জিপিএ-৫ আসক্তি ও মূল্যবোধসম্পন্ন মানবসম্পদ

সন্তান ভূমিষ্ঠ হওয়ার পরে সব বাবা-মা’ই বলেন সন্তানের জন্য দোয়া করবেন যেন মানুষের মত মানুষ হয়। যখন স্কুলে ভর্তি হওয়ার চেষ্টায় তখন বলেন আশীর্বাদ করবেন যেন ভালো একটা স্কুলে সুযোগ পায়। তারপরের ধাপে বলেন মেয়েটা পড়াশোনা করে না ঠিকমতো, ছেলেটা কথা শোনে না। কী যে রেজাল্ট করবে পরীক্ষায় আল্লাহই জানেন। এই হলো মোটা দাগে আমাদের অভিভাবকদের অবস্থা। কিছু ব্যতিক্রমও আছে, তবে তা হাতে গোনা।

সন্তান ভূমিষ্ঠ হওয়ার পরে সব বাবা-মা’ই বলেন সন্তানের জন্য দোয়া করবেন যেন মানুষের মত মানুষ হয়। যখন স্কুলে ভর্তি হওয়ার চেষ্টায় তখন বলেন আশীর্বাদ করবেন যেন ভালো একটা স্কুলে সুযোগ পায়। তারপরের ধাপে বলেন মেয়েটা পড়াশোনা করে না ঠিকমতো, ছেলেটা কথা শোনে না। কী যে রেজাল্ট করবে পরীক্ষায় আল্লাহই জানেন। এই হলো মোটা দাগে আমাদের অভিভাবকদের অবস্থা। কিছু ব্যতিক্রমও আছে, তবে তা হাতে গোনা।

শিক্ষার্থীদের এতোটাই চাপে রাখা হয় যে, মাঝে মাঝে তা আত্মহত্যায় রূপ নেয়। ছোট থেকে যত বড় হয় তার ওপর বাবা-মার চাপ, আত্মীয় স্বজনের চাপ, সমাজের চাপ- একেবারে চিড়েচ্যাপটা, স্যান্ডউইচ রূপ নেয়। চাপ একটাই যেকোনো মূল্য জিপিএ-৫ পেতে হবে। শিশুদের মনে এমনভাবে গেঁথে যাচ্ছে যে জীবনের একমাত্র লক্ষ্য জিপিএ-৫। তা যেকোনো মূল্যই হোক।

শিক্ষকদের অবস্থা আরেক কাঠি সরেস। রাস্তার মোড়ে মোড়ে বিজ্ঞাপনের ছড়াছড়ি “জিপিএ-৫ পাওয়ার গ্যারান্টি সহকারে পড়াই”। কোচিংয়ে ছাত্রছাত্রী বাবা-মায়েদের লম্বা লাইন অমুক স্যারের কাছে পড়াতে হবে, তাহলে সন্তান ভালো রেজাল্ট করবে। ক্লাসের পড়ানো বাদ দিয়ে শিক্ষকদের মনোযোগ কোচিংয়ে, প্রাইভেট টিউশানিতে। গোল্লায় যাক ক্লাস, কোচিংটা যেন ঠিকঠাক চলে। আর দিনদিন যেন ছাত্র-ছাত্রী বাড়ে। যেন দোকানে কাস্টমার স্বয়ং মা লক্ষ্মী।

অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছে যে পড়ালেখা মানেই জিপিএ-৫। ভালো ছাত্রের সংজ্ঞা ওই জিপিএ-৫। ভালো ছেলে মানেই পড়ালেখায় ভালো অর্থাৎ আবারো সেই জিপিএ-৫। অভিভাবক ও শিক্ষার্থী সবারই চিন্তা, চেতনায়, ধ্যানে, জ্ঞানে, মননে- সর্বত্র ওই একই চিন্তা জিপিএ-৫।

আমরা হাপিত্যেশ করি সমাজে ভালো মানুষের সংখ্যা কম বলে, কিন্তু আমরা সন্তানদের কে শিক্ষা দিচ্ছি ভালো রেজাল্টের জন্যে। হিপোক্রেসির চূড়ান্ত।

পড়ালেখার উদ্দেশ্য কি শুধু ভালো ফল, আর ভালো ফলের সংজ্ঞা কি জিপিএ-৫? তা নিশ্চয়ই নয়। তবে আমরা করে ফেলেছি এমনই।

পড়াশোনা করতে হবে নিজেকে জানার জন্য, সমাজকে বোঝার জন্য, রাষ্ট্রের প্রতি কর্তব্য পালনের জন্য, বিশ্বকে চেনার জন্য। নতুন কিছু শেখার জন্য। কারণ তা মানুষের চিন্তার প্রসার ঘটায়, কল্পনাশক্তিকে করে প্রখর, একই জিনিস অন্যদের চেয়ে ভিন্নভাবে দেখতে শেখায়, জানতে শেখায়। মানুষের বোধশক্তি বাড়ায়, মনুষত্ববোধ তৈরি করে- যা আজকের দিনে সবচেয়ে বেশি জরুরী। কিন্তু আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থায় যা অনুপস্থিত।

