ধন্যবাদ জাপানিদের, আমন্ত্রণ বাংলাদেশে

Japan
ছবি: সংগৃহীত

দশ বছর আগের ঘটনা। টো‌কিও শহরের এক স্টেশনের কাছে হাতে ম্যাপ নিয়ে শ্রীলঙ্কার এক সাংবাদিক বন্ধুর সাথে একটা ঠিকানা খুঁজছি। কাছাকাছি এসেও খুঁজে না পেয়ে একে ওকে প্রশ্ন করছি। কিন্তু বোঝাতে পারছি না। এর মধ্যেই হঠাৎ কোথা থেকে যেনো উদয় হলেন মধ্যবয়সী এক ভদ্রমহিলা। কাছে এসে জানতে চাইলেন, কী খুঁজ‌ছো? গন্তব্য বলার পর তিনি অনেকটা হেঁটে পথ দেখিয়ে দিলেন। এরপর বললেন, তার খুব জরুরি কাজ আছে। যেতে হবে। এরপর তিনি প্রায় দৌড়া‌তে লাগলেন। প্রচণ্ড কাজের মধ্যেও বিদেশি বুঝতে পেরে তিনি যেভাবে সাহায্য করলেন তাতে ভালো লাগতে বাধ্য। নাম না জানা সেই জাপানিকে‌ আজীবন ধন্যবাদ।

পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের আমন্ত্রণে সেবার ১৫ দিনের জাপান সফর পৃথিবী সম্পর্কে নতুন ধারণা দিয়েছিলো। মনে আছে, দ্রুতগতির বুলেট ট্রেনে করে হি‌রো‌শিমা যাওয়ার পথে দলে থাকা এক সাংবাদিক তার পাস‌পোর্ট ভুল ক‌রে ট্রেনে ফেলে গিয়েছিলেন। এরপর তার কী দুশ্চিন্তা। কিন্তু সাথে থাকা জাপানি গাইড বললেন, চিন্তা করো না। আসলেই তার চিন্তা দূর হ‌য়ে গিয়েছিলো। ট্রেন থেকে নামার আধঘণ্টার মধ্যে তার পাস‌পো‌র্টের হদিস পাওয়া যায়।

জাপানের ফরেন প্রেস সেন্টা‌রের যে ভবনটায় প্রতিদিন যেতে হতো, সেখানকার দা‌রোয়ানকে দেখা যেতো রোজ সকালে সবাইকে‌ মাথা নুই‌য়ে হা‌সিমু‌খে স্বাগত জানাচ্ছেন। একইরকম হাসিমুখ থাকতো প্র‌তিটি রেস্তোরাঁর ও‌য়েটারা। প্রথম ধাক্কায় যে কারও মনে হবে, জাপানিরা এতো ভা‌লো কেনো!

জাপান নি‌য়ে এতো কথা বলার কারণ, ঢাকা-চট্টগ্রাম-ঢাকা সড়কপথ আর প্রধানমন্ত্রীর জাপান সফর। ঢাকা-চট্টগ্রাম প‌থে বহু বছর ধ‌রে যারা যাতায়াত করেন, তাদের কাছে কুমিল্লার দাউদকান্দির যানজট ছিলো এক ভয়াবহ আতঙ্কের নাম। মেঘনা ও গোমতীর দুই সেতুতে ঘণ্টার পর ঘণ্টা ব‌সে থাকার দুঃসহ স্মৃতি যে কারো ভোলা কঠিন। তবে সেই ভয়ঙ্কর সময় বু‌ঝি কাটলো। কারণ মেঘনা ও গোমতী নদীর ওপর নির্মিত দ্বিতীয় মেঘনা ও দ্বিতীয় গোমতী সেতু গত ২৫ মে থেকে খুলে দেওয়া হয়েছে। আর কিছুদিন আগে চালু হয়েছে দ্বিতীয় কাঁচপুর সেতু।

ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের ওপর নতুন এই তিনটি সেতু নির্মাণের ফ‌লে মানু‌ষের দু‌র্ভোগ কমে গেছে। ইতিম‌ধ্যেই এর সুফল পেতে শুরু করেছেন কুমিল্লার মানুষ। ঢাকা থেকে কুমিল্লায় যেতে আগে যেখানে কখনো কখনো সাত থেকে আট ঘণ্টাও লাগতো গত তিনদিন ধরে সেখানে মাত্র দেড় ঘণ্টা লাগছে। এবারের ঈদের আগে কু‌মিল্লা ও চট্টগ্রাম বিভা‌গের মানু‌ষের জন্য সেতুগু‌লো যেনো বিরাট উপহার। এজন্য বি‌শেষ ধন্যবাদ জাপানকে। কেনো শুনবেন?

