ইচ্ছাকৃতভাবে পাটকলবিরোধী নীতিমালা নেওয়া হয়েছে: আনু মুহাম্মদ

বেতন-ভাতা ও বকেয়া টাকার দাবিতে রাষ্ট্রায়ত্ত পাটকলের শ্রমিকরা আজ (৮ মে) তৃতীয় দিনের মতো আন্দোলন করছেন। সকালে ঢাকার ডেমরা এবং খুলনায় বিক্ষোভকারীদের পথে নামতে দেখা যায়।
Anu Muhammad
অধ্যাপক ড. আনু মুহাম্মদ (বামে)। ঢাকার রাস্তায় লাঠি হাতে পাটকল শ্রমিকরা।

বেতন-ভাতা ও বকেয়া টাকার দাবিতে রাষ্ট্রায়ত্ত পাটকলের শ্রমিকরা আজ (৮ মে) তৃতীয় দিনের মতো আন্দোলন করছেন। সকালে ঢাকার ডেমরা এবং খুলনায় বিক্ষোভকারীদের পথে নামতে দেখা যায়।

ডেমরায় লতিফ বাওয়ানী পাটকল এবং করিম পাটকলের শ্রমিকরা লাঠি হাতে রাস্তায় নামেন এবং সেখানে সুলতানা কামাল সড়ক অবরোধ করেন। ফলে আশপাশের অঞ্চলে তীব্র যানজটের সৃষ্টি হয়।

শ্রমিকরা দুই মাসের বকেয়া বেতনের পাশাপাশি নতুন বেতন কাঠামোর দাবি জানান। সেসময় আন্দোলনরত শ্রমিকরা মজুরি কমিশনের দাবিতে স্লোগান দেন। এই প্রেক্ষাপটে দেশের পাটশিল্প ও পাটশ্রমিকদের স্বার্থ রক্ষার জন্যে করণীয় কী হতে পারে তা জানতে চাওয়া হয় বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. আনু মুহাম্মদের কাছে। তিনি মনে করেন, “মাত্র কয়েকশ কোটি টাকা দিলে পাটকল শ্রমিকদের প্রাথমিক প্রয়োজন মেটানো যেতে পারে। প্রকল্পগুলো ও সরকারি আর্থিক প্রতিষ্ঠানে যে পরিমাণ দুর্নীতি হয়, সেখানে এই পরিমাণ টাকা মোটেই বেশি কিছু নয়।”

আনু মুহাম্মদ দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, “বাংলাদেশ একটি সরকার দ্বারা পরিচালিত হয় তা আমরা দেখি। দেশে একটি দৃশ্যমান সরকার রয়েছে। কিন্তু, অদৃশ্য সরকারও রয়েছে। নীতিনির্ধারণের বিষয়ে দৃশ্যমান ও অদৃশ্য সরকার নির্বিশেষে একই রকম থাকে। নীতিনির্ধারণের বিষয়টি আসে বিশ্বব্যাংক ও আন্তর্জাতিক অর্থ তহবিলের (আইএমএফ) কাছ থেকে। দেশে উপযুক্ত শিল্পায়নের জন্যে যে দূরদৃষ্টি থাকতে হয় তা বাংলাদেশ সরকারের নেই। যার ফলে বিশ্বব্যাংকের চাপে পড়ে পাটকল ও পাটশিল্পবিরোধী বিভিন্ন নীতিমালা নিয়েছে। সংস্থাগুলোর ঋণের টাকা দিয়ে শিল্পকারখানা বন্ধ করা হয়েছে। কোথাও শ্রমিকদের ছাঁটাই করা হয়েছে। ২০০২ সালে পাটকল বন্ধ হওয়ার পর আরও পাটকল বন্ধ হয়েছে ২০০৭-২০০৮ সালের দিকে। তারপর বর্তমান সরকারের সময় সেই ধারাবাহিকতার কোনো পরিবর্তন হয়নি।”

“এখন যে পাটকলগুলো রয়েছে সেগুলোতে শ্রমিক নিয়োগ দেওয়া হয়েছে অস্থায়ী ভিত্তিতে (অ্যাডহক)। পাটকলগুলো বেসরকারিকরণের প্রক্রিয়ার মাধ্যমে পুরো ব্যবস্থাটিকে ছোট করে ফেলা হয়েছে। এখন শ্রমিকদের মজুরি নেই বললেই চলে। তারপরও সেগুলো বকেয়া হিসেবে থাকছে। এরপরও আমরা দেখছি পাটকলগুলোতে লোকসান হচ্ছে। এর একটি মূল কারণ হলো যে সরকার পাটশিল্প বা পাটকলগুলোকে আধুনিকীকরণ ও বহুমুখীকরণের জন্যে কাজ করছে না।”

