাসনের অপব্যবহার; শিক্ষায় বরাদ্দ ও গবেষণার অপ্রতুলতা; শিক্ষক নিয়োগ ছাত্র ভর্তি প্রক্রিয়ায় অসংগতি; শিক্ষার্থীদের আবাসন ও ছাত্র রাজনীতিতে সংকটজনক পরিস্থিতি ও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের মুনাফামুখী প্রবণতার মতো বিষয়গুলো।
শিক্ষকরা বলেছেন, ১৯৭৩ এর অধ্যাদেশকে বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বায়ত্তশাসনের জন্য বড় অর্জন হিসেবে বিবেচনা করা হলেও শতবর্ষ পর বিশ্ববিদ্যালয় কোন স্থানে পৌঁছাবে তার দিকনির্দেশনা এতে ছিল না। অন্যদিকে শিক্ষকদের মত প্রকাশের স্বাধীনতা দেওয়া হলেও এখন মূলত দলীয় রাজনীতি প্রধান হয়ে উঠেছে এবং সরকারদলীয় শিক্ষকদের দাপট বৃদ্ধি পেয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয় হয়ে পড়েছে নির্বাচনকেন্দ্রীক। বছরজুড়ে শিক্ষকদের নানা নির্বাচন লেগেই থাকছে।
এই পরিস্থিতিতে ইউজিসির চলমান কৌশলপত্র (২০০৬-২০২৬) যেখানে বিশ্ববিদ্যালয়ের অভ্যন্তরীণ আয় বৃদ্ধি করতে ও সরকারি বরাদ্দ কমাতে নীতিগত চাপ প্রয়োগ করছে—এর বিপরীতে পাল্টা কৌশলপত্র প্রণয়ন করবে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক নেটওয়ার্ক।
Comments