চলুন তিন বছর আগে। ২০১৬ সালের জানুয়ারি মাসে এই তিন সেতু নির্মাণের কাজ শুরু হলো। কিন্তু জুলাই মা‌সে গুলশানের হলি আর্টিজান বেকারিতে হামলায় কয়েকজন জাপানি নাগ‌রিকের মৃত্যুর ঘটনায় সংকটে পড়লো সব। প্রায় ছয় মাস কাজ বন্ধ রাখলো জাপানের তিন নির্মাতা কোম্পানি। পরে প্রকল্প মেয়াদ ছয় মাস বাড়ানোরও আবেদন করে তারা। সে অনুযায়ী আরও সাতমাস পরে এই কাজ শেষ হওয়ার কথা। কিন্তু ছয় মাস তো লাগলোই না, আগের নির্ধারিত সময়ের এক মাস আগেই নির্মাণ শেষ করেছে জাপা‌নিরা।

এর নামই জাপান! দেশি কিংবা বি‌দে‌শি প্রতিষ্ঠানগুলো যখন নির্ধারিত সময়ে কাজ শেষ না করে দফায় দফায় প্রকল্প ব্যয় বাড়ানোর ধান্দায় থাকে, সেখা‌নে জাপানিরা নির্ধারিত সময়ের আগে কাজ শেষ করে অনন্য নজির স্থাপন ক‌রে‌ছে। সময়ের আগে কাজ শেষ হওয়ায় হাজার কোটি টাকাও সাশ্রয় হয়েছে।

জাপান কিন্তু বাংলাদেশের নতুন বন্ধু নয়। বরং বাংলাদেশের স্বাধীনতার সূচনালগ্ন থেকেই বাংলাদেশের শুভাকাঙ্ক্ষী হিসেবে পাশে আছে দেশটি। বলা যায় জাপান বাংলাদেশের দুর্দিনের বন্ধু। এই তো কয়েক বছর আগে পদ্মাসেতুর কাজে ঋণ দিতে বিশ্বব্যাংক যখন অস্বীকৃ‌তি জানালো, জাপান কিন্তু ঠিকই ২২ হাজার কো‌টি টাকায় মেট্রোরেল প্রকল্পের কাজ শুরু করলো। ২০২০ সা‌লের মধ্যে মেট্রো চালু হ‌লে এই শহ‌রের গণপ‌রিবহ‌নের চিত্র অন্যরকম হবে।

বাংলাদেশের অবকাঠামোগত উন্নয়নে জাপানের সহায়তা নজিরবিহীন। অবকাঠামো ছাড়া কৃষি, শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবাসহ অন্যান্য খাতেও জাপা‌নি‌দের সহায়তা অনেক। বাংলাদেশকে যতো দেশ উন্নয়ন সাহায্য দেয় জাপান সেই তালিকায় সবার ওপরে। দুই দেশের এই সম্পর্ক‌কে এগিয়ে নিতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২৮ মে সরকারি সফরে জাপান যা‌বেন। তিনদিনের এই সফরে তিনি জাপানের প্রধানমন্ত্রী শিনজো আবের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় শীর্ষ বৈঠকে অংশ নেবেন। তবে এই সফরকে সামনে রেখে বাংলাদেশ ভ্রমণে জাপান যে ভ্রমণ সতর্কতা জারি করেছে সেটি নিয়েও অলোচনা হওয়া উচিত।

