উচ্চপদের কর্মকর্তার তদন্ত করবেন ১ জন সম ও ৭ জন নিম্নপদের কর্মকর্তা!
গত ২৫ জুলাইয়ের ঘটনা। গণমাধ্যমে আসে তিনদিন পর। অভিযোগ এসেছে, সরকারের এটুআই প্রকল্পে দায়িত্বরত যুগ্মসচিব আবদুস সবুর মণ্ডলের গাড়ির অপেক্ষায় ফেরি পার হতে দেরি হয় তিন ঘণ্টা। সেসময় মৃত্যু হয় অ্যাম্বুলেন্সে থাকা নড়াইলের কালিয়া পাইলট মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের ষষ্ঠ শ্রেণির ছাত্র তিতাস ঘোষের।
এ ঘটনায় গঠন করা হয়েছে তিনটি তদন্ত কমিটি। মাদারীপুর জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ ওয়াহিদুল ইসলাম গঠন করেছেন চার সদস্যের তদন্ত কমিটি, বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌ-পরিবহন কর্পোরেশনের (বিআইডব্লুটিসি) জেনারেল ম্যানেজার মোহাম্মদ আশিকুজ্জামান গঠন করেছেন দুই সদস্যের তদন্ত কমিটি এবং নৌপরিবহন মন্ত্রণালয় গঠন করেছে দুই সদস্যের তদন্ত কমিটি। তদন্ত কমিটিগুলোর যারা সদস্য তাদের মধ্যে একজন আবদুস সবুর মণ্ডলের সমমানের যুগ্মসচিব ও বাকি সাতজন নিম্নপদের কর্মকর্তা।
‘ভিআইপি’ পরিচয়ধারী যুগ্মসচিবের জন্যে ফেরি দেরি করতে পারে কি না? এবং বাংলাদেশের বাস্তবতায় যুগ্মসচিবের নিচের পদের কর্মকর্তারা কতোটা নিরপেক্ষভাবে উচ্চপদের কর্মকর্তার তদন্ত করতে পারবেন?- এ প্রশ্ন সামনে রেখে দ্য ডেইলি স্টারের পক্ষ থেকে আজ (৩০ জুলাই) কথা হয় বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতির (বেলা) প্রধান নির্বাহী সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান সুপ্রিমকোর্টের আইনজীবী ব্যারিস্টার তানজিবুল আলম এবং ব্যারিস্টার জ্যোতির্ময় বড়ুয়ার সঙ্গে।
সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বলেন, “না, ভিআইপি যুগ্মসচিবের জন্যে ফেরি দেরি করতে পারে না। ইউএনও সাহেবের স্ত্রীর মোবাইলফোন পানিতে পড়ে গেলে ডুবুরি সেখানে নামতে পারেন না। আমাদের দেশে ‘ওয়ারেন্ট অব প্রিসিডেন্স’ রয়েছে কিন্তু, সেখানে ভিআইপি বলে কোনো কথা নেই। এখন যারা ক্ষমতার কাছাকাছি রয়েছেন তারা সবাই নিজেকে ভিআইপি দাবি করলে তো মুশকিলের কথা। এটা কোনোভাবেই হতে পারে না। এটাকে থামাতেই হবে।”
“ভিআইপিরা এদেশে কী করেন? ভিআইপি সংস্কৃতিটা কখন হচ্ছে? তাদের দায়িত্ব পালনকালে যদি এটা হতো তাহলে মেনে নিতাম। কিন্তু, কেউ যখন অযৌক্তিক সুবিধা নিতে ভিআইপি হন তখন তো আমরা তা কোনোভাবেই মানতে পারি না। কেউ যখন ভিআইপি হন রাস্তার উল্টো দিক দিয়ে যাওয়ার জন্যে, ভিআইপি হন অবৈধ সুযোগ-সুবিধা পাওয়ার জন্যে, তখন তো আমরা কোনোভাবেই বলতে পারি না যে এই ভিআইপি সংস্কৃতি গ্রহণযোগ্য। যদি বলতো জনগণের এই দুর্দশা হচ্ছে, এটা নিরসন করা আমার দায়িত্ব, আমি ভিআইপি হিসেবে দায়িত্ব পালন করলাম তাহলে এই সংস্কৃতি আমি মেনে নিতাম। এখন এই ভিআইপি সংস্কৃতি অনেক বেশি অযৌক্তিক সুবিধা দিচ্ছে। এই অযৌক্তিক সুবিধাকে তারা তাদের অধিকার বলে মনে করছে। এই অধিকার তাদেরকে দেওয়া হয়নি।”
যুগ্মসচিবের নিচের পদের কর্মকর্তারা কতোটুকু নিরপেক্ষ থেকে ঘটনাটির তদন্ত করতে পারবেন- এই প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, “না, তারা নিরপেক্ষভাবে তদন্ত করতে পারবেন না।”
কোনো উচ্চপদের কর্মকর্তার তদন্ত কি কোনো নিম্নপদের কর্মকর্তা করতে পারেন?- “না। প্রথমত হচ্ছে কোনো নিম্নপদের কর্মকর্তা উচ্চপদের কর্মকর্তার তদন্ত করতে পারবেন না। দ্বিতীয়ত, তাদের ডিপার্টমেন্টাল পক্ষপাতিত্ব থাকবে। সেই ডিপার্টমেন্ট থেকে একজনকে নেওয়া যেতো। কিন্তু, পুরো তদন্ত সেই ডিপার্টমেন্টের হাতে ছেড়ে দেওয়ার কোনো সুযোগ নেই।”
ব্যারিস্টার তানজিবুল আলম বলেন, “পাবলিক ইউটিলিটির একটা নির্দিষ্ট সময় রয়েছে। সেটা তাকে মেনে চলতেই হবে। কারও জন্য দেরি করার সুযোগ নেই। আজ পর্যন্ত প্রধানমন্ত্রীর জন্য কোনো ফ্লাইট দেরি হয়নি। প্রধানমন্ত্রীর চেয়ে বড় ভিআইপি তো কেউ নেই। উনি যদি সময়মতো আসতে পারেন, তাহলে অন্যরা কেনো পারবেন না?”
