অতিথি পাখির অভয়াশ্রমে যন্ত্রের ঝনঝনানি

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে (জাবি) কিছুদূর পর পরই পুরনো মরিচা ধরা সাইনবোর্ড চোখে পড়ে। যেখানে লেখা থাকে- পরিযায়ী পাখির আবাসস্থলে হর্ন বাজাবেন না; জলাশয়ের পাশে গাড়ি পার্ক করবেন না; আতশবাজি নিষিদ্ধ- এরকম সতর্কবার্তা। কারণ একটাই, শীতের মাসগুলোতে মহাদেশ পাড়ি দিয়ে পাখিরা এখানে আসে। কিছু পাখি সাইবেরিয়া থেকেও আসে।
jahangirnagar_university_campus_11.jpg
নতুন নির্মাণকাজের জন্য গাছ কেটে সাফ করা হয়েছে। ছবি: সানি মাহফুজ/স্টার

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে (জাবি) কিছুদূর পর পরই পুরনো মরিচা ধরা সাইনবোর্ড চোখে পড়ে। যেখানে লেখা থাকে- পরিযায়ী পাখির আবাসস্থলে হর্ন বাজাবেন না; জলাশয়ের পাশে গাড়ি পার্ক করবেন না; আতশবাজি নিষিদ্ধ- এরকম সতর্কবার্তা। কারণ একটাই, শীতের মাসগুলোতে মহাদেশ পাড়ি দিয়ে পাখিরা এখানে আসে। কিছু পাখি সাইবেরিয়া থেকেও আসে।

বিশ্ববিদ্যালয়টিতে বর্তমানে ১৪৪৫.৩৬ কোটি টাকার উন্নয়ন প্রকল্পের কাজ চলছে। গত অক্টোবরে জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটি (একনেক) থেকে অর্থ বরাদ্দের প্রস্তাব পাস করা হয়েছে। এর জন্য একটি মহাপরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। স্বল্পমেয়াদে ২৩টি নতুন ভবন তৈরি হচ্ছে। প্রত্যেক শিক্ষার্থীর আবাসন ব্যবস্থার জন্য হল, প্রশাসনিক ভবন, একাডেমিক ভবন নির্মাণ করা হচ্ছে। ভবিষ্যতেও ভবন নির্মাণের ব্যাপারে প্রস্তাব রাখা হয়েছে।

মহাপরিকল্পনা অনুযায়ী বিশ্ববিদ্যালয়ের জলাশয়গুলোর পাশে বেশ কিছু ভবন নির্মাণের কথা বলা হয়েছে যেখানে প্রতি বছর শীতকালে হাজার হাজার পরিযায়ী পাখি এসে আশ্রয় নেয়। তাই স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন উঠছে বিশাল এই নির্মাণযজ্ঞে পরিবেশের দিকে কতটুকু খেয়াল রাখা হবে?

উদাহরণ হিসেবে ‘আব্দুল কাদের মোল্লা কনজারভেশন সেন্টার’ স্থাপনের জন্য প্রস্তাবিত জায়গার কথা ধরা যাক। এই ভবনটি নির্মাণ করা হবে জলাশয়ের ধার ঘেঁষে। গুগল ম্যাপে যে জলাশয়টিকে ‘মাইগ্রেটরি বার্ড লেক-৩’ নামে চিহ্নিত করা হয়েছে।

উদাহরণ আরও রয়েছে। ‘মাইগ্রেটরি বার্ড লেক-১’ এর যে পাশে আল-বিরুনী হল, দীর্ঘমেয়াদে একাডেমিক ভবন তৈরির জন্য সে স্থানটি বাছাই করা হয়েছে। বড় একটি লেকের ধারে—শিক্ষার্থীদের কাছে যা ‘সুইজারল্যান্ড’ নামে পরিচিত—সেখানে ভবিষ্যতে নির্মাণ করা হবে আবাসিক হল। প্রস্তাবিত ম্যাপে ‘মাইগ্রেটরি বার্ড লেক-২’ এর আশপাশেও এমন প্রচুর ভাঙা-গড়ার কথা বলা হয়েছে।

jahangirnagar_university_campus_22.jpg
অতিথি পাখির জলাশয়ের ধারে নির্মাণকাজের স্থান নির্ধারণ করা হয়েছে। ছবি: সানি মাহফুজ/স্টার

