কৃষকের ধান নয়, মিল মালিকদের থেকে দ্বিগুণ চাল কিনেছে সরকার
কৃষকদের কাছ থেকে ধান ক্রয়ের লক্ষ্যমাত্রার দ্বিগুণ পরিমাণ চাল সুনামগঞ্জের মিল মালিকদের কাছ থেকে কিনেছে সরকার। এতে ওই অঞ্চলের ধান কম দামে চলে গেছে ফড়িয়াদের হাতে। তাছাড়া ধানের দাম উৎপাদন খরচের চেয়েও কম হওয়ায় ভবিষ্যতে অনেক কৃষকই ধান চাষাবাদ ছেড়ে দিতে পারেন বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।
বিশ্বম্ভরপুরের করচার হাওরপাড়ের কৃষক কামরুল ইসলাম বলেন, “বাজারে বর্তমানে ধানের দাম ৫৫০ থেকে ৬৫০ টাকা। লটারির মাধ্যমে কিছু ধান সরকারি খাদ্য গুদামে দেওয়ার আশায় ছিলাম। লটারিতে নাম ওঠেনি। সরকারি খাদ্য গুদামে ধান দিতে পারলে কিছুটা জীবনরক্ষা হতো। এখন যে অবস্থা তাতে ধান চাষ করার চেয়ে না করাই ভালো। ক্ষেতের মধ্যেই খরচ হয় মণপ্রতি ৬০০ টাকা। ধান বেচে নিজে চলবো, না ঋণ দিবো? ধান পেয়ে আরও বেশি বিপদে পড়েছি।”
তিনি জানান, মুক্তিখলা গ্রামে ১৯০ জন কৃষক রয়েছেন। ধান দেওয়ার জন্য লটারিতে ৮-১০ জনের নাম উঠেছে। বাকিদের সকলেরই একই অবস্থা।
বিশ্বম্ভরপুর প্রেসক্লাবের সভাপতি কৃষক নেতা স্বপন কুমার বর্মণ জানান, উপজেলার প্রত্যেক গ্রামের কৃষকরা চাষাবাদের সময়ই ব্যাংক ঋণ বা মহাজনদের কাছ থেকে ধানী ঋণ নেন। ধান বিক্রি করে এই ঋণ পরিশোধ করেন। এইবার ধান বিক্রি করে উৎপাদন খরচই ওঠেনি। এখন ঋণ দেবেন কীভাবে, ছেলে-মেয়েদের পড়াশুনাসহ অন্যান্য খরচ মেটাবেন কীভাবে?
তিনি বলেন, “এক মণ ধান বিক্রি করে এক কেজি মাছ কেনা যায় না, এর চেয়ে কষ্টের আর কী আছে। কৃষক চাষাবাদের ওপর নির্ভর করে এখন আর বাঁচতে পারবে না।”
জানা গেছে, বিশ্বম্ভরপুর উপজেলায় সরকারি খাদ্য গুদামে ধান দেওয়ার জন্য ১ হাজার ৪০০ কৃষক আবেদন করেছিলেন। ৫৫৫ জনের নাম লটারিতে ওঠেছে। বাকী ৮৪৫ জন ধান কোথায় বিক্রি করবেন এই নিয়ে দুশ্চিন্তায় রয়েছেন।
কেবল বিশ্বম্ভরপুর উপজেলাতেই এমন চিত্র নয়। পুরো সুনামগঞ্জ জেলায় কৃষকের এমন দুর্দশা।
শাল্লা উপজেলায় সরকারি খাদ্য গুদামে ধান দেওয়ার জন্য আবেদন করেছিলেন ৬ হাজার ৬১৯ জন কৃষক। লটারিতে নাম ওঠেছে ১ হাজার ৪৩৮ জনের। এর মধ্যে ধান দিতে পারবেন ৯১২ জন। আগে যারা আসবেন, কেবল তারা ধান দেবেন। ৯১২ জনের ধান নেওয়ার পর লটারিতে নাম ওঠলেও সেই কৃষকের ধান নেওয়া হবে না।
লটারিতে নাম ওঠার পর কেনো ধান দিতে পারবে না, এমন প্রশ্নের উত্তরে উপজেলা খাদ্যগুদাম কর্মকর্তা আশিস কুমার রায় বলেন, “কৃষকরা যাতে প্রতিযোগিতামূলকভাবে আগে আগে আসেন, এজন্য এই ব্যবস্থা করা হয়েছে।”
জেলার সাড়ে তিন লাখ কৃষকের উৎপাদিত প্রায় ১৩ লাখ টন ধানের মধ্যে ১৯ আগস্ট পর্যন্ত জেলার সব কয়টি ক্রয় কেন্দ্র মিলে ধান কেনা হয়েছে ৯ হাজার ৪৪৪ টন। ৩১ আগস্ট পর্যন্ত এই ধান কেনা চলবে। সব মিলিয়ে ধান কেনার কথা ১৭ হাজার ৩৫৩ টন।
