কোটি টাকা ‘ঈদ সালামি’ আলোচনায় জাবি উপাচার্য ও তার পরিবার

গত ৯ আগস্ট জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের (জাবি) উপাচার্যের বাসায় বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের একটি অংশের সঙ্গে বৈঠক করেছিলেন উপাচার্য ও তার পরিবারের দুই সদস্য। সংগঠনটির দাবি অনুযায়ী তারা ২৫ লাখ টাকা গ্রহণ করে কর্তৃপক্ষের সঙ্গে একটি সমঝোতায় পৌঁছেছিলেন।
১৪ সেপ্টেম্বর ২০১৯, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সংবাদ সম্মেলনে (মাঝে) উপাচার্য অধ্যাপক ফারজানা ইসলাম। তার বামে ভারপ্রাপ্ত রেজিস্ট্রার রহিমা কানিজ এবং ডানে সহকারী প্রক্টর মহিবুর রৌফ শৈবাল। স্টার ফাইল ছবি

গত ৯ আগস্ট জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের (জাবি) উপাচার্যের বাসায় বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের একটি অংশের সঙ্গে বৈঠক করেছিলেন উপাচার্য ও তার পরিবারের দুই সদস্য। সংগঠনটির দাবি অনুযায়ী তারা ২৫ লাখ টাকা গ্রহণ করে কর্তৃপক্ষের সঙ্গে একটি সমঝোতায় পৌঁছেছিলেন।

গত ১৪ সেপ্টেম্বর ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদককে অপসারণ করার পরপরই একটি অডিও ফাঁস হয়। তাতে জানা যায়, উপাচার্যের পরিবার এবং বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের প্রথম সারির নেতারা অর্থ লেনদেনের সঙ্গে জড়িত ছিলেন।

গতকাল (১৬ সেপ্টেম্বর) দ্য ডেইলি স্টারকে ছাত্রলীগের সেই অংশের নেতারা বলেন, সেই বৈঠকের পর জাবি ছাত্রলীগকে ‘ঈদ সালামি’ হিসেবে  টাকা দেওয়া হয়েছিলো। সেই অংশের নেতা জাবি ছাত্রলীগের সহ-সভাপতি নিয়ামুল হাসান তাজ এবং যুগ্মসম্পাদক সাদ্দাম হোসেন  গণমাধ্যমের সঙ্গেও একই কথা বলেছেন।

তারা জানান, সেই বৈঠকে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় যে তারা ২৫ লাখ টাকা করে পাবেন। বৈঠকে আরো সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়- জাবি ছাত্রলীগের সভাপতি জুয়েল রানাকে ৫০ লাখ টাকা এবং সাধারণ সম্পাদক এসএম আবু সুফিয়ান চঞ্চলকে ২৫ লাখ টাকা দেওয়া হবে।

উপাচার্য ফারজানা ইসলাম এসব অভিযোগ শুরু থেকেই অস্বীকার করে আসছেন। এমনকী, তার পরিবারের কোনো সদস্য এমন বোঝাপড়ার সঙ্গে জড়িত নন বলেও দাবি করেন।

ডেইলি স্টারের জাবি সংবাদদাতাকে সাদ্দাম বলেন, তারা ৯ আগস্ট বিকাল সাড়ে ৪টার দিকে উপাচার্যকে ফোন দিয়েছিলেন তার সঙ্গে কথা বলার জন্যে।

সন্ধ্যা ৬টার দিকে সাদ্দাম ও তাজ উপাচার্যের বাসায় গিয়েছিলেন উল্লেখ করে সাদ্দাম বলেন, “ফোন দেওয়ার পর ভিসি ম্যাম বললেন, ঠিক আছে, তোমরা আসতে পারো। আমি জুয়েল ও চঞ্চলকেও ডাকছি। আমি বললাম, ওকে ম্যাম, কোনো সমস্যা নেই।”

