আমিনুলকে নিয়ে আলোর রেখা, আছে শঙ্কাও
ঘরোয়া ক্রিকেটে তেমন কোনো নামডাক নেই, কিন্তু নেটের বোলিংয়েই নির্বাচকদের তুষ্ট করে জাতীয় দলের ডেরায় চলে এসেছিলেন জুবায়ের হোসেন লিখন। শুরুটাও করেছিলেন ভালো। প্রায় একইভাবে আমিনুল ইসলাম বিপ্লবের আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে পথচলা শুরু হয়েছে। এখনও ঘরোয়া ক্রিকেটে নিজেকে পুরোপুরি প্রমাণ করেতে পারেননি। টুকটাক যা করেছেন তা ব্যাট হাতে। তবে টি-টোয়েন্টি অভিষেকে ২ উইকেট নিয়ে ঝলক দেখিয়েছেন আমিনুল। লেগ স্পিনারের ঘাটতি এবার বুঝি পূরণ হতে চলল বাংলাদেশের। তবে আশার সূর্যের কোণে মেঘের শঙ্কাও উড়িয়ে দেওয়া যাচ্ছে না। লিখনের মতো আমিনুলও না আবার ধুমকেতুর মতো দেখা দিয়ে হারিয়ে যান! বাংলাদেশের নির্বাচকরা যে পরিমাণ অস্থিরতায় ভোগেন, তাতে সে ভয়ও উড়িয়ে দেওয়া যায় না।
চলমান ত্রিদেশীয় টুর্নামেন্টেই এমন উদাহরণ রেখেছেন নির্বাচকরা। শুরুতে আনকোরা পেসার ইয়াসিন আরাফাত মিশুকে দলে নিলেন তারা। স্কোয়াডে ফেরালেন এক টি-টোয়েন্টি খেলা শেখ মেহেদী হাসানকে। কিন্তু কাউকেই খেলানো হলো না। এক ম্যাচ না যেতেই আবার নির্বাচকরা ফেরালেন আবু হায়দার রনিকে। কিন্তু তিনিও বাদ পড়লেন কোনো ম্যাচ না খেলেই। সে দিক থেকে নিজেকে ভাগ্যবান ভাবতেই পারেন লেগি আমিনুল। আর প্রথম সুযোগের পুরোটাই তিনি কাজে লাগিয়েছেন দারুণভাবে, নজর কেড়েছেন আলাদাভাবে।
আমিনুলের মতো লিখনও জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে খেলেই আন্তর্জাতিক ক্রিকেট শুরু করেছিলেন। তিন সংস্করণেই তার প্রথম প্রতিপক্ষ ছিল জিম্বাবুয়ে। সেগুলো তার অভিষেক লিস্ট এ ও ঘরোয়া প্রথম শ্রেণির ম্যাচও ছিল। আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের সব সংস্করণেই ২টি করে উইকেট দিয়ে শুরু করেছিলেন লিখন। হয়তো কিছুটা খরুচে ছিলেন, কিন্তু লেগ স্পিনারদের ঢঙটাই তো এমন। রান আটকানো নয়, উইকেট নেওয়াই তাদের মূল কাজ। ঠিক লিখনের মতোই ২টি উইকেট নিয়ে শুরু আমিনুলের। তবে একটা জায়গায় নিজেকে ভিন্ন ভাবতে পারেন ১৯ বছর বয়সী এ তরুণ। রান দেওয়ায় ছিলেন কৃপণ। ৪ ওভারে খরচ করেন মাত্র ১৮ রান, ডট বল ছিল নয়টি।
তরুণ আমিনুলের বোলিংয়ে লিগ স্পিনের জাদুকরী শিল্পের পুরো ছাপটা দেখা যায়নি। খুব বেশি টার্ন আদায়ও করে নিতে পারেননি। তবে বয়সের সঙ্গে সঙ্গে এসব শেখার ব্যাপক সুযোগ থাকছে তার। মাত্রই তো শুরু। তাছাড়া এই কদিন আগেও তার পরিচয় ছিল টপ-অর্ডার ব্যাটসম্যান, লেগ স্পিনটা টুকটাক পারেন। সেই আমিনুলকে যখন জাতীয় দলে পাক্কা লেগি হিসেবে ডাকা হলো, তখন বুঝে নিতে হয়, প্রতিভার কমতি নেই তার। জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে তার আভাসও মিলেছে। বোলিংয়ে তাকে নড়বড়ে মনে হয়নি। বল ফেলেছেন জায়গামতো। বোঝা গেছে, ডেলিভারির ওপর তার নিয়ন্ত্রণ বেশ, বাংলাদেশের জার্সিতে আগে যারা লেগ স্পিনার হিসেবে খেলেছেন, তাদের মতো ওভারে দুই-তিনটি ফুলটস কিংবা অনেক বাইরে বল ফেলেননি। প্রতিপক্ষ ব্যাটসম্যানদের পরীক্ষায় ফেলতে পেরেছেন।