ভালো ফল মানেই ভালো ছাত্র নয়। সাজেশন, মুখস্থ, কিংবা গাইড এর উপর নির্ভর করে পড়ার মাধ্যমে ভালো ফল করা সম্ভব। সেক্ষেত্রে জানার পরিধি থাকে সীমিত। আর তার ফলাফল কিন্তু দিনশেষে ভয়াবহ। মনে আছে তো ভারতের বিখ্যাত তরুণ লেখক চেতন শর্মার বই ‘ফাইভ পয়েন্টস সামওয়ান’ এর কথা। যার উপর ভিত্তি করে বলিউড পরিচালক রাজকুমার হিরানি ‘থ্রি ইডিয়টস’ ছবিটি তৈরি করেন ২০০৯ সালে। তিন বন্ধুর ভূমিকায় অভিনয় করেছিলেন আমির খান, মাধবন এবং শারমন যোশী। সিনেমার মধ্য দিয়ে ভারতীয় শিক্ষা ব্যবস্থাকে আমূল নাড়া দেয় ‘থ্রি ইডিয়টস’। গৎবাঁধা পড়ালেখার মুখে দুর্দান্ত চপেটাঘাতও এই ছবিটি। মুখস্থ বিদ্যার ভয়াবহতা, সঙ্গে ত্রুটিপূর্ণ পরীক্ষা ব্যবস্থার এক করুন চিত্র ফুটিয়ে তোলা হয়েছিল সিনেমায়।

ডাক্তার কিংবা ইঞ্জিনিয়ার কিংবা বড় কূটনৈতিক তো অনেকেই হন। কিন্তু সত্যিকারের মানুষ? পেশাগত সাফল্য এলে যেকোনো ব্যক্তি প্রকৃত মানুষ হবেন, তেমনটা মনে করার কোনো কারণ নেই। থ্রি ইডিয়টস সেটাই যেন চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়েছে।

জিপিএ-৫ এর নামে ছোট ছোট শিশুদের মাথায় ঢুকিয়ে দিচ্ছি অসুস্থ প্রতিযোগিতা। শিক্ষা দিচ্ছি  আত্মকেন্দ্রিক হবার। কী পড়ছো কাছের বন্ধুটিকে বলা যাবে না, কোনকিছু শেয়ার করা যাবে না। এরকম দীক্ষা আর মানসিকতা দিয়ে একা একা কি খুব বেশিদূর যাওয়া যায়?

এতো জিপিএ-৫, এতো মেধাবী জাতি আমরা ভাবতেই কেমন গায়ে শিহরণ দিচ্ছে। এই যে বছর বছর এতো জিপিএ-৫ পায় তাতে আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থা কতটুকু এগুলো আর প্রতিষ্ঠানগুলোরই বা কী অবস্থা? আসুন একবার দেখি।

যুক্তরাজ্যের লন্ডনভিত্তিক উচ্চশিক্ষা নিয়ে গবেষণা করে এমন একটি সাপ্তাহিক পত্রিকা টাইমস হায়ার এডুকেশন এশিয়াতে উচ্চমানের বিশ্ববিদ্যালয়ের তালিকা করেছে। প্রকাশনাটি ২০১৯ সালের যে তালিকা দিয়েছে সেখানে এশিয়ার ৪১৭টি বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম রয়েছে। তার মধ্যে বাংলাদেশের কোন বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম নেই। যদিও দেশে অনুমোদিত ৪২টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় এবং প্রায় একশোর মতো বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আছে। কাজাখিস্তান, আফ্রিকার তানজানিয়া কিংবা ইরাকের মতো দেশ জায়গা করে নিয়েছে। পাকিস্তানের ৯টি, ভারতের প্রায় ৫০টি এমনকি ছোট দেশ নেপালের ত্রিভুবন বিশ্ববিদ্যালয়ের নামও রয়েছে। নেই শুধু উন্নয়নের রোল মডেল বাংলাদেশের নাম।

জিপিএ-৫ এর এই মরণ নেশা আমাদেরকে হ্যামিলনের বাঁশিওয়ালার মতো নিয়ে যাচ্ছে অজানা গন্তব্যে, অন্ধকার ভবিষ্যতের দিকে। দিনরাত ছুটছি স্কুল থেকে কোচিংয়ে, ম্যাথ স্যারের বাসা থেকে ইংরেজি সারের বাসায়- ছুটছি তো ছুটছি, শিক্ষার্থীদের সঙ্গে নিয়ে ফাঁস হওয়া প্রশ্নপত্রের পেছনে অভিভাবকরা ছুটছি। সোনালী শৈশব আর দুরন্ত কৈশোর বাঁধা পড়ে আছে স্কুলে, কোচিংয়ে, স্যারের বাসায় আর বাসার পড়ায়। যেন এক যন্ত্র, মানুষ নয়।

জিপিএ-৫ আসক্ত একটি প্রজন্ম তৈরি হচ্ছে বাংলাদেশে। দায় শিক্ষার্থীদের নয়। দায় রাষ্ট্রীয় শিক্ষা ব্যবস্থাপনার। একটি দেশের শিক্ষা ব্যবস্থা চলে শিক্ষানীতি ছাড়া। নীতি একটি করা হলেও তা অনুসরণ করা হয় না। আবার মাদ্রাসা শিক্ষার কোনোরকম উন্নত বা পরিমার্জন না করে স্বীকৃতি দেওয়া হয়। তাদের কথায় মূলধারার শিক্ষাক্রম-পাঠ্যপুস্তক সাম্প্রদায়িকীকরণ রূপ পেয়ে যায়। ফলে প্রকৃত শিক্ষা, বিশ্বমান তো দুরের কথা এশিয়া বা দক্ষিণ এশিয়ার মান থেকেও আমরা দিন দিন পিছিয়ে পড়ছি। আমরা এখন সংখ্যায় বিশ্বাসী, গুণগত মানে নয়। সংখ্যার সাফল্য দিয়ে রাজনীতি করা যায়। গুণগত মানহীন শিক্ষা দিয়ে মূল্যবোধসম্পন্ন জাতি-রাষ্ট্র তৈরি করা যায় না।

Comments

The Daily Star  | English

Over 5,500 held in one week

At least 738 more people were arrested in the capital and several other districts in 36 hours till 6:00pm yesterday in connection with the recent violence across the country.

13h ago