দুই হাজার কোটি টাকার ডিজিটাল প্রচারণার বাজার!

কম খরচে গ্রাহককে একেবারে পিনপয়েন্ট করে বিজ্ঞাপন প্রচারের উপায় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে যেভাবে মেলে, প্রচলিত গণমাধ্যমে সেভাবে মেলে না। এ কারণে নির্দিষ্ট গ্রাহকেদের কাছে পৌঁছানো বা বিজ্ঞাপন প্রচারে এই মাধ্যমটি সারা দুনিয়াতেই জনপ্রিয় হয়েছে-হচ্ছে। এটি ডিজিটালাইজেশানের বাই প্রডাক্ট।

বিজ্ঞাপনের এই তত্ত্ব মেনে নিয়েই আলোচনাটা তুলছি গেলো সপ্তাহের একটি সংবাদকে ধরে। গত সপ্তাহে ডিজিটাল সেগমেন্টের যে প্রতিবেদনটিতে চোখ আটকে গেলো সেটি হলো– মাত্র তিনটি বেসরকারি মোবাইল ফোন অপারেটর সাম্প্রতিক বছরগুলোতে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বিজ্ঞাপন বাবদ ১০৪ কোটি ডলার বা ৮ হাজার ৭৪৪ কোটি ২০ লাখ টাকা খরচ করেছে!

প্রতিবেদনে অর্থের অংকটি যে সঠিক নয়, এবং প্রতিবেদন তৈরিতে যে ভুল হয়েছে (টাকা ডলার হয়েছে) ইতিমধ্যে সেই স্বীকারোক্তিও আমরা পেয়েছি। সুতরাং ওই অংক নিয়ে আর কথা বাড়াতে চাই না।

প্রশ্নটা হলো- এই খাতে আসলে কতো খরচ হচ্ছে? আসলেই বছরে কতো টাকা চলে যাচ্ছে ফেসবুক-গুগল-ইউটিউব-ইয়াহু বা অন্যান্য প্ল্যাটফর্মগুলোর অ্যাকাউন্টে? এর কতোটাই বা সঠিক পদ্ধতিতে ব্যাংকিং চ্যানেলে ওই সব প্ল্যাটফর্মের অ্যাকাউন্টে যাচ্ছে?

ফেসবুক-গুগলের বাংলাদেশের বাজার ও আয় নিয়ে গত দুই বছর ধরে আলোচনা চলছে বেশ জোরেসোরে। আদালতের রিট আবেদনের পর গোয়েন্দা সংস্থাও এর খোঁজ-খবরে মাঠে রয়েছে। জাতীয় রাজস্ব বোর্ডও কিছু নির্দেশনা দিয়েছে ব্যাংকগুলোকে। সামাজিক ওইসব মাধ্যমকে বলা হয়েছে ঢাকায় অফিস খুলতে হবে। কিন্তু, প্রশ্ন হলো- এই সব আয়োজনই কি যথেষ্ট? সব টাকাই কি তাতে ব্যাংকের মাধ্যমে লেনদেন করা হবে বা হচ্ছে?

এই প্রশ্নের উত্তর নেওয়ার আগে জেনে নেই কারা-কারা যোগাযোগ বা বিজ্ঞাপন প্রচারের জন্যে ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মের কাছে যাচ্ছেন? শুধু বড় বড় কোম্পানিই ওখানে বিজ্ঞাপন দিচ্ছে, সেটা ভাবলে কিন্তু একেবারেই ভুল হবে। ছোট ছোট কোম্পানির খরচের অংকই এখানে বড়। যেকোনো ডিজিটাল সেবা কোম্পানি তো রয়েছেই; সেই সঙ্গে ছোট-বড় প্রায় সব কোম্পানি; পাড়া-মহল্লার ব্যবসা-সেবা প্রতিষ্ঠানও এখন ডিজিটাল বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে গ্রাহক ধরার চেষ্টা চালাচ্ছে। কারা এখন বিজ্ঞাপন প্রচারের আধুনিক এই প্রক্রিয়ার সঙ্গে যুক্ত নেই?– সেটিই বরং অনুসন্ধানের বিষয় হতে পারে।

বাচ্চাদের জন্যে টিউটর খোঁজা থেকে শুরু করে চুল কাটানো, লন্ড্রি সেবা, বাসার বুয়া বা সিএনজি খোঁজ খবরও আছে ডিজিটাল বিজ্ঞাপনের কাতারে। ই-কমার্স বা ফেসবুকের ওপর নির্ভর করে যারা ব্যবসা করছেন সেই এফ-কমার্সও শতশত ডলার খরচ করছে তাদের পণ্যের খবর বুস্ট করতে।

ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে বিজ্ঞাপন প্রচারের এই বিষয়টিতে সম্ভবত কারো কোনো আপত্তি নেই। আপত্তিটা হলো- ফেসবুক-গুগল কারোই তো বাংলাদেশে কোনো অফিস নেই। ফলে বাংলাদেশ থেকে শতশত কোটি টাকা আয় করলেও এখান থেকে সরকারের আয়ের অংক সামান্যই।

দেশের একটি গণমাধ্যমে বিজ্ঞাপন প্রচার করলে ১৫ শতাংশ ভ্যাট পায় সরকার। সঙ্গে ৪ শতাংশ পায় অগ্রিম আয়কর হিসেবে। কিন্তু, ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে বিজ্ঞাপন প্রচার করলে অনেক ক্ষেত্রেই ট্যাক্সের এই অংককে এড়িয়ে যাওয়া যায়।

ডিজিটাল সেবা বা বিজ্ঞাপনের ওপর ট্যাক্স আরোপের ক্ষেত্রে আমরা কিন্তু খুব একটা পিছিয়ে নেই। ভারত যেমন ২০১৮ সালে তাদের ডিজিটাল সেবার ওপর ১৮ শতাংশ ট্যাক্স আরোপ করেছে। যদিও ২০১৬ সালে তারা ৬ শতাংশ লেভি নিতো। তবে ওদের ক্ষেত্রে বড় শক্তির জায়গা হলো ভারতের বাজারের আকারের কারণে প্রায় সব সামাজিকমাধ্যম বা গেটওয়ের অফিস আছে। বাংলাদেশে কিন্তু তেমনটা নেই।

ইউরোপের অনেক দেশ বা ভারতের মতো বাংলাদেশেও এখন এমন অনেক ডিজিটাল সেবা কোম্পানি রয়েছে যারা বিজ্ঞাপনের পুরো টাকাই খরচ করে ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে। এর মধ্যে আবার এমন কোম্পানিও রয়েছে যাদের এই খাতের সবটাই খরচ হয় বিদেশে বসে। তারা কখনোই তাদের ডিজিটাল প্রচারণার খরচটাকে দেশের মধ্যে আনছেন না। বরং বাইরে থেকে ফেসবুক বা গুগল অথবা অন্য কাউকে পেমেন্টটা দিয়ে দিচ্ছেন কয়েকটি রাইড শেয়ারিং এবং ই-কমার্স কোম্পানি। অথচ ওই প্রচারণার পুরোটাই চলছে বাংলাদেশের মধ্যে, নির্দিষ্ট বয়স বা এলাকার গ্রাহককে টার্গেট করে।

এর মধ্যে দারাজ তো সিআইডিকে বলেই দিয়েছেন যে তারা দেশের বাইরে বসে এই খরচ করে। একই তালিকায় আছে উবারের মতো আরো বিদেশি ডিজিটাল সেবা কোম্পানি। তাছাড়া নামে দেশীয় মনে হলেও সিঙ্গাপুর বা অন্য কোথাও বসে চালাচ্ছেন এমন কোম্পানিও একই সুবিধা নিচ্ছে।

এক্ষেত্রে আমরা মনে হয় একটা কাজ করতে পারি, যা বহু দেশ করেছে। সেটি হলো– তোমার অবস্থান যেখানেই হোক না কেনো, যেহেতু তুমি বাংলাদেশে সেবা বিপণন করছো এবং বাংলাদেশের মানুষের মাঝেই প্রচারণা চালাচ্ছো সেহেতু তোমাকে এখানে অফিস খুলতেই হবে এবং সরকারকে তার প্রাপ্য দিতেই হবে।

এক্ষেত্রে বাংলাদেশের একটি বড় শক্তির জায়গা হলো আমাদের বাজারের আকার। এখন দেশে সাড়ে তিন কোটি ফেসবুক ব্যবহারকারী রয়েছেন। এই অংকও বছরে ৩০ থেকে ৪০ শতাংশ হারে বাড়ছে। গুগলের নানা প্ল্যাটফর্মের সঙ্গে যুক্ত রয়েছেন এর চেয়েও বেশি মানুষ। এতো বড় বাজার ওই সব কোম্পানি খুব কম দেশেই পায়। সুতরাং আমাদের শক্তির জায়গাটি ধরে সমাধানের পথ খোঁজা যেতে পারে।

