সবার জন্যে কম খরচে বাড়ি, কীভাবে?

জমির মালিক, বিল্ডার, অর্থলগ্নিকারী এবং প্রত্যাশিত বাড়ির মালিকদের স্বার্থকে বিবেচনায় নিয়ে একটি সমন্বিত নীতি আবাসন খাতকে আরো সমৃদ্ধ করে তুলতে পারে এবং আরো বেশি মানুষকে বাড়ির মালিক করতে পারে বলে মন্তব্য করেছেন এই শিল্পের সঙ্গে জড়িত ব্যক্তি এবং অর্থলগ্নিকারীরা।

জমির মালিক, বিল্ডার, অর্থলগ্নিকারী এবং প্রত্যাশিত বাড়ির মালিকদের স্বার্থকে বিবেচনায় নিয়ে একটি সমন্বিত নীতি আবাসন খাতকে আরো সমৃদ্ধ করে তুলতে পারে এবং আরো বেশি মানুষকে বাড়ির মালিক করতে পারে বলে মন্তব্য করেছেন এই শিল্পের সঙ্গে জড়িত ব্যক্তি এবং অর্থলগ্নিকারীরা।

আবাসনের জন্য সরকারের বেশ কয়েকটি নীতিমালা ও উদ্যোগ রয়েছে তবে সেগুলো পর্যাপ্ত নয়। এমনকী, সেগুলো সবার আবাসন নিশ্চিত করার জন্যেও যথেষ্ট নয় বলে মন্তব্য করা হয়েছে।

গতকাল (১২ অক্টোবর) দ্য ডেইলি স্টার কার্যালয়ে আয়োজিত সাশ্রয়ী মূল্যে আবাসন ও স্টেকহোল্ডারদের ভূমিকাবিষয়ক এক গোলটেবিল আলোচনায় বক্তারা এ মন্তব্য করেন।

সম্পত্তির উচ্চমূল্যের কারণে অনেকের পক্ষে বাড়ির মালিক হয়ে উঠা হয় না উল্লেখ করে তারা বলেন, ঢাকায় একটি অ্যাপার্টমেন্টের দাম একটি পরিবারের মাসিক বাড়ি ভাড়ার তুলনায় ১০০ গুণের চেয়ে বেশি। এর কারণ, চাহিদার চেয়ে সরবরাহ খুব কম।

প্রতি বছর যেখানে অ্যাপার্টমেন্টের চাহিদা রয়েছে ১ লাখ ইউনিট, সেখানে ২০ হাজার ইউনিটের জন্যে নিবন্ধন করা হচ্ছে।

সেন্টার ফর হাউজিং অ্যান্ড বিল্ডিং রিসার্চের (এইচবিআরসি) নির্বাহী পরিচালক মোহাম্মদ আবু সাদিক বলেন, “হাউজিং আমাদের সাংবিধানিক অধিকার, তবে নিজের বাড়ি থাকা এখনো বিপুল সংখ্যক জনগোষ্ঠীর নাগালের বাইরে রয়ে গেছে।”

বাংলাদেশে মোট জনসংখ্যার ৮৮ শতাংশই টিনের ঘরে বাস করেন। সাশ্রয়ী মূল্যের আবাসনের কোনো সংজ্ঞা নেই, যদিও এটি মূল সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিশেষ করে, উন্নয়নশীল দেশগুলোতে বেশিরভাগ মানুষের বাজারমূল্যে বাড়ি কেনার সামর্থ্য নেই।

তবে কোনো ব্যক্তির আয়ের ৩০ থেকে ৩৫ শতাংশ দিয়ে গৃহ ঋণের মাসিক কিস্তি শোধ করার ব্যবস্থা থাকলে সেই ব্যক্তির পক্ষে বাড়ির মালিক হওয়া সহজ হয়ে যায়।

তিনি আরো বলেন, বাংলাদেশে অধিকাংশ জনগণ মধ্যম আয়ের। তারা যাতে বাড়ির মালিক হতে পারেন সেজন্যে সরকার, গবেষক, বিল্ডার এবং আর্থিক সংস্থাগুলির ভূমিকা রয়েছে।

আবাসন পরিস্থিতিকে “ভয়াবহ” হিসেবে উল্লেখ করেন বাংলাদেশ প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) নগর ও আঞ্চলিক পরিকল্পনা বিভাগের অধ্যাপক ইশরাত ইসলাম।

আইপিডিসি ফিন্যান্সের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও প্রধান নির্বাহী মমিনুল ইসলাম বলেন, বাংলাদেশে ফ্ল্যাটের দাম খুব বেশি, যা একজন ব্যক্তির মাসিক আয়ের প্রায় ১২০ গুণ। কিন্তু, গ্লোবাল স্ট্যান্ডার্ড হচ্ছে এটি হবে একজন ব্যক্তির আয়ের ৪৮ থেকে ৬০ গুণ।

