‘২ কোটি টাকা ভাগের সংবাদে শিক্ষক হিসেবে খুব বিব্রত বোধ করি’
‘২ কোটি টাকার ভাগ-বাটোয়ারা’র সংবাদে আলোচিত জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়। দ্য ডেইলি স্টারে প্রকাশিত ‘শিক্ষা নয়, জাবির আলোচনার বিষয় ‘২ কোটি টাকার ভাগ-বাটোয়ারা’ শিরোনামের সংবাদটিতে অভিযোগ আকারে উঠে এসেছে ছাত্রলীগ নেতাদের টাকা ভাগ করে দেওয়ার প্রসঙ্গ। অভিযোগ এসেছে, ২ কোটি টাকা ভাগ-বাটোয়ারা হয়েছে উপাচার্যের বাসভবনে এবং উপাচার্য ও তার পরিবারের সদস্যদের উপস্থিতিতে। এমন সংবাদের প্রেক্ষিতে কী ভাবছেন উপাচার্য বা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকেরা।
দ্য ডেইলি স্টার অনলাইনের পক্ষ থেকে আজ (২৮ আগস্ট) বিষয়টি নিয়ে কথা হয়েছে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ, শিক্ষক সমিতির সাধারণ সম্পাদক অধ্যাপক সোহেল রানা এবং নৃবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক মানস চৌধুরীর সঙ্গে। চেষ্টা করেও কথা বলা সম্ভব হয়নি উপাচার্য ফারজানা ইসলামের সঙ্গে।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ বলেন, “জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়নের যে কথা আমরা শুনি তা নিয়ে উপাচার্যের সঙ্গে আমাদের কথা হয়েছে। আমরা তাকে কিছু সুনির্দিষ্ট সুপারিশ দিয়েছিলাম। তার মধ্যে ছিলো যে মাস্টার প্ল্যান একটি দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা, এটি বাস্তবায়ন করতে গেলে স্বচ্ছতা থাকা দরকার। বিশ্ববিদ্যালয়ের বিশেষজ্ঞ শিক্ষকরা এতে অবদান রাখতে পারেন। তাদেরকে ইনভলভ করা দরকার। আমাদের অনেক অবকাঠামো রয়েছে যেগুলো ব্যবহারযোগ্য নয় বা অসুবিধাজনক। আমাদের সমাজবিজ্ঞান ভবন ও আবাসিক হলগুলোর কন্সট্রাকশনের মান খুবই খারাপ। সে কারণে আমাদের টেন্ডার প্রসেসসহ ও অন্যান্য বাধা কিংবা লুকোচুরি বা পক্ষপাতিত্বমূলক যে ব্যবস্থা রয়েছে, সেগুলো দূর করতে হবে।”
“আমরা বলেছিলাম যে, পরিকল্পনাটি জনসম্মুখে প্রকাশ করেন। শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা জানুক এবং তাদের যদি পরামর্শ থাকে তাহলে তা বলবেন। অন্তত তিনমাস সময় দেন এবং তারপর তা চূড়ান্ত করেন। কিন্তু, দেখা যাচ্ছে যে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য এবং তার সহযোগী যারা এবং সরকারি ছাত্র সংগঠনের মধ্যে তাড়াহুড়ার ভাব রয়েছে।”
“ছাত্রলীগের নেতারা যারা চার সিটের রুম একাই দখল করে বসে আছে তারাই বলছে তাড়াতাড়ি আবাসিক হল তৈরি করতে হবে। তাদের জন্যেই হলগুলোতে সন্ত্রাসী পরিস্থিতি বা আবাসন সঙ্কট সৃষ্টি হয়েছে। শিক্ষকদের মধ্যেও একটি গোষ্ঠীও তাড়াহুড়া করছেন।”
“তারা কেন তাড়াহুড়া করছেন তা সেই ‘দুই কোটি টাকা ভাগ-বাটোয়ারা’র প্রকাশিত সংবাদের মাধ্যমে একটা ব্যাখ্যা পাওয়া যায়। উন্নয়ন খাতে টাকার পরিমাণ বিপুল হওয়ার কারণে তারা দ্রুত তাদের পকেট ভারী করতে চায়। সে কারণেই তারা স্বচ্ছতা আনতে চায় না।”
“এই দুই কোটি টাকার সংবাদ প্রকাশিত হওয়ার পর তা প্রকাশ্যে চলে আসে। উপাচার্যের বাসভবনে এমন একটি ঘটনা ঘটার অভিযোগ এসেছে- এর চাইতে লজ্জাজনক খবর আর কী হতে পারে? কি ভয়াবহ অভিযোগ, উপাচার্য তার ঘরে বসে পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে নিয়ে জনগণের টাকাকে লুটের টাকা বানিয়ে তা ভাগাভাগি করছেন- এর চেয়ে ন্যক্কারজনক ঘটনা আর কী হতে পারে আমি জানি না। যে শিক্ষকরা এর সঙ্গে জড়িত তাদের শিক্ষক থাকার যোগ্যতা রয়েছে বলে আমি মনে করি না। তাদের কোনো প্রশাসনিক দায়িত্বে থাকার অধিকার নেই। ছাত্র সংগঠনের যারা জড়িত তাদেরও শিক্ষার্থীদের নেতৃত্ব দেওয়ার অধিকার নেই।”