অন্যদিকে, ৩০০ মিলারদের কাছ থেকে জেলায় এবার চাল কেনা হবে ৩৩ হাজার ৯৭৭ টন। ১৯ আগস্ট পর্যন্ত চাল কেনা হয়েছে ১৬ হাজার ৪৯৬ টন।
ধান নিয়ে কৃষকদের এমন উৎকণ্ঠা প্রসঙ্গে মন্তব্য করতে গিয়ে ধর্মপাশার কেন্দ্রীয় কৃষক সংগ্রাম সমিতির আইন বিষয়ক সম্পাদক খায়রুল বাসার ঠাকুর খান বলেন, “সরকারের ধান কেনার সদিচ্ছা নেই। লটারির নামে দলীয় নেতা-কর্মীদের সুবিধা দেওয়ার অপচেষ্টা হয়েছে। সবকিছু মিলে এমন পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছে যে, কৃষক যে সরকারি গুদামে ধান দিতে পারবেন, এই আশাই ত্যাগ করেছেন। কৃষকের এই নেতিবাচক মনোভাব ভবিষ্যতে ভয়ঙ্কর পরিণতি ডেকে আনবে।”
তিনি আরও বলেন, “আমরা মনে করি ফসল ওঠার সঙ্গে সঙ্গেই বিভিন্ন বড় বড় বাজারে-ইউনিয়নে ইউনিয়নে সরকারিভাবে প্রকাশ্যে ধান ক্রয় করতে হবে। ধান ক্রয়ের পরিমাণও বাড়াতে হবে।”
জেলা সিপিবির সাধারণ সম্পাদক এবং হাওরের কৃষি ও কৃষক রক্ষা সংগ্রাম পরিষদের সদস্য সচিব চিত্তরঞ্জন তালুকদার বলেন, “ধান কেনা বিলম্বে শুরু হয়েছে। নিয়মের নামে শুভঙ্করের ফাঁকি দেওয়া হয়েছে। কৃষক যেনো মাথা তুলে না দাঁড়াতে পারেন, পরবর্তীতে কৃষি কাজে নিরুৎসাহিত হন, এই ছবি দেখতে পাচ্ছি আমরা।”
সুনামগঞ্জের সবচেয়ে বড় ধানের আড়ত মধ্যনগরের ধান আড়তদার সমিতির সভাপতি জ্যোতির্ময় রায় জানান, কোরবানির ঈদের জন্য গত সপ্তাহে ধান ক্রয় বেশি করা গেছে। আমরা ধান কিনছি ৬৪০ থেকে ৬৮০ টাকা মণ দরে। ধান বিক্রি করে হাতে টাকা নিয়ে কৃষকরা মন খারাপ করে বাড়ি ফিরছেন।
‘হাওর বাঁচাও, সুনামগঞ্জ বাঁচাও’ আন্দোলনের সভাপতি বজলুল মজিদ চৌধুরী খসরু বলেন, “সময় মত সরকারিভাবে ধান না কেনায় কৃষকরা বাধ্য হয়ে কম দামে ফড়িয়াদের কাছে ধান বিক্রি করেছেন। সরকারিভাবে ধান কেনার পরিমাণও তুলনামূলক কম। আবার ধানের চেয়ে চাল কেনা হচ্ছে বেশি। চাল কিনলে কৃষকের কোনো উপকার হয় না। অথচ চাল কেনা হচ্ছে বেশি। এসব বিষয় নিয়ে ইতিবাচক সিদ্ধান্ত না নিলে, হাওরাঞ্চলে ধানের উৎপাদন কমে যাবে।”
জেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক জাকারিয়া মোস্তফা বলেন, “ধান কেনার নির্দেশনা এসেছিলো ২৯ এপ্রিল। কৃষক তালিকা পাওয়া গেছে ১৮ মে। দ্বিতীয় দফায় ধান কেনার লক্ষ্যমাত্রা বাড়ানো হয় ১৮ জুনে। ওই সময় আবার বন্যা দেখা দেওয়ায় আমরা গোডাউনে রাখা ধান নিয়েই চিন্তায় ছিলাম। এজন্য ধান কিনতে কিছুটা বিলম্ব হয়েছে।”
ঠিক সময়ে ধান কিনতে পারলে ভালো হতো বলে স্বীকার করে তিনি জানান, কৃষক ছাড়া কোনোভাবেই অন্য কারো কাছ থেকে ধান কেনা হবে না। ৩১ আগস্ট পর্যন্ত ধান ক্রয়ের শেষ সময়সীমা হলেও সময় বাড়ানোর জন্য আবেদন করবেন তারা।
Comments