বিদেশি কোম্পানি বাদ দিয়ে দেশীয় কোম্পানির দিকে মনোযোগ দিলেও দেখা যাবে নানা ধরনের ডিজিটাল সেবা কোম্পানি, ই-কমার্স এবং এফ-কমার্স মিলিয়ে দেশে এখন হাজার পঞ্চাশেক অ্যাকাউন্ট আছে। এরা দিনে পাঁচ ডলার থেকে একশ ডলার পর্যন্ত খরচ করে প্রচারে। তাতে এক দিনেই খরচের অংক কয়েক কোটি টাকায় পৌঁছায়। মাস শেষ না হতেই শত কোটি পেরিয়ে যায়- এমনটা সংশ্লিষ্টদের হিসাব।

অনেকদিন থেকে এই খাতের সঙ্গে যুক্ত আছেন, গবেষণা করছেন এমন অনেকের সঙ্গে কথা বলে যেটা বুঝেছি, বাংলাদেশ এখন বছরে অন্তত দুই হাজার কোটি টাকার ডিজিটাল প্রচারণার বাজার। একই সঙ্গে বাজারটি প্রতি বছরই ফেসবুকের প্রবৃদ্ধির মতো করেই বড় হচ্ছে। কিন্তু, খটকা লাগে যখন দেখি গত পাঁচ বছরে ব্যাংকিং চ্যানেলে ফেসবুক আর গুগলের অ্যাকাউন্টে মাত্র ১৩৫ কোটি টাকা গেছে। অথচ ২০১৪ সাল থেকে ব্যাংকের মাধ্যমে টাকা পাঠানোর প্রক্রিয়া শুরু হয়।

ব্যাংকের দিক থেকে পাওয়া হিসাবে বলছে, ফেসবুক-গুগলের বাইরে আর একটি মাত্র অ্যাকাউন্টে দেশে থেকে টাকা গেছে। ব্যাংকের হিসাবে নেই ইয়াহু বা ইমোর নাম। অথচ মোবাইল ফোন অপারেটররা তাদের ডিজিটাল বিজ্ঞাপনের প্রচার খরচের যে হিসাবটা দিয়েছে সেখানে অন্তত এই দুটি প্ল্যাটফর্মের নাম উল্লেখ করেছে রবি এবং বাংলালিংক। তাহলে কী দাঁড়ালো? বুঝতে আর বাকি থাকে না যে এই দুটি প্ল্যাটফর্মে যাওয়া টাকা অন্তত সঠিক ব্যাংকিং চ্যানেলে যায়নি।

আরেকটি প্রশ্নও আসছে এখানে। ব্যাংক বলছে, তাদের মাধ্যমে গেছে ১৩৫ কোটি টাকা। অথচ গ্রামীণফোন-রবি-বাংলালিংক যে হিসাব দিয়েছে তাতে এই খাতে তাদের সম্মিলিতভাবে ব্যয় ৪৩৫ কোটি টাকা। তাহলে বাকি তিনশ কোটি টাকা কি অন্য কোনো উপায়ে গেছে? অন্যান্য কোম্পানির হিসাবে তো বাইরেই থাকলো।

কিছু দেশীয় সফটওয়ার কোম্পানি এখন সরকারের কাছ থেকে বিদেশে তাদের পণ্যের প্রসারে কার্ডের মাধ্যমে ১২ হাজার ডলার পর্যন্ত খরচের সুযোগ পান। এই কার্ড দিয়ে অনেকে পেমেন্ট করছেন। তাছাড়া দেশের বাইরে থেকে অনেকে যেমন পেমেন্ট করিয়ে নিচ্ছেন। আবার বিদেশি কার্ড দিয়েও দেশের ভেতরে বসে পেমেন্ট করানো হচ্ছে। ফলে যা হবার তাই-ই হচ্ছে। সরকার বঞ্চিত হচ্ছে। তাহলে এই পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের উপায়?

উপায় তো নিশ্চয় একটা করতেই হবে। এক্ষেত্রে ধরেই নিতে হবে, ১০ বা ২০ শতাংশকে সঠিক চ্যানেলে আনা যাবেই না। কিন্তু বাকি ৮০ বা ৯০ শতাংশের খরচটা অন্তত যেনো সঠিক চ্যানেলে আনা যায় সেটি নিশ্চিত করতে হবে। সেটি নিশ্চিত করতে ডিজিটাল স্পেসে থাকা আমাদের সাড়ে তিন কোটি গ্রাহকই বড় শক্তি। ব্যববহারকারীর এই সংখ্যার ওপর জোর দিয়ে হলেও বাংলাদেশে ফেসবুক-গুগলের উপস্থিতি নিশ্চিত করতে হবে।

 

মুহাম্মদ জাহিদুল ইসলাম: সিনিয়র রিপোর্টার, দ্য ডেইলি স্টার

[email protected]

Comments

The Daily Star  | English

JP central office vandalised, set ablaze

A group of unidentified people set fire to the central office of Jatiyo Party in Dhaka's Kakrail area this evening

1h ago