তবে শঙ্কা ওই একটিই। এক-দুই ম্যাচ দেখে খেলোয়াড়দের বাতিলের খাতায় ফেলে দেওয়ার তালিকা তো ছোট নয় বাংলাদেশের। তবে প্রথম দেখাতেই দলের সিনিয়রদের ভোট পেতে সমর্থ হয়েছেন আমিনুল। তাকে লম্বা রেসের ঘোড়াই মনে করছেন চট্টগ্রামে আগের দিন জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে ম্যাচ জয়ের নায়ক মাহমুদউল্লাহ, ‘লিখন যখন শুরু করেছিল, আমার কাছে দুর্দান্ত মনে হচ্ছিল। ওর গুগলি বলগুলো পড়া খুব কঠিন ছিল। হয়তো ওর ফর্মে কিছু ওলট-পালট হয়েছিল। এই ছেলেকে (আমিনুল) আমার কাছে মনে হয়, অনেক সম্ভাবনাময়। সবাই তাকে উৎসাহ দিচ্ছে। আমার মনে হয়, তার ভবিষ্যৎ উজ্জ্বল।’
নির্বাচকদের পরীক্ষা-নিরীক্ষামূলক আচরণ অজানা মাহমুদউল্লাহরও। তাই আমিনুল শুরুতেই ভালো করুক, খুব করেই চেয়েছিলেন তিনি, ‘মনে মনে চাইছিলাম, বিপ্লব (আমিনুল) যেন খুব ভালো করে। আমি ওর খেলা আগে দেখিনি, চিনতামও না। যখন আমি ওকে নেটে দেখলাম, আমি অনুভব করলাম, ওর ভেতরে কিছু একটা আছে। ব্যক্তিগতভাবে চেয়েছিলাম ও যেন ভালো করে, তাহলে দলের জন্যও ভালো হবে। আমি ওর জন্য আসলে অনেক বেশি খুশি। আমি সাকিবের সঙ্গে কথা বলছিলাম, যে সাহস নিয়ে ও বল করেছে, এক কথায় দুর্দান্ত। আমার মনে হয় ওর ব্যাটিং সামর্থও ভালো। ইনশাআল্লাহ যেভাবে শুরু করেছে, এভাবে চলতে থাকলে, বাংলাদেশর জন্য আরও সাফল্য এনে দিতে পারবে।’
আমিনুলের সামনের পথচলা নিখুঁত করতে আর অভিষেকটা স্মরণীয় করে রাখতে যথাসম্ভব সাহায্যও করেছেন মাহমুদউল্লাহ। মাঠে দিয়েছেন প্রয়োজনীয় পরামর্শ, ‘ওকে মাঠে গিয়েই বলেছিলাম, আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে প্রথম ম্যাচ, সবারই কম-বেশি স্নায়ুচাপ থাকে, যাই কিছু করো, বুকে সাহস নিয়ে করবে। ভয় নিয়ে কিছু করে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে টিকে থাকা যায় না। যাই কিছু করবে, মন খুলে...। আমার মনে হয়, ও এটা অনুভব করেছিল। ওভাবেই সে বোলিং করছিল। বোলিং দেখে মনে হচ্ছিল, সে আক্রমণাত্মক। ফিল্ডিংও আক্রমণাত্মক। যেটা টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটে বেশি প্রয়োজন। কিছু সময় হয়তো সফল হওয়া যাবে না, কিন্তু বেশিরভাগ সময়েই সফল হওয়ার সুযোগ থাকবে থাকবে।’
অভিষেকে আলোর রেখা দেখানোর পরও কিছুটা শঙ্কা থেকেই যায়। একজন লেগ স্পিনারের আশায় তো আর কম জল ঘোলা করেনি বাংলাদেশ। পার্টটাইম স্পিনার তানবির হায়দারকে দিয়েও চেষ্টা করা হয়েছে। কিন্তু ওই এক-দুই ম্যাচ পরই আবার ছুঁড়েও ফেলা হয়েছে। আর লিখন তো এখন ঘরোয়া ক্রিকেটেও জায়গা পান না। তবে জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে বল হাতে আমিনুল যেভাবে পারফর্ম করেছেন, সেই ধারাবাহিকতা ধরে রাখতে পারলে শুধু দলে টিকেই যাবেন না এ নবীন, বাংলাদেশকে উপহার দেবেন সাফল্যে মোড়ানো অনেক মুহূর্ত, এমন ভবিষ্যদ্বাণী করাই যায়।
Comments