৬৯৭ একরের এই বিশাল ক্যাম্পাসে আছে বড় বড় লেক, পদ্মপুকুর আর গাছ-গাছালির বিশাল সম্ভার। পরিকল্পনা ও উন্নয়ন কার্যালয়ের পরিচালক মোহাম্মদ নাসির উদ্দিন জানান, “ক্যাম্পাসের মোট জায়গার মধ্যে এক তৃতীয়াংশ এলাকা জলাভূমি, এক তৃতীয়াংশে গাছপালা, বাকি জায়গা ব্যবহারযোগ্য। ব্যবহারযোগ্য সামান্য এই জায়গার মধ্যে এখন মাত্র ২১ শতাংশ জায়গা খালি রয়েছে।”

এখন যেকোনো সম্প্রসারণমূলক কাজ চালাতে কোনো না কোনো লেকের ধারে চলে যেতে হচ্ছে জানিয়ে তিনি বলেন, “বিশ্ববিদ্যালয়কে তার কাজ করতে হবে। এটা পাখির অভয়ারণ্য হতে পারে না।”

তবে উন্নয়ন ও পরিবেশের সুরক্ষা- দুটোই সম্ভব বলে মনে করছেন পরিবেশবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. মো. খবির উদ্দিন। তার মতে, “এর জন্য পরিবেশগত প্রভাব সমীক্ষা (ইআইএ) চালানো জরুরি। সম্প্রসারণ ঘটানো যেতে পারে কিন্তু তার জন্য দেখতে হবে পরিবেশের ওপর এর কী প্রভাব পড়ে।”

তবে এই মহাপরিকল্পনায় ‘ইআইএ’ করা হয়নি যেখানে কী না পরিযায়ী পাখির আবাসস্থল ঘিরে উন্নয়ন কর্মকাণ্ড চালানোর উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এ ব্যাপারে জানতে চাইলে নাসির উদ্দিন বলেন, “আমরা পরিবেশগত প্রভাব সমীক্ষা করিনি। কিন্তু এর দরকারটাই বা কোথায়? আমরা তো কোনো নতুন বিশ্ববিদ্যালয় গড়ছি না। বিশ্ববিদ্যালয় নির্মাণের সময় ১৯৬৭ সালে ইআইএ করা হয়ে গেছে।”

“তবে আমরা সম্ভাব্যতা যাচাই করে দেখেছি, বাংলাদেশ প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ নিয়েই এটা করা হয়েছে,” যোগ করেন তিনি।

কিন্তু এই সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের সঙ্গে যুক্ত বুয়েটের আর্কিটেকচার বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ড. মো. আশিকুর রহমান জোয়ার্দার নিজেই বলছেন, “সম্ভাব্যতা যাচাই আর ইআইএ এক কথা নয়।”

তার ভাষায়, “ইআইএ-তে একটি এলাকার ওপর কী কী প্রভাব পড়তে পারে তার সবকিছু বিবেচনায় নেওয়া হয়। এই প্রভাব ইতিবাচক বা নেতিবাচক দুটোই হতে পারে। কিন্তু সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের ক্ষেত্রে শুধু দেখা হয়- পরিকল্পনা নিয়ে অগ্রসর হওয়া সম্ভব কি সম্ভব নয়। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ আমাদের শুধু সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের জন্য বলেছিলো।”

জাবির পরিবেশবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. একেএম রাশিদুল আলম জানান, পানিতে উপস্থিত ক্ষুদ্র অণুজীবের হেরফেরেও পরিযায়ী পাখির আবাসের ওপর বড় প্রভাব ফেলতে পারে। প্রতি বছরই দেখা যায় যে কিছু জলাশয়ে পরিযায়ী পাখি আসে আবার পাশের জলাশয়ে দেখা যায় পাখি একেবারেই নেই। এর কারণ অনুসন্ধান করতে গিয়ে ২০১০ সালের এক গবেষণায় তিনি দেখেছেন, যেসব জলাশয়ে পরিযায়ী পাখি বেশি আসে সেখানে নির্দিষ্ট একটি ফাইটোপ্ল্যাঙ্কটন বেশি মাত্রায় উপস্থিত।

jahangirnagar_university_campus_33.jpg
একটি ভবন নির্মাণের জন্য গাছ কেটে সাফ করছিলো কর্তৃপক্ষ। কিন্তু সে পরিকল্পনাটি বাতিল হওয়ায় পুনরায় সেখানে গাছ রোপণ করেছে তারা। এটি অপরিকল্পিত উন্নয়নের একটি উদাহরণ। ছবি: সানি মাহফুজ/স্টার

