চলে গেলেন মুক্তিযোদ্ধা সাংবাদিক মাহতাব উদ্দিন

মাহতাব উদ্দিন। ছবি: আনোয়ার আলী

মুক্তিযোদ্ধা ও সাংবাদিক মাহতাব উদ্দিন। সাহিত্যচর্চা, সাংবাদিকতা, সংগীত চর্চা মতো বহুমুখী প্রতিভার কারণে রাজশাহীতে অতি পরিচিত তার নাম। তিনি আর নেই।

দীর্ঘদিন ধরে অসুস্থ ছিলেন। হৃদরোগে ভুগছিলেন। একমাস আগে রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি হবার পর তার পরিবার তাকে ঢাকায় নিয়ে যায়। ধানমন্ডিতে ছেলের বাড়িতে থেকে চিকিৎসাধীন অবস্থায় আজ শনিবার সকাল পৌনে ৮টায় মৃত্যু বরণ করেন তিনি। মৃত্যুকালে তার বয়স হয়েছিল ৮০ বছর। তার আট সন্তানের মধ্যে দুই ছেলে ও চার মেয়ে জীবিত আছেন। মৃত্যুকালে ছেলে মেয়েরা তার পাশেই ছিলেন।

মাহতাব উদ্দিনের লাশ ঢাকা থেকে রাজশাহীতে নেওয়ার পর রোববার রাজশাহীর কেন্দ্রীয় মসজিদে জানাজা অনুষ্ঠিত হবে।

বহুগুণের অধিকারী এই ব্যক্তি তিনশোর মত কবিতা লিখেছেন, লিখেছেন অনেক গল্প, উপন্যাস, প্রবন্ধ। তবে প্রকাশিত গ্রন্থ একটি উপন্যাস, ‘একাত্তরের জবানবন্দী’। তার লিখা দেশের বিভিন্ন পত্র পত্রিকায় ছাপা হয়েছে। তিনি গীতিকারও ছিলেন। তার লিখা অনেক গান স্বাধীনতার আগ থেকে বেতারে বেজে চলেছে।

মাহতাব উদ্দিনের লিখা গান সম্পর্কে গীতিকার ও শিক্ষক অচিন্ত্য কুমার সরকার জানান, ‘গয়না পাখী চাই গো’ যেটি পাকিস্তানী শিল্পী ইফ্ফাত আরা নার্গিস গেয়েছিলেন তৎকালীন পাকিস্তানে খুব জনপ্রিয়তা পেয়েছিল। তিনি মুক্তিযুদ্ধ করেছেন। যুদ্ধ শেষে থেমে যাননি। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাস্তবায়নে আজীবন লড়াই সংগ্রাম করেছেন। মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে গবেষণা করেছেন, তুলে এনেছেন অজানা মুক্তিযোদ্ধাদের কাহিনী। সামাজিক আন্দোলন করেছেন, সাংবাদিকতা করেছেন।

মাহতাব উদ্দিনের ছোট মেয়ে মাধ্যমিক স্কুলে ছিল আমার সহপাঠী। কিন্তু সাংবাদিকতা করতে এসে মাহতাব উদ্দিনকে মাহতাব ভাই বলেই ডাকতাম। মেট্রোপলিটন প্রেসক্লাবে বসতাম আমরা। তখন ক্লাব ছিল বোয়ালিয়া থানার কাছে। দেখতাম ঝড়-বৃষ্টি-রোদ-শীত উপেক্ষা করে মানুষটি কাঁধে একটি ব্যাগ নিয়ে ক্লাবে আসছেন, যাচ্ছেন। ঘণ্টার পর ঘণ্টা বসে লিখছে। মাঝে মাঝে কর্মক্ষেত্রেও দেখা হত। একবার শহর থেকে ১৮ কিলোমিটার দূরের আদিবাসী পল্লী বর্ষাপাড়ায় দেখা হল। পরে জেনেছিলাম সেপথ তিনি হেঁটেই গিয়েছিলেন।

মাহতাব উদ্দিনের জন্ম ১৯৩৯ সালে রাজশাহী শহরের শেখের চক এলাকায়। একই এলাকায় আজীবন বাস করেছেন তিনি।

রাজশাহী ভোলানাথ বিশ্বেশ্বর হিন্দু একাডেমী থেকে মাধ্যমিক পাশ করে পড়েছেন রাজশাহী সিটি কলেজে। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলায় বিএ সম্মান করেছেন।

লেখক মনোরঞ্জন নন্দী বলেন, ষাটের দশকের শেষে মাহতাব উদ্দিন ‘সূর্য শিখা’ নামে একটি সংগঠন প্রতিষ্ঠা করেছিলেন নাটক ও রবীন্দ্র সংগীত চর্চার জন্য। অল্প সময় নাটক সংগীত চর্চা হলেও রাজনৈতিক নেতারাই সেখানে বেশি সময় আড্ডা দিতেন। ফলে অল্প সময়ের মধ্যেই তৎকালীন প্রশাসন সেটি বন্ধ করে দেয়।

মনোরঞ্জন নন্দী আরও জানান, মুক্তিযুদ্ধের সময় মাহতাব ৩০-৩৫ জনের একটি বাহিনীর নেতৃত্ব দিয়েছেন যারা গেরিলা যুদ্ধে অংশ নেন। তাদের প্রশিক্ষণ দিয়েছেন। নন্দী নিজেও ওই বাহিনীর একজন ছিলেন।

“মুক্তিযুদ্ধ শেষ হলেও মাহতাব ভাই তার যুদ্ধ ছেড়ে দেননি। তিনি খুঁজে বেড়িয়েছেন মুক্তিযুদ্ধকালীন তার সতীর্থদের। তারা কে কোথায় কেমন আছেন খবর নিয়েছেন। মুক্তিযুদ্ধ চর্চা কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। যার কাজ ছিল মুক্তিযুদ্ধের অজানা কাহিনী, অজানা মুক্তিযোদ্ধার কথা ও তাদের জীবন সংগ্রামের কাহিনী তুলে আনা ও প্রয়োজনীয় ক্ষেত্রে সাহায্য করা।”

তিনি আরও বলেন, “নব্বইয়ের দশকে তিনি সম্পাদনা করতেন গণখবর নামের এক সাপ্তাহিক। কবি শামসুর রাহমান রাজশাহীতে গিয়ে প্রত্রিকাটি উদ্বোধন করেছিলেন। পত্রিকাটি যে দশ-বারো বছর চালাতে পেরেছিলেন তার বেশিরভাগ সময়েই সেখানে উঠে এসেছে রাজশাহী মানুষের কথা ও মুক্তিযুদ্ধের কথা। এত কিছু মাহতাব ভাই করেছেন, কিন্তু তার কাজের দলিলগুলো তিনি নিজের সংগ্রহে রাখেননি। জিজ্ঞেস করাতে আমাকে বলেছিলেন যেটা করা দরকার মনে করেছি সেটা করেছি। ভবিষ্যতে আমার লাগবে এমন মনে হয়নি বিধায় সংগ্রহে রাখিনি। মাহতাব ভাইয়ের মৃত্যুতে যে শূন্যতা তৈরি হল তা অপূরণীয়।”

Comments

The Daily Star  | English
government action against rising crime

Nationwide combing operation launched to curb rising crime: home adviser

The adviser announced the decision after a meeting on law and order following a series of alarming incidents

51m ago