এক ‘মশা মানবের’ গল্প

mosquito_handler.jpg
শেখ চুন্নু মিয়া। ছবি: পলাশ খান/স্টার

ঢাকা সিটি করপোরেশন মশার প্রকোপ নিয়ে সমালোচনামুখর সময় কাটিয়েছে। তাদের ওষুধ কার্যকর কী না তা নিয়ে পত্রপত্রিকায় নানান কথাবার্তা হয়েছে। ওষুধের কার্যকারিতা পরীক্ষা করার জন্য প্রয়োগ করা হয়েছে মশার ওপর।

কিন্তু, সিটি করপোরেশন মশাগুলো কোথা থেকে এনেছে? কীভাবে মশাগুলো নিয়ে আসা হলো?

শত শত জীবন্ত মশা ধরে সেটি খাঁচার মধ্যে পরীক্ষার জন্য রাখা খুব একটা সহজ কাজ নয় এবং এ কাজটি সবাই করতে চানও না। কিন্তু, অনেক বছর ধরে এক ব্যক্তি ঢাকা উত্তর এবং দক্ষিণ সিটি করপোরেশনে মশা এনে দিচ্ছেন।

সম্প্রতি, ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের অফিস প্রাঙ্গণে তার সঙ্গে দেখা হয়েছিলো। তিনি সিটি করপোরেশনের জন্য মশারির খাঁচায় (লোহার ফ্রেম দিয়ে তৈরি) করে সেই মশাগুলো নিয়ে আসেন।

তার নাম শেখ চুন্নু মিয়া। গত ২০ বছরের বেশি সময় ধরে তিনি এই কাজ করে আসছেন সিটি করপোরেশনের জন্য।

পঞ্চান্ন বছর বয়সের চুন্নু মিয়া মশক নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের একজন মেকানিক। তিনি সিটি করপোরেশন এবং কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের বিভিন্ন কর্মকর্তাদের কাছ থেকে মশা সম্পর্কে বিভিন্ন বিষয়ে জানলেও, মশা ধরার কায়দাটি মূলত তিনি নিজে নিজে রপ্ত করেছেন।

“একমাত্র আমিই এই দুই সিটি করপোরেশনের লেইগ্যা মশা ধইরা দিই,” চুন্নু মিয়া তার ঢাকাইয়া টানে এবং প্রশংসার সুরে চা খেতে খেতে বলছিলেন।

মশা যেভাবে ধরেন তিনি

“আমি যেহান থেইক্কা মশা নিয়া আসি, হেই জায়গায় আপনে যাইবার চাইবেন না। কামরাঙ্গীরচরের খাল বিল, ডোবা থেইক্কা মশার লার্ভা গুলান ধরন লাগে। পানিতে নাইম্মা খুব সাবধানে ধরন লাগে। যদি আপনের ছায়াও ওই লার্ভার উপরে পরে, সব পানির তলায় চইল্লা যাইবো গা,” বলছিলেন লালবাগের বাসিন্দা চুন্নু মিয়া।

তিনি জানালেন- লার্ভাগুলো বালতি দিয়ে এনে বিভিন্ন পাত্রে রাখা হয়। পাত্রগুলো মশারির খাঁচা দিয়ে ঢেকে রাখা হয় এবং কয়েকদিনের মধ্যে সেগুলো পরিপূর্ণ মশায় পরিণত হয়।

মশারির খাঁচার ওপর গ্লুকোজ ভেজানো তুলার টুকরো রাখা হয়। জন্মাবার পর মশাগুলো সেই তুলা থেকে তাদের প্রয়োজনীয় পুষ্টি পেয়ে থাকে।

কিন্তু, এখানেই চুন্নু মিয়ার কাজ শেষ হয়ে যায় না।

সেই মশাগুলোকে তিনি একটি একটি করে গুণে আরো ১০-১২টি মশারির খাঁচায় রেখে দেন। পরীক্ষকরা যেভাবে যে কয়টি মশা চান, ঠিক সেভাবে তিনি মশাগুলো খাঁচায় ভরে নিয়ে আসেন।

