প্রণমি চরণে তব

কবিগুরুর প্রয়াণ দিবস আজ। প্রণতি জানাই মানুষের গণ্ডি পেরিয়ে মহামানব হয়ে ওঠা এই দেবতুল্যের প্রতি। কবিগুরু কি ১৩৪৮-এর ২২ শে শ্রাবণে পৃথিবী থেকে বিদায় নিয়েছিলেন? কিংবা ১২৬৮ এর ২৫শে বৈশাখে একবারই জন্মেছেন?
rabindranath tagore
শান্তিনিকেতন থেকে কলকাতার উদ্দেশে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের শেষযাত্রা। ছবি: সংগৃহীত

কবিগুরুর প্রয়াণ দিবস আজ। প্রণতি জানাই মানুষের গণ্ডি পেরিয়ে মহামানব হয়ে ওঠা এই দেবতুল্যের প্রতি। কবিগুরু কি ১৩৪৮-এর ২২ শে শ্রাবণে পৃথিবী থেকে বিদায় নিয়েছিলেন? কিংবা ১২৬৮ এর ২৫শে বৈশাখে একবারই জন্মেছেন?

আমি বিশ্বাস করি- কবিগুরু প্রতিনিয়ত একটা বাংলাভাষী শিশুর সঙ্গে পুনর্জন্ম নিচ্ছেন- তার সঙ্গে সঙ্গে বেড়ে উঠছেন, পরিণত হচ্ছেন, আবার তার সঙ্গেই পৃথিবী থেকে বিদায় নিচ্ছেন।

‘আমসত্ত্ব দুধে ফেলি, তাহাতে কদলী দলি’... বা একটু বড় হয়ে ‘কুমোর-পাড়ার গোরুর গাড়ি, বোঝাই করা কলসি হাড়ি’ কিংবা ‘আমাদের ছোটো নদী চলে বাঁকে বাঁকে বৈশাখ মাসে তার হাঁটু জল থাকে’... ‘তালগাছ এক পায়ে দাঁড়িয়ে, সব গাছ ছাড়িয়ে’ কিংবা ‘বীরপুরুষ’ কবিতার সঙ্গে সঙ্গে একটা বাংলাভাষী শিশুর সঙ্গে সঙ্গে রবীন্দ্রনাথও প্রতিনিয়ত বেড়ে উঠছেন।

ধাপে ধাপে ‘সোনার তরী’ বা ‘নির্ঝরের স্বপ্নভঙ্গ’ পড়তে পড়তে যুবক বয়সে ‘শেষের কবিতা’ কিংবা ‘তিনসঙ্গী’র মতো উপন্যাস বা গল্প দিয়ে কিংবা ‘ভালোবেসে, সখী, নিভৃতে যতনে, আমার নামটি লিখো– তোমার মনের মন্দিরে’ গান গেয়ে সে প্রেমে পড়ছে আবার বিরহে গেয়ে উঠছে- ‘ভালোবেসে যদি সুখ নাহি তবে কেন, তবে কেন মিছে ভালোবাসা’।

আবার দুঃখের মাঝেও- ‘বিপুল তরঙ্গ রে, সব গগন উদ্বেলিয়া, মগন করি অতীত অনাগত, আলোকে- উজ্জ্বল জীবনে-চঞ্চল একি আনন্দ-তরঙ্গ’- গান গাইতে গাইতে একজন বাংলাভাষী দুঃখের মাঝেও আনন্দ খুঁজে বেড়াচ্ছেন। এভাবেই চলতে চলতে একসময় ঈশ্বর কিংবা প্রকৃতির বন্ধনা শুরু করছেন কবিগুরুর পূজাপর্বের গান দিয়ে।

আবার গভীর কষ্টে ঈশ্বরের সাথে অভিমান করে গেয়ে উঠছে ‘দুঃখের তিমিরে যদি জ্বলে তব মঙ্গল-আলোক, তবে তাই হোক। মৃত্যু যদি কাছে আনে তোমার অমৃতময় লোক, তবে তাই হোক’।

ধীরে ধীরে বার্ধক্যে এসে সেই মানুষটা ঈশ্বরের সঙ্গে মিলিত হওয়ার আকুলতা জানাচ্ছে- ‘মালা হতে খসে-পড়া ফুলের একটি দল, মাথায় আমার ধরতে দাও, ওগো, ধরতে দাও। ওই মাধুরী সরোবরের নাই যে কোথাও তল, হোথায় আমায় ডুবতে দাও, ওগো, মরতে দা ‘ বা ‘সমুখে শান্তি পারাবার, ভাসাও তরণী হে কর্ণধার। তুমি হবে চিরসাথি, লও লও হে ক্রোড় পাতি, অসীমের পথে জ্বলিবে জ্যোতি ধ্রুবতারকা’ এই গানের মাধ্যমে। পরে তিনি অনন্তের পথে যাত্রা করছেন। সঙ্গে রবীন্দ্রনাথও।