“আরেকটি কারণ হলো: পাট কেনার প্রক্রিয়াটি বিস্ময়করভাবে এতো বছরে ধরে একই রয়ে গেছে। অর্থাৎ পাট যখন বাজারে আসে সেসময় পাটের দাম কম থাকে। তখন পাট কেনার জন্যে টাকা বরাদ্দ পাওয়া যায় না। যখন পাটের দাম বেড়ে যায় তখন বাজেট দেওয়া হয়। এ নিয়ে অনেক কথা বলার পরও কোনো পরিবর্তন হয়নি। তার মানে হলো- এটি ইচ্ছাকৃতভাবেই করা হচ্ছে। এর ফলে কিছু লোকের লাভ হয়, কিছু লোক দুর্নীতি করার সুযোগ পায়। এ কারণে পাটকলগুলোর খরচ অনেক বেশি বেড়ে যায়। ধীরে ধীরে সেগুলো লোকসানকৃত প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়। শ্রমিকদের মজুরি কম হওয়া সত্ত্বেও তা বকেয়া থেকে যাচ্ছে। এই সমস্যাটি সমাধান করার জন্যে সরকারের উদ্যোগের অভাব বা উদাসীনতা ইচ্ছাকৃত বলেই আমার মনে হয়।”

“বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে চিন্তা করলে পাটশিল্প হচ্ছে সবচেয়ে পরিবেশবান্ধব এবং দেশে শ্রমবাজার সৃষ্টি করতে পারে। এটি কৃষির সঙ্গে সম্পর্কিত। দেশে-বিদেশে পাটজাত পণ্যের চাহিদা বাড়ছে- কেননা, সবাই পরিবেশ সচেতন হওয়ার কথা চিন্তা করছেন। তাই পাটজাত পণ্যের বাজারের কোনো সমস্যা হওয়ার কথা না। বাংলাদেশে দক্ষ জনশক্তি ছিলো। কাঁচামালও রয়েছে। শ্রমিকদের রয়েছে দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞতা। সবকিছু মিলিয়ে বাংলাদেশে পাটশিল্প খুবই অনুকূল অবস্থায় ছিলো। ক্রমান্বয়ে সেটিকে নষ্ট করে এখন এই নাজুক অবস্থায় নিয়ে আসা হয়েছে। অন্যদিকে, ভারতে পাটশিল্পের প্রসার ঘটছে। ভারত এখন বাংলাদেশ থেকে কাঁচাপাট কিনে। বাংলাদেশ হয়তো কাঁচাপাট রপ্তানির দিকেই যাচ্ছে।”

“বাংলাদেশে পাটশিল্পকে আবার দাঁড় করানোর মতো সরকারের কোনো পলিসি বা অবস্থা বা উদ্যোগ নেই। এর পেছনে বিশ্বব্যাংকের নির্দেশনা রয়েছে। এর পেছনে কিছু স্বার্থান্বেষী লোক রয়েছে। এমনকী, এর পেছনে ভারতের হাতও রয়েছে।”

“শ্রমিকরা এসবের শিকার হচ্ছেন- তা আমরা সরাসরি দেখতে পাচ্ছি। তবে দীর্ঘমেয়াদে পুরো বাংলাদেশ ক্ষতিগ্রস্ত হবে এমন। একটি পরিবেশবান্ধব শিল্পায়নের যে সম্ভাবনা ছিলো তা বিপর্যস্ত হচ্ছে।”

এই পাটশ্রমিকদের সমস্যা সমাধানের জন্যে কতো টাকা প্রয়োজন বলে আপনি মনে করেন?- “পাটশিল্প শ্রমিকদের যে বেতন-ভাতা তাতে কয়েকশ কোটি টাকা দিলেই প্রাথমিকভাবে এটি সমাধান করা যেতে পারে। হাজার হাজার কোটি টাকার ব্যাংক ঋণ যেভাবে নষ্ট করা হচ্ছে, যেভাবে বিভিন্ন গোষ্ঠীকে ভর্তুকি দেওয়া হচ্ছে সেই তুলনায় খুবই নগণ্য একটি অংশ বা ১০ ভাগের ১ ভাগ টাকা যদি বাংলাদেশের পাটকলগুলোতে বরাদ্দ করা যায় তাহলে এই শিল্পটি দাঁড়িয়ে যেতো।”