গবেষণাপত্রটিতে বলা হয়, যেই জলাশয়ে কম পাখি যায় সেখানে বেশি মাত্রায় ক্লোরোফিসি থাকে এবং যেখানে ব্যাসিলারিওফিসি বেশি থাকে সেখানে পাখিও বেশি আসে। বাংলাদেশ জার্নাল অব এনভায়রনমেন্টাল রিসার্চে প্রকাশিত ওই গবেষণাপত্রে আরও বলা হয়, পরিযায়ী পাখি যায় এমন জলাশয়ের তুলনায় যেখানে পাখি যায় না সেখানকার পানিতে বেশি মাত্রায় নাইট্রোজেন, সালফার ও পটাশিয়াম পাওয়া গেছে। পানিতে ফাইটোপ্ল্যাঙ্কটনের উপস্থিতির সঙ্গে দ্রবীভূত এসব রাসায়নিক উপাদানের সরাসরি সংযোগ রয়েছে।

ড. আলম বলেন, “পানির মান পরিবর্তিত হলে ফাইটোপ্ল্যাঙ্কটনের ভারসাম্যেও বদল আসবে।”

নির্মাণকাজের দূষিত পানি পরিযায়ী পাখির জলাশয়ে গিয়ে পড়লে কী হবে জানতে চাইলে তিনি বলেন, “সিমেন্ট মিশ্রিত পানি গিয়ে মিশলে সামগ্রিকভাবে পানির পিএইচ বেড়ে যাবে, ফলে পানি খারীয় হবে।”

যেসব জলাশয়ে পরিযায়ী পাখি যায় সেখানকার পানি পরীক্ষা করে তিনি পিএইচ ৬.২৬ পেয়েছেন, যার অর্থ হলো এই পানি ঈষৎ অম্লীয়।

jahangirnagar_university_campus_44.jpg
এই ভবনের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করা হয়েছিলো, তবে পরিবেশগত উদ্বেগের কারণে পরিকল্পনাটি বাতিল হয়ে গেছে। এটিও অপরিকল্পিত উন্নয়নের উদাহরণ। ছবি: সানি মাহফুজ/স্টার

সম্প্রতি জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে পরিচালিত এক গবেষণাতেও এর স্বপক্ষে প্রমাণ মিলেছে। গত ডিসেম্বরের ওই গবেষণায় দেখা যায়, যে জলাশয়ে শামুক বেশি থাকে সেখানেই পরিযায়ী পাখি যায়। আর এসিডের প্রতি শামুক খুবই সংবেদনশীল।

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে নির্মাণকাজ পেয়েছে এমন ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের কর্তাব্যক্তিদের সঙ্গে যোগাযোগ করে জানা গেছে পরিবেশের ওপর তাদের কর্মকাণ্ডের প্রভাবের ব্যাপারে এরকম কোনো নির্দেশনাই দেওয়া হয়নি। তাদের বলা হয়েছে তারা যেনো যানবাহন ধোয়ার কাজ না করে ও সিমেন্ট মেশানো পানি জলাশয়ে না যেতে দেয়। কিন্তু সময়ে সময়ে আশপাশের জলাশয়ের পানি ও মাটির মান পরীক্ষা করার ব্যাপারে কোনো নির্দেশনা দেওয়া হয়নি তাদের।

jahangirnagar_university_campus_55.jpg

সংক্ষেপিত, পুরো প্রতিবেদনটি পড়তে ক্লিক করুন Machines whirring at migratory bird sanctuary এই লিংকে

Comments

The Daily Star  | English

One month of interim govt: Yunus navigating thru high hopes

A month ago, as Bangladesh teetered on the brink of chaos after the downfall of Sheikh Hasina, Nobel Laureate Muhammad Yunus returned home to steer the nation through political turbulences.

7h ago