উপাচার্যের স্বামী আখতার হোসেন এবং ছেলে প্রতীক তাজদিক হোসেনও সেখানে উপস্থিত ছিলেন। সাদ্দাম জানান, “জুয়েল এবং চঞ্চল প্রায় ঘণ্টাখানেক পর এসেছিলেন।”

“সেই সময়ের মধ্যে উপাচার্যের স্বামী ও ছেলে বলছিলেন, “তোমরা কেনো কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের সঙ্গে যোগাযোগ করলে? (জাবি) ক্যাম্পাসে কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের কী করার আছে?’ তারা বলতে চাচ্ছিলেন যে জাবির বিষয়ে কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের হস্তক্ষেপ করাটা ভালো হয়নি।”

সাদ্দাম আরো জানান, বিশ্ববিদ্যালয়ের মেগা প্রজেক্ট নিয়ে কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের সঙ্গে কোনো সমঝোতার বিরোধিতা করেছেন উপাচার্য ও তার পরিবার। “জুয়েল ও চঞ্চলের সঙ্গে কথা বলেই তারা কাজ সারতে চেয়েছিলেন,” বলে মন্তব্য করেন সাদ্দাম।

সাদ্দাম ও তাজের নেতৃত্বাধীন ছাত্রলীগের অংশটিকে কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের সদ্য সাবেক সাধারণ সম্পাদক গোলাম রাব্বানীর ঘনিষ্ঠ বলে ধারণা করা হয়।

নানা অভিযোগের মুখে গত ১৪ সেপ্টেম্বর ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সভাপতির পদ থেকে রেজওয়ানুল হক চৌধুরী শোভনকে এবং সাধারণ সম্পাদকের পদ থেকে গোলাম রাব্বানীকে অপসারণ করা হয়। সম্প্রতি জাবির ভিসি অভিযোগ করেন যে শোভন ও রাব্বানী বিশ্ববিদ্যালয়ের ১ হাজার ৪৪৫ কোটি টাকার প্রকল্প থেকে ৪ থেকে ৬ শতাংশ চাঁদা  দাবি করেছিলেন। তারা ভিসির বাসায় গিয়েছিলেন গত ৮ আগস্ট।

প্রথমে বেশ কয়েকটি গণমাধ্যমের কাছে অস্বীকার করার পর অবশেষে রাব্বানী দ্য ডেইলি স্টারের কাছে স্বীকার করেন যে, তারা উপাচার্যের কাছে তাদের ‘ন্যায্য পাওনা’ দাবি করেছিলেন। তবে এর পরিমাণ কতো তিনি তা বলেননি। তিনি বলেছিলেন সেই টাকা চাওয়া হয়েছিলো ‘ঈদের খরচ’ হিসেবে।

‘ঈদ সালামি’

সাদ্দাম বলেন, “গত ৯ আগস্টের বৈঠকে তাজ ও আমি প্রস্তাব দিয়েছিলাম কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের অনুসারীদের ফিফটি-ফিফটি অংশ ভাগ করে দেওয়ার জন্যে। কিন্তু, উপাচার্য ও জুয়েল তা মানতে রাজি হননি। তারা বলেছেন, চঞ্চল (জাবির) সাধারণ সম্পাদক এবং আমরা তাকে কীভাবে বঞ্চিত করি?”

পরে, উপাচার্য ও তার পরিবারের দুই সদস্য টেন্ডার প্রক্রিয়া ও কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের বিষয় বাদ দিয়ে আলোচনা করতে বলেন। তারা ‘ঈদ সালামি’ হিসেবে টাকা নিতে বলেন এবং জানান, ঈদের বন্ধের পর আবার এসব বিষয় নিয়ে কথা হবে।

সাদ্দাম আরো বলেন, “সিদ্ধান্ত হয় যে জাবি ছাত্রলীগের সভাপতি পাবেন ৫০ লাখ টাকা সাধারণ সম্পাদক পাবেন ২৫ লাখ টাকা এবং আমরা ২৫ লাখ টাকা করে পাবো।”