“এইডা খুব কঠিন কাম। একটা সাদা পাইপ দিয়া মুখ দিয়া চুয়া চুয়া এক খাঁচা থেইক্কা আর এক খাঁচায় নিয়া ছাড়ন লাগে। পাইপের মইধ্যে জালি আছে, যেনো মুখের মইধ্যে মশা না ঢুকে,” মশা খাঁচায় রাখার প্রক্রিয়া ব্যাখ্যা করার সময় এসব বলেন তিনি।

সম্প্রতি, মশার ওপর নতুন ওষুধ পরীক্ষা করা হয়। সে সময় ১০-১২টি খাঁচার প্রত্যেকটির মধ্যে ৫০টি করে মশা রাখা হয়। চুন্নু মিয়া এই কষ্টসাধ্য প্রক্রিয়ার মাধ্যমে একাই মশাগুলোকে প্রত্যেকটি খাঁচায় ভরে রাখেন।

“পাইপ যদি বড় হয় তাইলে মুখ দিয়া মশা টানতে কষ্ট হয়। এইডা ছাড়াও মুখ দিয়া টান দিলে মশাগুলার গন্ধও মুখে চইল্লা আসে। সবকিছু মিলায়া এহন শ্বাস কষ্ট হয় মাঝে মাঝে,” বলেন চুন্নু মিয়া।

টাকা নেই, তবুও গর্ব করতে পারেন

চুন্নু মিয়া যদিও এই কষ্ট সাধ্য ও বিশেষ কাজের জন্য আলাদা টাকা পান না, তবুও তিনি তার এই কাজ নিয়ে গর্ব করেন। তার এই কাজে বিশেষ দক্ষতা থাকার কারণেই অনেক বিশেষজ্ঞ তার কাছে সহায়তা চাইতে আসেন।

“প্রত্যেক মাসেই আমি সিটি করপোরেশন ছাড়াও, মহাখালী (রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউট) আর ফার্মগেট (কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর) থেইক্কা কল পাই মশা ধরনের লেইগা,” তিনি বলেন।

চুন্নু মিয়া শুধু যে নিজের প্রশংসা নিজেই করেন তা কিন্তু নয়। ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের ভাণ্ডার ও ক্রয় কর্মকর্তা লিয়াকত হোসেনও তার প্রশংসা করলেন।

তিনি বলেন, “যখনি আমাদের মশার দরকার হয়, তখনি চুন্নু আমাদের সাহায্য করেন। এটি তিনি করে আসছেন অনেক বছর ধরে।”

চুন্নু মিয়ার দুই ছেলে ও এক মেয়ে। মেয়েকে বিয়ে দিয়েছেন। মেয়ের জামাইকে সঙ্গে রাখেন তার কাজে সাহায্য করার জন্য।

মশা ছেলে নাকি মেয়ে, কিভাবে চিনেন তিনি

কথা বলার এক পর্যায়ে তাকে যখন জিজ্ঞেস করি, তিনি ছেলে ও মেয়ে মশা আলাদা করে চিনতে পারেন কী না?- উৎসাহী হয়ে তিনি ছেলে ও মেয়ে মশা চেনার কৌশল শিখিয়ে দেন।

“আহেন, দেখাই আপনেরে- কোনডা পোলা আর কোনডা মাইয়া মশা। এইডা অনেক আগে আমি এক ডাক্তারের কাছ থেইক্কা শিখছিলাম,” একটি মশার খাঁচার দিকে নিয়ে গিয়ে কথাগুলো বললেন তিনি।

এরপরই তিনি সেই কৌশলটি দেখিয়ে দিলেন– যা দিয়ে খালি চোখেই মশা ছেলে নাকি মেয়ে তা সনাক্ত করা যায়।

জানালেন, ছেলে মশাদের লোমশ অ্যান্টেনা থাকে মুখের দিকে, কিন্তু মেয়েদের থাকে না।

মশা নিয়ে আরো অনেক গল্প হলো চুন্নু মিয়ার সঙ্গে। সবশেষে, আবার দেখা হবে- এমন আশ্বাস দিয়ে বিদায় নিলাম।

Comments

The Daily Star  | English
NCP will not accept delay in Teesta master plan

Won’t accept any implementation delay: Nahid

National Citizen Party Convener Nahid Islam yesterday said his party would not accept any delay or political maneuver over implementing the Teesta master plan.

4h ago