আবার নতুন শিশু জন্মানোর সঙ্গে সঙ্গে তিনি নতুন করে প্রাসঙ্গিক হয়ে ফিরে আসছেন।

জীবনের প্রতিটি মুহূর্তের জন্যেই কবিগুরু আনুষঙ্গিক। জীবনের প্রতিটি মুহূর্ত, প্রতি মুহূর্তের আবেগ, অনুভূতি কোনো না কোনো গান, কবিতায় উনি প্রকাশ করেছেন। তার কবিতা, গান, ছোটগল্প, উপন্যাস কিংবা চিত্রকর্ম সবকিছুর মধ্যেই তিনি চিরভাস্বর হয়ে আছেন আমাদের মাঝে।

সারাজীবন পষ্টারিটির জন্য আক্ষেপ করা রবীন্দ্রনাথ মাত্র ৩৪ বছর বয়সে লিখেছেন ‘আজি হতে শতবর্ষ পরে, কে তুমি পড়িছ বসি আমার কবিতাখানি, কৌতূহল ভরে’।

কিংবা ‘যদি থাকি কাছাকাছি, দেখিতে না পাও ছায়ার মতন আছি না আছি– তবু মনে রেখো’ বা ‘তখন কে বলে গো সেই প্রভাতে নেই আমি। সকল খেলায় করবে খেলা এই আমি– আহা, নতুন নামে ডাকবে মোরে, বাঁধবে নতুন বাহু-ডোরে, আসব যাব চিরদিনের সেই আমি,’ এগুলোর মধ্যেও তার স্মরণীয় হওয়ার বাসনা।

শতবর্ষ নয়, সাধ্যশতবর্ষ পরেও রবীন্দ্রনাথ আজো আধুনিক, সমকালীন।

একজন মানুষের চিন্তাশক্তি কতোটা প্রখর হলে, ট্রেনে যেতে যেতে পথের পাশে হলদে, বেগুনি জঙ্গলিফুল দেখে ভেবে ফেলতে পারেন- কিছুকাল পরে রৌদ্র হবে প্রখর, ফুলগুলি তার রঙের মরীচিকা নিয়ে যাবে মিলিয়ে। সুন্দরী যুবতী যদি অনুভব করে যে সে তার যৌবনের মায়া দিয়ে প্রেমিকের হৃদয় ভুলিয়েছে তাহলে সে তার সুরূপকেই একদিন দায়ী করবে আপন সৌভাগ্যে ভাগ বসানোর জন্য। এই ভাবনায় উনি চিত্রাঙ্গদার মতো গীতিনাট্য লিখে ফেললেন, যেখানে কাউকে পাওয়ার জন্য ব্যকুলতা এবং পাওয়ার পর সেটাকে তুচ্ছ মনে হওয়ার যে মানসিক প্রবৃত্তি সেটাকে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে।

নোবেল পাওয়ার পর কলকাতা থেকে যখন কবিগুরুকে সম্বর্ধনা দেওয়ার প্রস্তাব দেওয়া হলো তখন উনি সেটাকে প্রত্যাখ্যান করে বললেন- আমি পূর্বের দেবতাকে একটা অর্ঘ্য দিতে চেয়েছিলাম, পশ্চিমের দেবতা সেটা গ্রহণ করেছে। আজ পাশ্চাত্য লোকেরা আমার সাহিত্যের প্রশংসা করেছেন বলে যদি আপনাদের কাছে আমার বিচার বদলে যায়, তবে সেটা অবিচার হবে এবং উনি ‘এ মণিহার আমায় নাহি সাজে’ গানটিও লিখে ফেললেন। প্রত্যাখ্যানে উনার চূড়ান্ত রুচি। অথচ জীবনের প্রতি মুহূর্তে সংগ্রাম করে একটার পর একটা মৃত্যশোক কাটিয়ে উনাকে যেতে হয়েছে। রবীন্দ্রনাথের বৌদি কাদম্বরী দেবী যিনি রবীন্দ্রনাথকে কবিতা লিখতে উৎসাহ দিতেন তিনি আত্মহত্যা করলেন। তখন রবীন্দ্রনাথ ২১ বছরের যুবক।