এ ব্যাপারে আইনে কী রয়েছে?- “এর আইনগত কোনো ভিত্তি নেই। কোনো পাবলিক ট্রান্সপোর্ট, কোনো পাবলিক এরিয়া কারো জন্যেই থেমে থাকবে না। এটাই হচ্ছে নিয়ম। একজন ভিআইপির এই বোধটুকু থাকা উচিত।”
বাংলাদেশের বাস্তবতার প্রেক্ষিতে তার নিচের পদের কর্মকর্তারা কতোটা নিরপেক্ষ থেকে তদন্ত করতে পারবেন?- “যখনই কোনো বিষয়ের তদন্ত করা হয়, সেই বিষয়ে যিনি জড়িত থাকেন- নিয়ম হচ্ছে, তার ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাকে দিয়ে সেটা তদন্ত করার।”
কিন্তু, এক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে উল্টোটি ঘটছে।– “সেটা তো বোঝাই যাচ্ছে।”
তাহলে নিরপেক্ষ তদন্তের কোনো সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে কি?- “আইনগতভাবে যদি এটা ডিসিপ্লিনারি প্রসেডিং হতো তাহলে এর কোনো আইনগত ভিত্তি থাকতো না। কোনো ডিসিপ্লিনারি অ্যাকশনের জন্যে যদি তদন্ত করতে হয় তাহলে সবসময় উচ্চপদের কাউকে দিয়ে করাতে হবে- এটাই নিয়ম।”
ব্যারিস্টার জ্যোতির্ময় বড়ুয়া বলেন, “রাষ্ট্রীয় প্রটোকল বা ওয়ারেন্ট অব প্রিসিডেন্স অনুযায়ী কে কতোটুকু প্রটোকল পাবেন বা না পাবেন তা সেই আইনে পরিষ্কার বলা রয়েছে। কারো জন্যে রাস্তা ফাঁকা রাখতে হবে, ফেরি আটকে রাখতে হবে সেরকম কোনো বিধিবিধান নেই। এসব আইনি বিধিবিধান নিয়ে যখন আমরা প্রশ্ন তুলি তখন তাদের অন্যায়গুলোকে প্রকারন্তরে বৈধতা দিতে শুরু করি। তারাও তখন চেষ্টা করেন যে এটাতো আইনে আছে, ওটাতো আইনে আছে। সরকারি আমলারা এর অপব্যবহার করে যাচ্ছেন।”
“আমলারাই দেশটি চালাচ্ছেন” বলে উল্লেখ করে তিনি আরো বলেন, “দেশে রাজনীতি যেহেতু নাই, সে কারণে আমলারা মন যা চায় তাই করতে পারেন। একটি ছেলে মরে যাচ্ছে, সংশ্লিষ্ট লোকজনদের হাতে-পায়ে ধরার পরও ফেরি না ছেড়ে তা আটকে রাখা যেতে পারে- এটা প্রশাসনের সর্বোচ্চ মহল থেকে সর্বনিম্ন মহল সবাই এধরনের অবৈধ ক্ষমতার চর্চা করেন। জনগণ কিছু বলেন না, প্রতিবাদ করেন না বা এর বিরুদ্ধে দাঁড়ান না বলে এই চর্চাগুলো হতে হতে এমন অসহনীয় অবস্থার মধ্যে চলে এসেছে।”
“যে প্রটোকল অনুযায়ী মন্ত্রী-এমপিরা যাবেন তাদের জন্যে রাস্তা বন্ধ করে রাখা বা উল্টো রাস্তায় গাড়ি চালানো- এগুলো আইনে কোথাও বলা নেই। পুরো ব্যাপারটাই বেআইনি। পুরো ব্যাপারটার মধ্যে অদৃশ্য ক্ষমতার চর্চা এবং গায়ের জোর রয়েছে। প্রটোকল বা ওয়ারেন্ট অব প্রিসিডেন্স-এ বলা রয়েছে যে রাষ্ট্রীয়ভাবে কর্মচারী হিসেবে কী কী সুযোগ-সুবিধা তিনি পাবেন, যেমন- বাড়ি-গাড়ি বা অন্যান্য সুবিধা।”
“প্রজাতন্ত্রের মালিক জনগণ। জনগণকে বসিয়ে রেখে তার কর্মচারী ফেরিতে যাবেন, আর মালিকরা কি বসে থাকবেন?” প্রশ্ন রাখেন তিনি।
যুগ্মসচিবকে কেন্দ্র করে ঘটনা। বাংলাদেশের বাস্তবতার প্রেক্ষিতে তার নিচের পদের কর্মকর্তারা কতোটা নিরপেক্ষ থেকে তদন্ত করতে পারবেন?- “কেউই পারবেন না। যাকে তদন্ত করতে দেওয়া হয়েছে তার নির্দেশে ফেরি আটকে ছিলো।
যার জন্যে ফেরি আটকে রেখেছিলেন,তার নির্দেশ অমান্য করার ক্ষমতা কী তদন্তকারীদের থাকবে? থাকবে না। নির্মোহ বা নিরপেক্ষ তদন্ত বলতে যা বোঝায়, তা এক্ষেত্রে সম্ভব না।’’
Comments