সাদ্দাম ও তাজের বক্তব্য- পরদিন সকালে জুয়েল এবং চঞ্চল “টাকা পেয়েছিলেন”। তারা তাদের সঙ্গে ফোনে যোগাযোগ করার চেষ্টা করেন। কিন্তু, চঞ্চল তাদের “কোনো ভাগ দিতে অস্বীকার করেন।” সেদিন সন্ধ্যায় তাজ এবং সাদ্দাম দুজনে “শহীদ সালাম বরকত হলের গেস্টরুমে চঞ্চলের কাছ থেকে ২৫ লাখ টাকা করে গ্রহণ করেছিলেন” বলেও জানান।

গতকাল তাজ সাংবাদিকদের বলেন, “বৈঠকের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী আমরা ২৫ লাখ টাকা করে পেয়েছি।”

জাবি উপাচার্য, তার স্বামী ও ছেলের সঙ্গে চেষ্টা করেও কথা বলা সম্ভব হয়নি। জানা গেছে উপাচার্যের পরিবারের সদস্যরা সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, তারা গণমাধ্যমের সঙ্গে কথা বলবেন না।

অডিও ফাঁস

গত ১৫ সেপ্টেম্বর থেকে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে একটি মোবাইল ফোন কথোপকথনের অডিও ফাঁস হওয়ার পর তা নিয়ে বেশ আলোচনা হচ্ছে। এ নিয়ে গণমাধ্যমে খবর প্রকাশিতও হয়েছে।

সেই ছয় মিনিটের অডিও ক্লিপে জানা যায়, সাদ্দাম কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের সদ্য অপসারিত সাধারণ সম্পাদক গোলাম রাব্বানীকে বলছেন যে অধ্যাপক ফারজানা ইসলাম এবং তার পরিবারের সদস্যরা জাবি ছাত্রলীগের নেতাদের মধ্যে ১ কোটি টাকা বিতরণ করেছেন।

আরো পড়ুন:

অডিও ফাঁস: উপাচার্য নিজেই টাকা ভাগ করে দিয়েছেন

জাবি উপাচার্যের অপসারণ দাবি ফখরুলের

ঢাবি সিনেট থেকে অব্যাহতি চেয়ে শোভনের চিঠি

উপাচার্য-ছাত্রলীগ পাল্টাপাল্টি অভিযোগ ও পক্ষ-বিপক্ষের শিক্ষক ভাবনা

আমরা ‘ন্যায্য পাওনা’ দাবি করেছিলাম: রাব্বানী

মিথ্যা বলেছে ছাত্রলীগ, ‘চ্যালেঞ্জ’ ছুড়লেন জাবি উপাচার্য

আন্দোলনকারীদের ২ শর্ত মেনে নিলো জাবি প্রশাসন

শিক্ষা নয়, জাবির আলোচনার বিষয় ‘২ কোটি টাকা’র ভাগ-বাটোয়ারা

‘২ কোটি টাকা ভাগের সংবাদে শিক্ষক হিসেবে খুব বিব্রত বোধ করি’

জাবি উপাচার্যের সঙ্গে ছাত্রলীগের ‘প্রশ্নবিদ্ধ বৈঠক’, টিআইবির উদ্বেগ

দুর্নীতির বিরুদ্ধে জাহাঙ্গীরনগর

জাবি ছাত্রলীগের দলীয় কোন্দল ও সংঘর্ষের নেপথ্যে ৪৫০ কোটি টাকার নির্মাণ কাজ

জাবিতে চলমান উন্নয়ন পরিকল্পনার ‘মাস্টারপ্ল্যানে’ গোড়ায় গলদ!

Comments

The Daily Star  | English

Houses for homeless: A project destined to fall into ruin

At least a dozen homes built for the homeless and landless on a river island in Bogura’s Sariakandi upazila have been devoured by the Jamuna while dozens of others are under threat of being lost.

2h ago