হোলি আর্টিজান ট্রাজেডি ও একজন রবিউল

স্বাধীনতার ৪৫ বছর পরের ঘটনা। ২০১৬ সালের ১ জুলাই রাজধানী ঢাকার গুলশানের হোলি আর্টিজান রেস্তোরাঁয় নিত্যদিনের মতোই পানাহার করতে গেলেন বেশ কজন দেশি-বিদেশি নিরপরাধ মানুষ।

২৫ মার্চ ১৯৭১ সালের কাল রাত। পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর সশস্ত্র সদস্যরা যখন নিরীহ ঢাকাবাসীর ওপর হামলে পড়লো, ওই রাতে রাজারবাগের পুলিশ সদস্যরা থ্রি নট থ্রি রাইফেল নিয়েই ঝাঁপিয়ে পড়ে প্রথম প্রতিরোধ যুদ্ধে। শহীদ হন অগণিত পুলিশ সদস্য।

স্বাধীনতার ৪৫ বছর পরের ঘটনা। ২০১৬ সালের ১ জুলাই রাজধানী ঢাকার গুলশানের হোলি আর্টিজান রেস্তোরাঁয় নিত্যদিনের মতোই পানাহার করতে গেলেন বেশ কজন দেশি-বিদেশি নিরপরাধ মানুষ। বিনা মেঘে বজ্রপাতের মতো সংবাদ আসলো, রেস্তোরাঁয় কিছু একটা ঘটেছে। থানা পুলিশের পাশাপাশি রমনার মিন্টোরোড থেকে তাৎক্ষণিক ঘটনাস্থলের দিকে ছুটে গেলো ঢাকা মহানগর ডিবির একটি দল। দলটির নেতৃত্বে ছিলেন তৎকালীন সিনিয়র সহকারী পুলিশ কমিশনার (ডিবি উত্তর) রবিউল করিম। ঘটনার আকস্মিকতায় সকলেই তখন হতবিহবল। ভেতরে কী ঘটছে বোঝার কোনো উপায় নেই। ঘটনাস্থলে পৌঁছেই সাহস করে নিজের দল নিয়ে সামনে এগিয়ে গেলেন রবিউল। ভেতরে আটকা পড়েছেন দেশ-বিদেশের এতগুলো মানুষ। তাদের বাঁচাতে হবে। উদ্ধার করতে হবে। শত্রুদের পরাস্ত করতে হবে। এই ছিলো রবিউলের ইচ্ছা। ডিএমপি কমিশনার আছাদুজ্জামান মিয়ার নেতৃত্বে উপস্থিত রবিউলের ডিবি পুলিশের দলটি এবং অন্যান্য পোশাকধারী পুলিশ ফায়ার করতে করতে ভেতরে ঢুকে। ফার্স্ট রেসপন্ডার হিসেবে রবিউলের দলটি একজন আর্জেন্টাইন, একজন ইতালিয়ান ও সাতজন বাংলাদেশিসহ মোট নয়জনকে বের করে আনতে সক্ষম হয়। তাদের উদ্ধার করে রবিউল ও অন্যান্য পুলিশ কর্মকর্তরা যখন গেট দিয়ে বের হচ্ছিলেন, তখনই রেস্তোরাঁর ভেতর থেকে ছুটে আসে একটি গ্রেনেড। গ্রেনেডটি বিস্ফোরিত হলে কয়েকটি স্প্লিন্টার এক সঙ্গে গিয়ে বিঁধে রবিউলের দেহে। ক্ষতবিক্ষত হয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়েন রবিউল। হাসপাতালে নেওয়ার কিছুক্ষণ পরেই রবিউল শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন। নিরপরাধ মানুষকে সশস্ত্র জঙ্গিদের কবল থেকে উদ্ধার করতে গিয়ে, অপশক্তিকে নিষ্ক্রিয় করতে গিয়ে, পেশার কাজে পরম আন্তরিকতা দেখাতে গিয়ে, দেশ মাতৃকার ডাকে সাড়া দিতে গিয়ে শাহাদাত বরণ করলেন রবিউল। বাংলাদেশ পুলিশ হারালো একজন সাহসী অফিসারকে। দেশ হারালো তার এক সাহসী সন্তানকে। আমি হারালাম আমার এক পরম বন্ধু ও ঘনিষ্ঠ সহকর্মীকে।

বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে রবিউল ছিলেন আমার সহপাঠী ও বন্ধু। চাকরি জীবনে এসে দুজন হলাম আবার সহকর্মী। সারদায় বাংলাদেশ পুলিশ একাডেমিতে একই সঙ্গে পুলিশের ট্রেনিং নেওয়ার সময়টিতে বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের বন্ধুত্বটি নতুন মাত্রা পায়। আমরা হয়ে উঠি একে অপরের সুখ-দুঃখের সাথী।

রবিউল ছিলেন একজন স্বপ্নবান তরুণ। পুলিশের চাকরিতে আসার পেছনে রবির ছিলো এক অন্যরকম উদ্দেশ্য। নিজের কাজ ও কর্মদক্ষতায় বদলে দিতে চেয়েছিলেন সমাজটাকে। বিশ্ববিদ্যালয় জীবনেই দেখেছি সন্ত্রাস, জঙ্গি ও মাদকের বিরুদ্ধে রবির তীব্র ঘৃণা। এ নিয়ে কিছু একটা করতে চাইতেন। আমার জানামতে সেই ইচ্ছা থেকেই রবি পুলিশে যোগদান করেছিলেন একজন ক্যাডার অফিসার হিসেবে। তার আগে রবিউল বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা শেষ করেই ভালো চাকরি নিয়ে পাড়ি জমিয়েছিলেন ইউরোপে। উন্নত দেশের উন্নত জীবনের হাতছানি ছেড়ে দেশে এসে বিসিএস পরীক্ষা দিয়ে পুলিশে যোগদান করলেন ওই একটি কারণেই। আর সেটি হলো দেশ ও দেশের মানুষের জন্য কিছু করার অদম্য ইচ্ছা।

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের এই ছাত্র তার নিজ গ্রামে বাড়ির পাশেই গড়ে তুলেছিলেন একটি স্কুল। মানিকগঞ্জ সদর উপজেলার কাঠিগ্রামে রবিউলের প্রতিষ্ঠিত ‘ব্লুমস’ স্কুলটি ছিল শুধুমাত্র প্রতিবন্ধী শিশুদের জন্য।

জাতির গর্ব এবং জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের এই কৃতি ছাত্রের জন্য আমাদের কিছু করণীয় আছে বৈকি। জাতির এই বীর সন্তানের আত্মত্যাগকে স্মরণীয় ও পরবর্তী প্রজন্মের কাছে তার আদর্শকে পৌঁছে দিতে রাষ্ট্র বিশেষত জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় উদ্যোগী হতে পারে। বিশ্ববিদ্যালয় তার মনোরম ক্যাম্পাসে নির্মিতব্য কোনো একাডেমিক ভবন বা ছাত্র-ছাত্রী হল রবিউলের নামে নামকরণ করতে পারে। এতে করে একদিকে যেমন রবিউলের স্মৃতি ধরে রাখা যাবে, তেমনি রবিউলের দেশপ্রেমের চেতনাকে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রীদের মাঝে ছড়িয়ে দেওয়া সম্ভব হবে।

লেখক: আবু তৈয়ব মো. আরিফ হোসেন

অতিরিক্ত উপ-পুলিশ কমিশনার, ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ

 

(দ্য ডেইলি স্টারের সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের মতামতের মিল নাও থাকতে পারে। প্রকাশিত লেখাটির আইনগত, মতামত বা বিশ্লেষণের দায়ভার সম্পূর্ণরূপে লেখকের, দ্য ডেইলি স্টার কর্তৃপক্ষের নয়। লেখকের নিজস্ব মতামতের কোনো প্রকার দায়ভার দ্য ডেইলি স্টার নিবে না।)

Comments