ধান-লিচু-আমের দাম নেই, ঈদের আনন্দও নেই
এমনিতেই ধানের দাম কম, তার ওপর ঈদের সময় আম ও লিচুর চাহিদা কমে যাওয়ায় মৌসুমি এই ফলগুলোর দামও কমে গেছে। ঈদের নতুন কাপড় দূরের কথা, ভাল মন্দ খাবারের জোগাড় করতে পারেননি রাজশাহীর নিম্ন আয়ের অনেকেই।
প্রতি মণ ধান উৎপাদনে খরচ হয়েছে কমপক্ষে ৮০০ টাকা, কিন্তু ধানের দাম ৬৫০ টাকার ওপরে উঠছে না। বাজারে প্রতি ১০০ লিচু বিক্রি হচ্ছে ১০০ থেকে ১৫০ টাকায়, গত মাসের শেষ দিকে লিচু বিক্রি হয়েছে ২৫০ টাকায়। অথচ গত বছরও এর দাম ছিল ৩৫০ টাকা। মে মাসের মধ্যভাগে আমের মৌসুমের শুরুতে ১৮০০ টাকা মণ দরে আম বিক্রি হলেও তা এখন ১০০০ থেকে ১২০০ টাকায় নেমে এসেছে। আমের ক্রেতা মিলছে না। ধান, লিচু ও আমের দাম কমে যাওয়ায় অনেক কৃষকের ঘরে নেই ঈদের আনন্দ। শহরের আনন্দ কোলাহল পেরিয়ে একটু বাইরে গেলেই যেখানে পথের দুধারে, কৃষকের উঠোনে দেখা মেলে পালা করা ধান সেখানে অনেকের কাছে এবারের ঈদের দিন অন্য দিন থেকে আলাদা কিছু নয়। সেখানে বিরাজ করছে নীরবতা।
রাজশাহী-চাঁপাইনবাবগঞ্জ মহাসড়ক ধরে এগোলে শহর যেখানে শেষ সেখানে পবা উপজেলার হরিপুর গ্রাম শুরু।
এ গ্রামে গিয়ে দেখা হলো শাহজাহান আলীর সঙ্গে। ঈদের নামাজ পড়ে বাড়িতে ফিরে ঘুমিয়ে পড়েছিলেন। পুরনো একটি ছাই রঙের জামা গায়ে চড়িয়ে বোতাম লাগাতে লাগাতে বাড়ি থেকে বেড়িয়ে এলেন তিনি। ঈদ মোবারক জানাতেই তিনি বললেন, “কৃষকের আবার ঈদ কি? অন্য দিনের মতোই।”
যেটুকু আলাদা তা হলো ঈদ উপলক্ষে আধা কেজি সেমাই কিনেছেন, আর কিনেছেন একটা সিলভার কার্প মাছ। শাহজাহান এবার দুই বিঘা জমি বর্গা নিয়ে ধানের আবাদ করেছিলেন। সেচের, শ্রমিকের আর জমির মালিকের ভাগ পরিশোধ করে ১১ মণ ধান ঘরে তুলেছেন।
“প্রতি মণ ধান চাষে খরচ হয়েছে কম পক্ষে ৮০০ টাকা, ধানের দাম ৬০০ টাকাও মিলছে না। এক মণ ধান বেচলে এক কেজি গরুর মাংস যদিওবা কিনতে পারব, তবে মশলা কেনা যাবে না,” শাহজাহান বলছিলেন।
“আর যেটুকু ধান পেয়েছি সেটা বেচলে সারা বছর খাব কী?” এই চিন্তা করেই ধান বেচেননি। ঈদে নিজের জন্য যেমন নতুন কিছু কেনেননি, মা, স্ত্রী ও এক সন্তানের জন্যও কিছু কেনা হয়নি।
আটচল্লিশ বছরের এই কৃষকের ঈদ আনন্দ সেমাই আর সিলভার কার্প মাছেই সীমাবদ্ধ।
শাহজাহানের সঙ্গে কথা বলার সময় সেখানে জড়ো হয়েছিল আরও কয়েকজন বর্গা চাষী। তারা জানালেন তাদের অবস্থা শাহজাহানের মতোই।
তাদের উঠোনে দেখা গেল ধান পালা করা আছে। জানালেন, দাম নেই দেখে এ ধান তারা মাঠেই রেখেছিলেন। ঈদের আগে বাড়িতে এনেছেন, ঈদের পর মাড়াই করবেন।
রাজশাহী থেকে ২৫ কিলোমিটার দূরে গোদাগাড়ী উপজেলার ইদলপুর গ্রামে গিয়ে দেখা হলো আল্লাম হোসেনের সঙ্গে। আল্লাম তিন বিঘা জমিতে বোরো ধান আবাদ করেছিলেন। সবার দায় পরিশোধ করে ঘরে তুলেছেন ২৫ মণ ধান। এর অর্ধেক তিনি খাওয়ার জন্য রেখে বাকিটা বেচতে চেয়েছিলেন। দাম আশানুরূপ না হওয়ায় বেচেননি। তার আছে চারটি আম গাছ। ভেবেছিলেন আম বিক্রি করে ঈদের খরচ করবেন, পরে সুবিধামতো ধান বেচবেন।
