ইলিশ ধরায় নিষেধাজ্ঞা, মেলেনি সরকারি সহায়তা তাই ঈদও নিরানন্দ জেলে গ্রামে
বরিশালের মেহেন্দীগঞ্জ উপজেলার ভাসানচর ইউনিয়নের বাগর জা গ্রাম। গ্রামটি চারিদিকে নদী দিয়ে ঘেরা। মেঘনা, কালবদরের মতো আগ্রাসী সব নদী। নদীপাড়ের এক জেলেগ্রাম বাগর জা। গ্রামের অধিকাংশের পেশা বলতে মাছ ধরা। নদীই তাদের কাছে সব কিছু- আয় উপার্জন, জীবন, আর বেঁচে থাকার সংগ্রাম।
বাগর জা গ্রামে প্রায় ৪ হাজার মানুষের বাস। এর মধ্যে অত্যন্ত আড়াই হাজার মানুষ বিভিন্ন ধরনের নৌকা নিয়ে ইলিশ মাছ ধরে। কিন্তু এই জেলে গ্রামে ঈদের আনন্দ নেই। জাটকা ইলিশ রক্ষায় নদীতে জাল ফেলায় নিষেধাজ্ঞা থাকলেও গ্রামের জেলেদের অনেকেই এই সময়টায় সরকারি খাদ্য সহায়তা পাননি। সে কারণেই গ্রামের কয়েকশো শিশুদের কারও এই ঈদে নতুন জামা হয়নি। ঈদের দিনের সকালটা কেটেছে রোজকার মতো পান্তা ভাত খেয়ে।
এই গ্রামের এক জেলে বেল্লাল হোসেন। বয়স বছর চল্লিশের এই মানুষটির পূর্বপুরুষেরও পেশা ছিল মাছ ধরা। তার ধারাবাহিকতা এখনও চলছে। জাল, নৌকা তাদের বেঁচে থাকার রসদ। ঈদ এই জেলে পরিবারটিকে যেন বিব্রতকর অবস্থায় ফেলেছে। ছেলে মেয়েদের কারোরই নতুন জামা কেনা সামর্থ্যে কুলোয়নি। ঈদের দিন অনেক চেষ্টায় বেল্লাল-মায়ানূর দম্পতি ধার দেনা করে, অল্প কিছু মাংস জোগাড় করতে পেরেছেন। সেই মাংসের ঝোল দিয়েই কাটিয়ে দিয়েছেন ঈদের দ্বিতীয় দিন পর্যন্ত।
বেল্লাল জানান, “আমার ছয় ছেলে মেয়ের কাউকেই ঈদের জামা দিতে পারিনি। নদীতে নামতে না পেরে আয় উপার্জন বন্ধ- এর মধ্যে সমুদ্রে মাছ ধরা বন্ধের ঘোষণা আসায় বুঝতে পারছি না কি করব।”
“আমারা জেলে নৌকা নিয়ে হাতিয়া- সন্দীপের সমুদ্র উপকূল পর্যন্ত মাছ ধরি কিন্তু এবারে কি হবে এ নিয়ে আতঙ্কে আছি- মাছ ধরতে পারব কিনা জানি না।”
বেল্লালের স্ত্রী জানান, “এবারই প্রথম নয়- ঈদ আসলে কষ্ট বাড়ে, ছেলে মেয়েদের হাতে কিছুই তুলে দিতে পারি না বলে।”
বেল্লাল জানান, বিগত চার মাসে মাত্র ৫০ কেজি চাল পেয়েছে তিনি।
কিন্তু শুধু বেল্লাল-মায়ানূর পরিবার নয়, অলাউদ্দিন গাজী, কবির গাজী, ছবির গাজী, জলিল হাওলাদার, বজলু হাওলাদারসহ শতাধিক পরিবারে ঈদ এসেছে প্রতিদিনের মতো, কষ্ট নিয়ে।
এই গ্রামের সেন্টু রাঢি জানান, “ভাঙনে মোর সব গেছে- এইহানে রাস্তার পারে কোনমতে ঘর তুইল্লা ঠাঁই লইছি- মোগো আর ঈদ, ঈদের দিনও পান্তার বেশি কিছু জোটেনি।”
নদীতে নৌকা নামাতে পারেননি সেন্টু। জেলে হলেও তিনি চাল পাননি। এই গ্রামের মাত্র তিন ভাগের এক ভাগ জেলে সরকারি সহায়তার চাল পেয়েছেন বলে তিনি জানান।
শুধু বাগর জা নয়, কাজীর হাট থানার বিদ্যানন্দপুর গ্রাম, মেহেন্দীগঞ্জের জাংগালিয়া গ্রাম, বরিশাল সদর উপজেলার ভেদুরিয়া, টুংগিবাড়িয়াসহ আশপাশের ১৫/২০ জেলে গ্রামে ঈদের আনন্দ বলতে কিছু নেই। এসব গ্রামের অর্ধলক্ষাধিক মানুষের দুই তৃতীয়াংশের ঈদ কেটেছে অন্যান্য দিনের মতো সাদামাটা।
এসব গ্রামের প্রায় সবারই পেশা মাছ ধরা হওয়ায়, মাছ ধরা বন্ধ হলে পেটে টান পড়ে। তাদের অধিকাংশের দাবি সব জেলেদের পুনর্বাসন কর্মসূচীর আওতায় আনতে হবে- নইলে নদীতে মাছ ধরার অনুমতি দিতে হবে।
অনেক জেলে মাছ ধরার জাল মেরামত করলেও, অনেকেই অভাবের তাড়নায় নিষেধাজ্ঞা অমান্য করছে- কেউ কেউ অগোচরে জাটকা ধরে গোপনে বাজারে বিক্রি করে রোজকার দিন নির্বাহ করছেন।
বরিশাল জেলা মৎস্য কর্মকর্তা (ইলিশ) বিমল চন্দ্র দাস জানান- উপকূলীয় এলাকায় মাছ ধরার ট্রলার নিষিদ্ধ, ও জাটকা নিধনে ফেব্রুয়ারি থেকে সেপ্টেম্বর আট মাস জাটকা মাছ ধরার নিষেধাজ্ঞা থাকায় মেহেন্দীগঞ্জ অঞ্চলের কয়েক হাজার জেলে পরিবার মানবেতর ভাবে ঈদ কাটিয়েছে। তবে তিনি জানান উপকূলে মাছ ধরার নিষেধাজ্ঞার সময়ে জেলেদের সহায়তা দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছে।
Comments