কমেছে ধানের দাম, বেড়েছে কৃষকের হতাশা

লালমনিরহাট সদর উপজেলার ফকিরেরতকেয়া গ্রামের কৃষক সিরাজুল ইসলাম (৫৬) এবছর বোরো মৌসুমে আট বিঘা জমি থেকে ৯০ মন ধান পান। দাম কম হওয়ায় দুই মাস আগে পরিবারের প্রয়োজনে মাত্র ১০ মন ধান বিক্রি করেছিলেন আর ভেবেছিলেন পরে ধানের দাম বাড়লে বিক্রি করবেন। কিন্তু, তার আশার গুড়ে বালি পড়েছে। দামের তো বাড়েনি বরং আগের চেয়ে দাম কমেছে।
Lalmonirhat Farmer Mantu Mandal
দাম কমে যাওয়ায় ধান নিয়ে চরম হতাশায় আদিতমারী উপজেলার সারপুকুর গ্রামের কৃষক মন্টু মণ্ডল। ছবি: স্টার

লালমনিরহাট সদর উপজেলার ফকিরেরতকেয়া গ্রামের কৃষক সিরাজুল ইসলাম (৫৬) এবছর বোরো মৌসুমে আট বিঘা জমি থেকে ৯০ মন ধান পান। দাম কম হওয়ায় দুই মাস আগে পরিবারের প্রয়োজনে মাত্র ১০ মন ধান বিক্রি করেছিলেন আর ভেবেছিলেন পরে ধানের দাম বাড়লে বিক্রি করবেন। কিন্তু, তার আশার গুড়ে বালি পড়েছে। দামের তো বাড়েনি বরং আগের চেয়ে দাম কমেছে।

বর্তমানে লালমনিরহাটের বাজারগুলোতে হাইব্রিড জাতের প্রতিমন (৪০ কেজি) বোরো ধান বিক্রি করা হচ্ছে ৩৪০ থেকে ৪০০ টাকায় আর বিরি জাতের বোরো ধান প্রতিমন বিক্রি হচ্ছে ৪২০ থেকে ৪৮০ টাকায়। কিন্তু, দুই মাস আগে বাজারে ধানের দর ছিলো ৪২০ থেকে ৫২০ টাকা।

“দুই মাস আগে ৪৭৫ টাকা দরে ১০ মন ধান বিক্রি করেছিলাম। কিন্তু, দুই মাস পরে স্থানীয় হাটে একই ধান প্রতিমন ৪২০ টাকা দরে বিক্রি করলাম। দশ মন ধান বিক্রি করে পেয়েছি ৪ হাজার ২০০ টাকা,” জানালেন কৃষক সিরাজুল। “ধানের বাজারে ক্রেতা সঙ্কট,” হতাশার সাথে এ কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, “কমদামে ধান বিক্রি করতে খুব কষ্ট হয়।”

একই উপজেলার সিন্দুরমতি গ্রামের কৃষক তবারক আলী (৫৮) জানালেন বর্তমানে ধানের দাম কমে প্রতিমন (৪০ কেজি) ৪০০ টাকা থেকে ৪৫০ টাকা দরে বিক্রি করা হচ্ছে। অথচ একই ধান দুই মাস আগে ৪৭০ টাকা থেকে ৫১০ টাকা দরে বিক্রি করা হয়েছিলো।

“সতের বিঘা জমি থেকে ২০০ মন ধান পেয়েছি। কিন্তু, বিক্রি করেছি মাত্র ৬৫ মন। আর বাকি ধান এখনো বাড়িতে পড়ে আছে,” জানালেন কৃষক তবারক আলী। “ভেবেছিলাম ধানের দাম বাড়বে তাই প্রথমে বিক্রি করি নাই। এখন দেখি আগের দামই ভালো ছিলো,” তিনিও হতাশা প্রকাশ করে এমন মন্তব্য করেন। বলেন, “আমার কৃষি কার্ড আছে। সরকারি মূল্যে ধান বিক্রি করতে গুদামে গিয়েছিলাম। কিন্তু, আমার ধান কম শুকানো হয়েছে দেখিয়ে তা ফেরত দেওয়া হয়।”

“বিরক্ত হয়েছি, তাই আর চেষ্টা করিনি,” যোগ করেন তবারক।

আদিতমারী উপজেলার সারপুকুর গ্রামের কৃষক মন্টু মণ্ডল (৫৮) রাগ করেই বলছিলেন- আড়াই মাস আগেই ধান বিক্রি করা উচিৎ ছিলো। কারণ, তখনকার চেয়ে ধানের দাম মন প্রতি ৫০ থেকে ৬০ টাকা কমেছে। “দেড়শ মন ধান পেয়েছি বারো বিঘা জমি থেকে। বিক্রি করেছি মাত্র ৩৫ মন। বাকি ধান নিয়ে রয়েছি বিপাকে,” জানালেন তিনি। “সরকারি গুদামে ১২ মন ধান বিক্রি করেছি নানা হয়রানির পর,” এমনটি জানিয়ে তিনি বলেন, “ধানের দাম দিন দিন আরো কমছে।”