“যেহেতু এটি সরকার দলীয় ছাত্র সংগঠন এবং সরকারের নিয়োগ পাওয়া উপাচার্য তাই দায়টি সরকারের ওপরেই পড়ে। সে কারণে আমি মনে করি, এর তদন্ত হওয়া উচিত। তদন্তের আগে নির্মাণ কাজ বন্ধ রাখা উচিত। স্বচ্ছতার সঙ্গে টেকসইভাবে যাতে নির্মাণকাজটি হয় সে বিষয়ে সরকারকেই উদ্যোগ নিতে হবে। সরকারের প্রতিনিধি হিসেবে মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) নেতৃত্বমূলক ভূমিকা নেওয়া উচিত।”
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির সাধারণ সম্পাদক অধ্যাপক সোহেল রানা বলেন, “পত্র-পত্রিকার মাধ্যমে বিষয়টি জেনেছি। প্রথম কথা, এটি আমার কাছে অবিশ্বাস্য মনে হয়। এমন সংবাদে শিক্ষক হিসেবে আমি খুব বিব্রত বোধ করি। বিশ্ববিদ্যালয়ে টাকা-পয়সা লেনদেন হবে এটা আমরা কখনো ভাবি না। আমার কাছে মনে হয়, এটা খুবই অশুভ চক্রান্ত। বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়নের জন্যে টাকা এনে এভাবে ভাগ-বাটোয়ারা করা খুবই অনৈতিক এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের সবার জন্যে বিব্রতকর। এর দুর্নাম আমাদের ঘাড়ে পড়বে।”
“শিক্ষক সমিতি থেকে আমাদের উদ্বেগ রয়েছে। আমরা বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের সঙ্গে কথা বলেছি। আরও কথা বলবো। এ বিষয়গুলোর ব্যাখ্যা আমরা যেনো প্রশাসন থেকে পাই সেই আশাই করবো। আমরা যখন কথা বলতে চেয়েছি, তখন অনেকেই বলেছিলেন- এমন খবর বিশ্বাসযোগ্য নয়। সাংবাদিকদের তৈরি করা নিউজ। আবার সাংবাদিকদের সঙ্গে যখন কথা বলেছি তারা বলেছে- যথেষ্ট সাক্ষ্য-প্রমাণের ভিত্তিতে নিউজ করা হয়েছে। প্রশাসন থেকে সুস্পষ্ট ব্যাখ্যা এলে এর সহজ সমাধান হতে পারে। তাহলে বিতর্কগুলো বাড়বে না।”
“বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়নের বিরোধিতা কেউ করছেন না। কিন্তু, এধরনের খবর প্রকাশিত হলে সবার মধ্যে সেই উন্নয়ন নিয়ে বিভ্রান্তি তৈরি হয়। সেই উন্নয়নকে টেকসই করার জন্যে প্রশাসনের উচিত সব স্টেকহোল্ডারের সঙ্গে কথা বলা। সব বিতর্কের ঊর্ধ্বে যেনো কাজটি হয়।”
উপাচার্যের বাসভবনে এই ঘটনা ঘটেছে বলে অভিযোগ উঠেছে- “এটি আরও ভয়ানক অভিযোগ। উপাচার্যের বাসভবনে টাকা-পয়সার লেনদেন অভিপ্রেত না। আমরা অবশ্যই চাইবো যে প্রশাসন থেকে এর সুস্পষ্ট ব্যাখ্যা আসবে।”
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক মানস চৌধুরী বলেন, “দুই কোটি টাকা ভাগের যে খবর তা অসমর্থিত সূত্রে জানা গেছে। এছাড়াও, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন দুর্নীতির খবর পত্রিকাতে প্রকাশিত হয়েছে। এগুলোর ফলোআপ না থাকাতে বা রাষ্ট্রীয়ভাবে কোনো তদন্ত না হওয়াতে আমার মতো একজন পেশাজীবীর কাছে এগুলো অসমর্থিত সূত্র। প্রশাসনের সঙ্গে ছাত্রনেতাদের সম্পর্ক সুবিদিত। এই দুই কোটি টাকার বিষয়ে আমার হাতে কোনো প্রমাণ নেই।”
“বিশ্ববিদ্যালয়ের মাস্টারপ্ল্যানের একটি দিক হচ্ছে একে অ্যাকোমেটেটিভ করতে হবে এবং নান্দনিক ও প্রকৃতিগত প্রসঙ্গ হচ্ছে অন্যদিক। এ বিষয়ে ধারাবাহিকতা রাখার জন্যে প্রশাসনকে দূরদর্শী হতে হবে এবং সততা রাখতে হবে। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের কথা বাদই দেন, এই শব্দদুটো কোন পাবলিক সেক্টরে রয়েছে?”