জাপান প্রবাসী সাংবাদিক মনজুরুল হক লিখেছেন, তিন বছরের বেশি সময় ধরে ঝুলে থাকা জাপানের আরোপিত ভ্রমণ সতর্কতা বাংলাদেশের জন্য বিব্রতকর। আসলেও তাই। এই সংকটের শুরু ২০১৫ সালে। ওই বছ‌রের ৩ অক্টোবর রংপুরের কাউনিয়া উপজেলার আলুটারি গ্রামে জাপানি নাগরিক কুনিও হোশিকে গুলি করে হত্যা করা হয়। এরপ‌রেই জাপা‌নি‌দের ভ্রমণে সতর্কতা জা‌রি করা হয়। ২০১৬ সালের হোলি আর্টিজান ঘটনার পর এই নিষেধাজ্ঞা অনেকটা স্থায়ী হ‌য়ে যায়।

অনেকেই জেনে থাকতে পারেন, বাংলাদেশে প্র‌তিবছর যে দেশগু‌লো থে‌কে সবচেয়ে বেশি বি‌দে‌শি পর্যটক আসেন, সেই শীর্ষ দেশগু‌লোর একটি ছিলো জাপান। প্র‌তি বছর গ‌ড়ে হাজার বিশেক জাপানি আসতেন যার ম‌ধ্যে অসংখ্য তরুণ-তরুণী ছিলেন। কিন্তু, ২০১৬ সা‌লের ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞার পর থে‌কে সেটি বন্ধ রয়েছে।

জাপানি নাগরিকদের এখন ঢাকায় যেতে নিরুৎসাহিত করা হয়। এর থেকে উত্তরণ জরুরি।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হা‌সিনা ২৯ মে টোকিওতে প্রধানমন্ত্রী শিনজো আবের সঙ্গে বৈঠক করবেন। সেদিন জাপানের পক্ষ থেকে বাংলাদেশের জন্য নতুন যে থোক সহায়তা প্রদানের ঘোষণা আসার কথা, এককালীন হিসেবে সেটা এ যাবৎকালের সর্ববৃহৎ। পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আব্দুল মোমেন সংবাদ সম্মেলনে ইঙ্গিত দিয়েছেন, বাংলাদেশ-জাপানের মধ্যে আড়াই বিলিয়ন ডলারের অফিসিয়াল ডেভেলপমেন্ট অ্যাসিস্টেন্স (ওডিএ) চুক্তি সই হবে।

বাংলাদেশের একজন নাগরিক হিসেবে চাওয়া, এই সময়টায় আমাদের একটা চাওয়া আছে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীকে অনু‌রোধ, শিনজো আবের সঙ্গে বৈঠক চলাকালে যেনো সতর্কতা উঠিয়ে ফের জাপা‌নিদের বাংলাদেশ সফরের সফ‌রের অনু‌রোধ করা হয়। বাংলাদেশের পক্ষ থে‌কে জাপানিদের এই বার্তা দিতে হবে, তোমরা আমাদের দুর্দিনের বন্ধু। আমরা চাই তোমরা বাংলাদেশে বেড়া‌তে আসো। তোমাদেরকে আমরা স্বাগত জানাবো। কারণ পৃথিবীর এই দুঃসময়ে নী‌তি-নৈ‌তিকতা, আদর্শ, অপরকে সম্মান করাসহ জাপানিদের কাছ থেকে শেখার আছে বহু কিছু। কাজেই জাপানিদের আমন্ত্রণ লাল সবু‌জের বাংলাদেশে।

শরিফুল হাসান, কলামিস্ট

প্রোগ্রাম প্রধান, মাইগ্রেশন, ব্র্যাক

(দ্য ডেইলি স্টারের সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের মতামতের মিল নাও থাকতে পারে। প্রকাশিত লেখাটির আইনগত, মতামত বা বিশ্লেষণের দায়ভার সম্পূর্ণরূপে লেখকের, দ্য ডেইলি স্টার কর্তৃপক্ষের নয়। লেখকের নিজস্ব মতামতের কোনো প্রকার দায়ভার দ্য ডেইলি স্টার নিবে না।)

Comments

The Daily Star  | English

Chief adviser holds high-level meeting to review law and order

The chiefs of three services and several advisers were in attendance, among others

40m ago