ভারতের মুম্বাইয়ের মতো একটি ঘনবসতিপূর্ণ শহরে বিকেন্দ্রীকরণের ফলে বেসরকারি উদ্যোগে গড়ে উঠেছে হাউজিং প্রকল্পগুলো। সেখানে একটি ছোট ইউনিটের ফ্ল্যাট কেনার খরচ অনেক কমিয়ে আনা হয়েছে। মধ্যম আয়ের একজন সাধারণ মানুষের আয়ের ১২০ গুণ থেকে কমিয়ে তা ৫৪ গুণে নিয়ে আসা হয়েছে।

“আমরা যদি (ঢাকার কাছাকাছি এলাকা হিসেবে) ময়মনসিংহ, কুমিল্লা, মানিকগঞ্জ এবং টাঙ্গাইলে এ ধরনের কাজ করতে পারি তাহলে ২৫ থেকে ৪০ লাখ টাকায় একটি ফ্লাট দেওয়া সম্ভব হবে” বলেও মনে করেন তিনি।

বাংলাদেশে সাশ্রয়ী মূল্যের আবাসন ফিন্যান্সের কোনো অস্তিত্ব নেই বলেও তিনি মন্তব্য করেন।

ভারতে সাশ্রয়ী মূল্যে আবাসনকে উৎসাহ দিতে দেশটির সরকার করমুক্তির সুবিধা দেয়। ফলে গৃহঋণের প্রকৃত সুদের হার ৫ থেকে ৬ শতাংশে নেমে আসে।

“এর ফলে, সেখানে একজন গাড়িচালক বা ছোট দোকানদারও ফ্ল্যাট কিনতে পারেন। আমাদের এসব ভালো উদাহরণগুলো থেকে শিক্ষা নেওয়া দরকার,” বলে জানান মমিনুল ইসলাম। তিনি শীঘ্রই ভূমি রেকর্ডকে ডিজিটালাইজেশন করার আহ্বানও জানান।

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নগর ও আঞ্চলিক পরিকল্পনা বিভাগের অধ্যাপক আক্তার মাহমুদ বলেন, “অ্যাপার্টমেন্টের দাম বেশি হওয়ার মূল কারণ হলো জমির দাম বেশি।” তার মতে, “জমির বাজারে সরকারের কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই। এটি নিয়ন্ত্রণ করা উচিত।”

মূল নির্মাণ সামগ্রীগুলোর খরচ নিয়ন্ত্রণে সরকারের ব্যবস্থা নেওয়া উচিত বলে মত প্রকাশ করেন বিল্ডিং টেকনোলজি অ্যান্ড আইডিয়ার (বিটিআই) ব্যবস্থাপনা পরিচালক এফ আর খান।

তার মতে, একটি অ্যাপার্টমেন্ট প্রকল্পের মোট খরচের ২০ শতাংশ চলে যায় রড ও সিমেন্ট কেনায়। এই উপকরণ দুটির জন্যে চলতি অর্থ বছরের বাজেটে যেসব ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে তার ফলে একটি ফ্ল্যাটের প্রতি বর্গফুটের দাম ২০০ টাকা থেকে ৫০০ টাকা বেড়ে গেছে।

ফ্ল্যাটের জন্যে সেকেন্ডারি বাজার গড়ে তোলা প্রয়োজন এবং সেই সঙ্গে ফ্ল্যাট নিবন্ধিতকরণের খরচও কমাতে হবে। তার মতে, বর্তমানে সম্পত্তির খরচের ১৫ শতাংশ চলে যায় নিবন্ধন খরচ হিসেবে। এছাড়াও, গৃহঋণের সুদের হারও একক অঙ্কে নামিয়ে আনতে হবে বলে মনে করেন বিটিআইয়ের ব্যবস্থাপনা পরিচালক।

বিপ্রোপার্টি ডটকমের মহাব্যবস্থাপক রেজবীন আহসান বলেন, “নিবন্ধন খরচ বেশি হওয়ায় মধ্যবিত্ত পরিবারগুলোর জন্যে ফ্ল্যাটের দাম অনেক বেড়ে যাচ্ছে।”

ঢাকা ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও প্রধান নির্বাহী সৈয়দ মাহবুবুর রহমান বলেন, “দীর্ঘমেয়াদি অর্থায়নের সুযোগ না থাকায় একক অঙ্কের সুদ দেওয়া ব্যাংকগুলোর পক্ষে কঠিন হবে।”

“আদর্শগতভাবে, গৃহঋণের মেয়াদ ৩০ বছরের বেশি হওয়া উচিত,” বলে জানান লঙ্কাবাংলা ফিন্যান্সের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা খাজা শাহরিয়ার।

তার দৃষ্টিতে, দীর্ঘমেয়াদি অর্থায়নের সুবিধার অভাবে আর্থিক সংস্থাগুলির পক্ষে এ জাতীয় সুবিধা দেওয়া কঠিন। তিনি আবাসন খাতে অর্থায়নের জন্য রিফিন্যান্সিং স্কিম পুনরায় চালু করার আহ্বান জানান।