একই উপজেলার দোলজোড় গ্রামের কৃষক নারায়ণ চন্দ্র রায় (৫৫) জানালেন, ধান আবাদ করে গলায় কাটা লেগেছে আরো কাটা লেগেছে একমাস আগে ধান বিক্রি না করায়। “ধান হাটে নিয়ে যাই আবার ফিরিয়ে নিয়ে আসি। এভাবে কতোদিন চলবে? আর ধান বিক্রি করতে না পারলে সংসার চালাবো কীভাবে? অন্য ফসল আবাদ করবো কিভাবে?” এমনই অনেক প্রশ্ন তুলে নারায়ণ জানান, কৃষি কার্ড থাকা সত্ত্বেও তিনি সরকারি গুদামে ধান বিক্রির সুযোগ থেকে বঞ্চিত হয়েছেন। তিনি এবছর বোরো মৌসুমে ১০ বিঘা জমি থেকে ১২৫ মন ধান পেয়েছেন তার মধ্যে বিক্রি করেছেন মাত্র ৩২ মন।

বড়বাড়ী হাটের ধান ব্যবসায়ী মোখলেছুর রহমান জানান, তিনি প্রতিমন ধান কিনছেন ৩৪০ টাকা থেকে ৪৮০ টাকা দরে। দুই মাস আগেও আগে একই ধান ৪২০ থেকে ৫২০ টাকা দরে কিনেছিলেন। “আমরা ছোট পাইকার। কৃষকের কাছে ধান কিনে বড় ব্যবসায়ীর কাছে মনপ্রতি ৮ টাকা থেকে ১০ টাকা লাভে বিক্রি করি। বড় ব্যবসায়ীর দেওয়া দর অনুযায়ী আমরা কৃষকের কাছে কমদামে ধান কিনছি,” তিনি জানান।

লালমনিরহাট শহরের ধান ব্যবসায়ী নুর ইসলাম জানান, বাজারে ধানের সরবরাহ প্রচুর আর চাহিদা কম। তাই ধানের দাম বাড়ছে না বরং কমছে। “সরকারিভাবে ধান-চাল সংগ্রহ প্রায়ই শেষের দিকে। তাই বাজারে ধানের চাহিদাও কমছে,” এমনটি জানালেন তিনি।

তবে জেলা মার্কেটিং অফিসার আব্দুর রহিম দাবি করে বলেন, বাজারে প্রতিমন ধান ৪৬০ টাকা থেকে ৫২০ টাকা দরে বিক্রি করা হচ্ছে। ধানের দাম না বাড়লেও আগের থেকে কমেনি বলে তিনি জানান। তবে হাইব্রিড জাতের বোরো ধান অনেক কমদামে বিক্রি হচ্ছে বলেও উল্লেখ করেন তিনি। “আসলে হাইব্রিড বোরো ধানের চাল এখন আর কেউ খেতে চান না,” এমনটি উল্লেখ করে তিনি বলেন, “ধানের দাম বাড়ার কোনো সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে না।”

আদিতমারী উপজেলার উপজেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক সাজ্জাদুর রহমান জানান, কৃষকের সংখ্যা অনেক হওয়ায় লটারির মাধ্যমে কৃষক নির্বাচন করে ধান কেনা হচ্ছে। এতে অধিকাংশ কৃষকই বাদ পড়ে যাচ্ছেন। “সরকারিভাবে ধান কেনার সময় আমরা ধানের জাত যাচাই করি না। শুধু দেখি কোয়ালিটি আর ময়েশ্চার ঠিকমতো আছে কী না,” বলেন তিনি।

জেলার পাঁচটি উপজেলার প্রায় ৫৫ হাজার কৃষক ৪৮ হাজার ১৫০ হেক্টর জমি থেকে প্রায় ৩ লাখ ১৯০ হাজার ১০৫ মেট্রিক টন বোরো ধান উৎপন্ন করেছেন। শুধু ৬ হাজার ৯৮৬ জন কৃষকের কাছ থেকে প্রতিকেজি ২৬ টাকা দরে ৩,৪৯৩ মেট্রিক টন ধান ক্রয় করছে সরকার।

এস দিলীপ রায়, দ্য ডেইলি স্টারের লালমনিরহাট সংবাদদাতা

Comments

The Daily Star  | English

Abu sayed’s death in police firing: Cops’ FIR runs counter to known facts

Video footage shows police shooting at Begum Rokeya University student Abu Sayed, who posed no physical threat to the law enforcers, during the quota reform protest near the campus on July 16. He died soon afterwards.

8h ago