“পাট গবেষণা কেন্দ্র কতো রকমের পাটজাত পণ্যের সম্ভাবনা দেখছে। তারা অনেক পণ্য বেরও করেছে। তার মানে- পণ্যের বহুমুখীকরণের মাধ্যমে পাটশিল্পকে শক্তিশালী করা যেতে পারে। আমাদের শ্রমিকদের অনেক বছরের অভিজ্ঞতা রয়েছে। তারা দেশের সম্পদ। তাদেরকে মজুরি না দিয়ে পথে নামানো হচ্ছে- এটি একটি বড় ধরনের লোকসান। তারা অভিজ্ঞ জনগোষ্ঠী। তাদেরকে বঞ্চিত করার মাধ্যমে বাংলাদেশও বঞ্চিত হচ্ছে।”

তাহলে সমস্যা কোথায়? টাকায় না কী আন্তরিকতায়?- “এখানে আন্তরিকতা শব্দটি ব্যবহার করা যাবে না। এখানে ইচ্ছাকৃতভাবে পাটকলবিরোধী একটি নীতিমালা নেওয়া হয়েছে। সেই নীতিমালার কারণে এটি হচ্ছে। টাকা তো কোনো সমস্যাই না। কারণ, যে পরিমাণ টাকা লাগতো তা এখন বাংলাদেশের যে জাতীয় বাজেট, দেশের প্রকল্পগুলোতে যেভাবে দুর্নীতি বা অপচয় হয় সেই প্রেক্ষিতে পাটকলের জন্যে কয়েকশ কোটি টাকা দিলে তাদের প্রাথমিক প্রয়োজন মেটানো যেতে পারে। যেখানে হাজার হাজার কোটি টাকা লোকসান হচ্ছে, অপচয় হচ্ছে, দুর্নীতি বা পাচার হচ্ছে সেখানে এই কয়েকশ কোটি টাকা তেমন কিছু না।”

সরকারকে এখন কীভাবে এই সমস্যার সমাধান করা উচিত বলে আপনি মনে করেন?- “পাটশিল্প যে বাংলাদেশের জন্যে একটি সম্পদ সেটিকে মাথায় রেখে নীতিমালা নতুন করে সাজাতে হবে। আগে যে ইচ্ছাকৃত নীতিমালার মাধ্যমে পাটশিল্পকে ধ্বংস করা হয়েছে সেটিকে সম্পূর্ণভাবে ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে নতুনভাবে একটি পলিসি নির্ধারণ করতে হবে। পাটশিল্পের উন্নয়ন ঘটাতে হবে, একে বিকশিত করতে হবে। পাটশ্রমিকদের নিয়মিত চাকরির মধ্যে নিয়ে আসতে হবে। এরকম একটি নীতিমালার মধ্যে থেকে এখনি শ্রমিকদের মজুরি সমস্যার সমাধান করতে হবে। এবং সেই মজুরিটি অবশ্যই নূন্যতম মজুরির কাঠামোর মধ্যে আনতে হবে। তারাতো অভিজ্ঞ-দক্ষ শ্রমিক। তাদেরকে কেনো অস্থায়ী চাকরির মধ্যে বা দিনমজুর হিসেবে কাজ করবে?”

পাটশিল্পের উন্নয়নে সরকার তো এখন ‘পাট দিবস’-ও উদযাপন করছে। তাহলে এর কোনো প্রভাব কি থাকছে না এ শিল্পের উন্নয়নে?- “এটি একটি ভণ্ডামি। ‘পাট দিবস’ উদযাপন করা হয়, পাটজাত দ্রব্য নিয়ে ছবি ছাপানো হয়, বিশ্বব্যাংকের পলিসির কারণে যেসব পাটকল বন্ধ হয়ে গেছে সেগুলোর সমালোচনাও কেউ কেউ করেন। কিন্তু, সেই পলিসির তো পরিবর্তন হয়নি। বিশ্বব্যাংকের নির্দেশনায় কোনো পরিবর্তন আসেনি। সেই পলিসির ধারাবাহিকতাতেই আমরা দেখতে পাচ্ছি যে সম্ভাবনাময় পাটশিল্প একটি প্রান্তিক শিল্পে পরিণত হয়েছে।”

Comments

The Daily Star  | English

DMCH doctors threaten strike after assault on colleague

A doctor at Dhaka Medical College Hospital (DMCH) was allegedly assaulted yesterday after the death of a private university student there, with some of his peers accusing the physicians of neglecting their duty in his treatment

4h ago