“কিছু কিছু ক্ষেত্রে বিশ্ববিদ্যালয়ের এই প্রশাসন সংলাপধর্মী। উপাচার্য শান্তভাবে বক্তৃতা দেন। কিন্তু, আমি মনে করি না, নতুন যে উন্নয়ন পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে সেটি আসলে আদৌ ক্যাম্পাসের কোনো বিবেচনা মাথায় রেখে এগুচ্ছে। আমি এর দায়দায়িত্ব কিছুটা দেবো সরকারকে। দায় রয়েছে দূরদর্শীতাহীন, অস্বচ্ছ এবং দ্রুতগতিতে অর্থবছর শেষ করার চাপে থাকা প্রশাসন।”
“গত পাঁচ-সাত বছরে আমি কোনো নজির দেখি না যে প্রশাসনের কোনো কাজে, কোনো গুরুত্বপূর্ণ সমালোচনা ছাত্রলীগ করেছে। যখন প্রশাসনের সঙ্গে তাদের সম্পর্কটা সহগের তখন হঠাৎ করে তারা প্রশাসনের কাজে বাধা দিবে না- এটাতে কোথাও না কোথাও জার্নালিস্টিক অতিকথন রয়েছে বলে আমি মনে করি। কারো বাধা দেওয়ার ইতিহাস থাকলে তো বাধা না দেওয়া প্রসঙ্গ আসে।”
ছাত্রলীগের কোন নেতা কতো টাকা পেয়েছেন- যে বিষয়টিও সংবাদে প্রকাশিত হয়েছে।- “সাংবাদিকরা যদি সেই সংক্রান্ত তথ্য-উপাত্ত দেখান, আমি দেখতে কৌতূহলী হবো, তবে বিস্মিত হবো না।”
তাহলে নৈতিকতার বিষয়টি আসলে কোথায় থাকলো?- “প্রশাসন কীভাবে চলা দরকার এর একটি লিখিত বা বোধগম্য রূপ রয়েছে। পাওয়ার নেক্সাস এই লিখিত বা বোধগম্য রূপের বাইরে অন্যান্য উপায়ে এর প্রতিপক্ষদের সামলায় তখন সেটিকেই হয়তো বলা হচ্ছে অনৈতিকতা আমার কাছে সেটি দুঃশাসন।”
ক্যাম্পাসে এ নিয়ে আন্দোলন চলছে- “হ্যাঁ, সাংস্কৃতিক-বামরা ক্যাম্পাসে গাছ কাটার প্রতিবাদ করছে। তাদের প্রতি আমার সায় রয়েছে। তারা মনে করে যে এই উন্নয়ন পরিকল্পনা এটি আত্মঘাতী এবং মূলত টাকার চাপে চলছে। আমি তাদের আন্দোলনকে সমর্থন করি।”
ছাত্রলীগের কোন নেতা কতো টাকা পেয়েছেন সে কথা গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে।- “বাংলাদেশে এগুলো এতো বাস্তব ঘটনা যে বিস্মিত হওয়ার কিছু নেই। সত্যিই সত্যিই টাকা-পয়সা অনেকদিন ধরেই এভাবেই ভাগ করা হয়। এবার টাকার পরিমাণটা বড় বলে অনেকের কৌতূহল বেড়েছে।”
আরও পড়ুন: শিক্ষা নয়, জাবির আলোচনার বিষয় ‘২ কোটি টাকা’র ভাগ-বাটোয়ারা
আরও পড়ুন: জাবি ছাত্রলীগের দলীয় কোন্দল ও সংঘর্ষের নেপথ্যে ৪৫০ কোটি টাকার নির্মাণ কাজ
আরও পড়ুন: জাবিতে চলমান উন্নয়ন পরিকল্পনার ‘মাস্টারপ্ল্যানে’ গোড়ায় গলদ!
Comments