“দুই দিন ৩০ কেজি করে আম বাজারে নিয়ে গিয়েছিলাম বেচার জন্য। কেউ আমের দাম পর্যন্ত জিজ্ঞাসা করেনি। ঈদের আগে আমের চাহিদা নাই,” আল্লাম হোসেন বলছিলেন।
দুবারই আম বিক্রি করতে না পেরে বাড়িতে ফিরিয়ে নিয়ে গেছেন। শেষ পর্যন্ত ধান বিক্রি করে পরিশোধ করবেন এই শর্তে চাঁদরাতে এক হাজার টাকা ধার করে দুই কেজি গরুর মাংস কিনেছেন।
ইদলপুরের আল্লাম হোসেন ভাগ্যবান, অন্তত তার প্রতিবেশী শাহজাহান মনুর তুলনায়। মনুর বাড়িতে গিয়ে দেখা গেল তার স্ত্রী বেবী খাতুন পটল ভাজি রান্না করছেন।
“আমার মেয়ের বাবা ঈদ উপলক্ষে একটি ব্রয়লার মুরগী কিনে এনেছেন। সঙ্গে পোলাও রান্না করেছি। স্বাদ লাগবে আবার খাবারের একটা পদও বাড়বে এই ভেবে পটল ভাজি করছি,” বেবী খাতুন হাসতে হাসতে বললেন, “এটাই আমাদের ঈদের আনন্দ।”
বেবী খাতুনের পরনে ছিল লাল সুতি প্রিন্টের শাড়ী। তার মেয়েও লাল সাদা সুতি গজ কাপড়ের একটি সালোয়ার কামিজ পরে তার রান্নাঘরের পাশে একটি গাছের নিচে দাড়িয়ে বান্ধবীদের সঙ্গে গল্প করছিল।
বেবী খাতুন বললেন তার স্বামী মনু গত বছরের ঈদুল ফিতরে এই শাড়ি ও মেয়ের জামা বানিয়ে দিয়েছিলেন। বেবী খাতুনের কথায়, “এগুলো আমরা খুব কমই পরেছি, নতুনের মতোই আছে। এবার কারোরই নতুন কাপড় হয়নি। তাই এগুলোই ঈদের দিন পরেছি।”
স্বামী কোথায় জিজ্ঞাসা করলে বলেন, কাউকে নতুন কিছু না দিতে পেরে শাহজাহান মনুর মন খারাপ। খুব সকালে বাড়ি থেকে বেরিয়েছেন, পাড়াতেই কোথাও আছেন। দুই ছেলেকে পাঠিয়েছেন বাবাকে বাড়িতে আনতে যেন সবাই মিলে এক সঙ্গে দুপুরের খাবার খাওয়া যায়।
মনু ১৫ কাঠা জমিতে ধান চাষ করে সাড়ে ১০ মণ ধান পেয়েছেন। এর কিছুটা ভালো দামে বেচতে পারলে ঈদের খরচ ভালোই চলত, জানালেন বেবী খাতুন। তার দুই ছেলে শ্রমিক, তাদের টাকাতেই ব্রয়লার মুরগীটি কেনা হয়েছে।
ইদলপুরের মোটামুটি সচ্ছল কৃষক সৈয়বুর রহমান। নিজের তিন বিঘা ও আরও দুই বিঘা জমি বর্গা নিয়ে ধানের আবাদ করেছিলেন। তিনি পেয়েছেন ৫২ মণ ধান। ধানের দাম কম দেখে পালা করে রেখেছেন বাড়ির উঠোনে। ঈদের আগে একমাত্র মেয়ের বিয়ে দিয়েছেন। তিনিও ঈদের খরচ চালাতে ২০,০০০ টাকা ধার করেছেন।
“ধানের দাম না পেয়ে কৃষক মরে শেষ”, সৈয়বুর বলছিলেন।
তিনি জানান ইদলপুর গ্রামে ৬৫টি পরিবারের বাস। তাদের অন্তত ২৫টি পরিবার ঈদ উপলক্ষে এবার গরুর মাংস কিনতে পারেননি। প্রায় ৩০ জন মিলে প্রত্যেকে এক হাজার করে টাকা দিয়ে পার্শ্ববর্তী রাজাবাড়ী হাট থেকে একটি গরু কিনেছিলেন, তা থেকে ৩০ জনের প্রত্যেকে দুই কেজি করে মাংস পেয়েছেন।
বাকিরা হাট থেকে মাংস কিনেছেন।
কৃষি ফসলের দাম নেই, নতুন কাপড় চোপড় নেই, তাই বলে ঈদের আনন্দ একেবারে থেমে নেই গ্রামের যুবক কিশোরদের। ট্রাকের মতো করে বানানো নসিমন করিমন বা ভুটভুটিতে চড়ে গ্রামের কিশোর যুবকরা মহাসড়ক ধরে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। ভুটভুটি চলছে। তারা নাচছেন, লাফাচ্ছেন। ভুটভুটিতে লাগানো ভাড়া করা সাউন্ড বক্সে বাজছে আধুনিক গান। গান বাজনার সুরে হারিয়ে যাচ্ছে বড়দের না পাওয়ার না দেওয়ার বেদনা।
Comments