দেশে দীর্ঘমেয়াদী তহবিলের সংকট সমাধানের জন্য বন্ড বাজারের উন্নয়নের প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরেন আইডিএলসি ফিন্যান্সের প্রধান নির্বাহী ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক আরিফ খান।

নির্মাণকাজের উপকরণগুলোর ওপর মূল্য সংযোজন কর কমিয়ে দেওয়ার দাবিও জানান তিনি।

“এর প্রভাব অর্থনীতিতে ইতিবাচক হবে,” উল্লেখ করেন আরিফ খান। সবার আবাসন নিশ্চিত করতে সব স্টেকহোল্ডারকে নিয়ে একটি সমন্বিত নীতিমালা করার জন্যে সরকারের প্রতি আহ্বান জানান তিনি।

প্রাইম ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও প্রধান নির্বাহী রাহেল আহমেদ বলেন, সাশ্রয়ী মূল্যের আবাসন নিশ্চিত করতে বাংলাদেশ হাউজ বিল্ডিং ফিন্যান্স কর্পোরেশনের আরো সক্রিয় ভূমিকা পালন করা উচিত।

ব্র্যাক ব্যাংকের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক সেলিম আর এফ হুসাইন বলেন, একটি বিশেষায়িত হোম ফিন্যান্সিং সংস্থা প্রতিষ্ঠা করা দরকার যা বন্ধক এবং বাড়ির অর্থায়নে সহায়তা করতে পারে।

তিনি বলেন, “আমাদের দীর্ঘমেয়াদি বন্ড বাজারে ছাড়তে হবে। আজকাল কেউই আর বন্ড মার্কেটে বিনিয়োগ করতে চাচ্ছেন না। কারণ, সেখান থেকে তারা কোনো কর সুবিধা পান না। জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের উচিত এই বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে দেখা।”

বিল্ডিং ফর ফিউচারের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও রিয়েল এস্টেট অ্যান্ড হাউজিং অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (রিহাব) সাবেক সভাপতি তানভিরুল হক বলেন, তরুণ পেশাজীবীদের প্রথমবার বাড়ি কিনতে উৎসাহ হিসেবে সরকারের উচিত কর এবং অন্যান্য সুবিধাগুলি নিশ্চিত করা।

ডেইলি স্টারের সম্পাদক ও প্রকাশক মাহফুজ আনাম বলেন, “সমৃদ্ধির একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ হচ্ছে আবাসন। সবাই নিজের একটি বাড়ি চান।”

বিপ্রোপার্টির আহসান বলেন, “যুক্তিসঙ্গত ও সাশ্রয়ী মূল্যের আবাসনের জন্য আমাদের অবশ্যই ঢাকা শহর থেকে বাইরে যেতে হবে, যেখানে জমির দাম এখনো তুলনামূলকভাবে কম।”

তবে বেসরকারি ব্যাংকের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তাদের প্ল্যাটফর্ম- অ্যাসোসিয়েশন অফ ব্যাংকার্স, বাংলাদেশের চেয়ারম্যান এবং ঢাকা ব্যাংকের প্রধান নির্বাহী সৈয়দ মাহবুবুর রহমান বলেন, ঢাকার সঙ্গে ভালো যোগাযোগ ব্যবস্থা চালু থাকলে মানুষ তখন বিকেন্দ্রীকরণের ধারণাটি মাথায় রাখে ঢাকার বাইরে বাড়ি কিনবেন।

হাইলাইটস

- আবাসনের জন্য বিস্তৃত নীতিমালা প্রণয়ন করতে হবে

- প্রথমবারের ক্রেতাদের জন্য কর উত্সাহ দিতে হবে

- প্রধান শহরের উপকণ্ঠে উপ-শহরগুলোর বিকাশের জন্য যোগাযোগ এবং অন্যান্য প্রাথমিক সুবিধা বাড়াতে হবে

- নিবদ্ধকরণ খরচ কমাতে হবে

- আবাসন জন্য সেকেন্ডারি বাজার গড়ে তুলতে হবে

- স্বল্প ও মধ্যম আয়ের মানুষদের জন্য দীর্ঘমেয়াদী অর্থায়নের সুযোগ নিশ্চিত করতে হবে

- বন্ড বাজারের বিকাশ ঘটাতে হবে

- গৃহঋণের জন্য রিফিন্যান্সিং স্কিমটি পুনরায় চালু করতে হবে

- খরচ কমানোর জন্যে বিকল্প নির্মাণ সামগ্রী ব্যবহারকে উত্সাহিত করতে হবে

- জমির রেকর্ড ডিজিটালাইজেশন করতে হবে

Comments

The Daily Star  | English

Wage growth still below inflation

Unskilled workers wage grew 8.01% in September this year when inflation was 9.92%

2h ago