এরপর তার স্ত্রী মৃণালিনী দেবী মাত্র ২৯ বছর বয়সে মারা যান, তখন রবীন্দ্রনাথ ৪০ বছর। এর নয় মাস পর তার দ্বিতীয় মেয়ে রেনুকা ১৩ বছরেই মারা যায়। তার চার বছর পর কবিগুরুর ছোট ছেলে  শমীন্দ্রনাথ ১৩ বছর বয়সে কলেরায় মারা যায়। এরপর মেয়ে মাধুরীলতাও মারা গেলেন যক্ষ্মাতে। এরপর তার অন্য মেয়ে মীরা দেবী স্বামীর সাথে বনি-বনা না হওয়ায় এক ছেলে এবং এক মেয়েকে নিয়ে জোড়াসাঁকোতে চলে এলেন। বড় ছেলে রথীন্দ্রনাথকে বিয়ে দিলেন কিন্তু তার বাচ্চা না হওয়ায়, রবীন্দ্রনাথ মনে করেছিলেন মীরা দেবীর ছেলে নীতিন্দ্রনাথই তার বংশ রক্ষা করবে। কিন্তু, ছেলেটি জার্মানিতে থাকাকালীন ১৯৩২ সালের ৭ আগস্ট মাত্র ২০ বছর বয়সে মারা যান।

নীতিন্দ্রনাথ মারা যাওয়ার পর সবচাইতে আঘাত পেয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ। ঐদিনই তিনি লিখেছিলেন ‘দুর্ভাগিনী’। কবিতাটির লাইনগুলো- “তুমি স্থির সীমাহীন নৈরাশ্যের তীরে, নির্বাক অপার নির্বাসনে। অশ্রুহীন তোমার নয়নে অবিশ্রাম প্রশ্ন জাগে যেন— কেন, ওগো কেন!” যেখানে মনে হচ্ছে ঈশ্বরের প্রতি তার ভক্তি শিথিল হয়ে আসছে।

মীরা দেবীর কন্যা, নন্দিতা দেবীর বিয়ে হয় এবং ৫১ বছর বয়সে তিনি মৃত্যুবরণ করেন। তার কোনো সন্তানাদি হয়নি।

এভাবে একটার পর একটা শোক কাটিয়ে ওঠা রবীন্দ্রনাথই জীবনের শেষ মুহূর্তে আকুতি জানাচ্ছেন অপারেশন না করার জন্য। মনে-প্রাণে তিনি শেষ মুহূর্তে অপারেশনটা চাননি। রথীন্দ্রনাথকে বলছেন কবিরাজের উপর ভরসা করতে। ডাক্তার বিধান রায়কে অনুরোধ করেছেন অপারেশন না করতে।

অপারেশনের পর ২২ শ্রাবণ তিনি মারা গেলেন। আসলে মারা যাননি, অনন্তের পথে যাত্রা করলেন।

এই দেবতুল্য মানুষটার শেষ যাত্রায় চূড়ান্ত অসম্মান করেছি আমরা। ‘ডাকঘর’ নাটকে অমল চরিত্রের জন্য লেখা ‘সমুখে শান্তি পারাবার, ভাসাও তরণী হে কর্ণধার’ গানটা- নাটকে ব্যবহার না করে তার মৃত্যুর পর গাওয়ার অনুরোধ করে গেলেন। তার শবযাত্রায় জয়ধ্বনি না দেওয়ার অনুরোধ করলেন।

কিন্তু, হলো ঠিক তার উল্টো- ঐ গানটা গাওয়া তো হলোই না বরং ‘বিশ্বকবি কী জয়’ ধ্বনি দিতে দিতে উনাকে নিয়ে যাওয়া হলো শ্মশানে।

যে ঠাকুরবাড়ি সেই সময়ে কলকাতায় ব্রাত্য ছিলো, সেই রবীন্দ্রনাথের শ্মশানযাত্রায় এতো লোক হয়েছিলো যে তার ছেলে রথীন্দ্রনাথ ভিড় ঠেলে শ্মশানে যেতে না পারায় বাবার মুখাগ্নিও করতে পারেননি।

কবিগুরু আপনি সবসময়ের জন্য প্রাসঙ্গিক, আপনি আছেন, থাকবেন অনন্তকাল আমাদের মণিকোঠায়, দেবতার আসনে।

প্রণমি চরণে তব।

পার্থ প্রতীম ভট্টাচার্য্য, প্রধান প্রতিবেদক, দ্য ডেইলি স্টার

[email protected]

Comments