ফাইভ জি’র সম্ভাবনায় ‘প্রশাসক’ চ্যালেঞ্জ
একই দিনের বড় দুটো খবর। এক দিকে ২০২০ সালের শেষে বা ২০২১ সালের শুরুতে দেশে পঞ্চম প্রজন্মের মোবাইল প্রযুক্তি সেবা– যেটিকে জনপ্রিয় টার্মে ‘ফাইভ জি’ বলা হচ্ছে– চালুর লক্ষ্য ঘোষণা। অন্যদিকে দেশের প্রধান দুই মোবাইল ফোন অপারেটরে প্রশাসক নিয়োগের ক্ষিপ্রগতি।
বলার অপেক্ষা রাখে না যে, দ্বিতীয়টি আন্তর্জাতিক খবর, যেটি দেশে-বিদেশি বিনিয়োগের ওপর খড়গ নেমে আসার মতো জ্বালানি জোগাবে।
অবধারিতভাবে প্রথমটি সুসংবাদ, আর খবর হিসেবেও গুরুত্বের মর্যাদায় ওপরের দিকে থাকার মতোই। কিন্তু দ্বিতীয় খবরটি ভয়াবহ এবং প্রথমটির সঙ্গে তুলনামূলক আলোচনায় বিপরীতমুখী; সাংঘর্ষিকও বটে।
বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশনের করা দুটি পৃথক অডিটের মাধ্যমে দুই প্রধান মোবাইল ফোন অপারেটর গ্রামীণফোন এবং রবির কাছে ১৩ হাজার ৪৪৭ কোটি পাওনা দাবিকে ধরেই দ্বিতীয় খবরটি এসেছে। বারবার চাওয়ার পরেও অপারেটররা যেহেতু টাকা দেয়নি বরং অডিটের নানা অংশকে বিতর্কিত দাবি করে শালিসির কথা বলেছে তারা। এ পর্যায়ে বিটিআরসি আরেকটু এগিয়ে গিয়ে লাইসেন্স কেনো বাতিল হবে না তার জন্যে নোটিশ দিয়ে দেয়।
টেলিযোগাযোগ আইনের যে ধারায় এই নোটিশ দেওয়া হয়, সেখানে এর পরের প্রক্রিয়াতেই আছে প্রশাসক নিয়োগ। সর্বশেষ খবর হলো, গেলো মঙ্গলবার একেক অপারেটরে চারজনের একেকটি প্রশাসক দল নিয়োগের প্রস্তাব করে বিটিআরসি। বৃহস্পতিবারই সেটি টেলিযোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের অনুমোদনও পেয়ে যায়। বিটিআরসি এখন প্রশাসক দল গঠনের কাজ শুরু করতে যাচ্ছে।
এর মধ্যে, বুধবার ফাইভ জি’র প্রস্তুতিমূলক একটি সেমিনারের আয়োজন করে বিটিআরসি। যেটি এই খাতের সকল পর্যায়ের প্রতিনিধিদের অংশগ্রহণমূলক ছিলো। এই সেমিনারেই আসে সম্ভাবনার ফাইভ জি রোড ম্যাপ– যাতে ২০২৬ সালের মধ্যে গোটা দেশে সেবাটি চালুর কথা আছে। পর দিন দুটি খবরই দ্য ডেইলি স্টার প্রকাশ করে এবং তাতে গোটা টেলিযোগাযোগ খাতে বেশ সাড়া পড়ে- বিশেষ করে প্রশাসক নিয়োগের খরবটিতে।
যাদেরকে দিয়ে ফাইভ জি সেবা দেশে চালু করার কথা, তাদের ঘর যাচ্ছে প্রশাসকের হাতে– এটি যেনো সম্ভাবনার জায়গায় ঠিক মিলছে না।
ডিজিটাল বাংলাদেশের আলোচনায় এখন সবচেয়ে বেশি আলোচিত হচ্ছে যে টার্মটি সেটি হলো– চতুর্থ শিল্পবিপ্লব। প্রথম, দ্বিতীয় এবং তৃতীয় শিল্পবিপ্লব আমরা ধরতে না পারলেও, চতুর্থ শিল্পবিপ্লবে আমরাই নেতৃত্ব দিবো এমন খই ফোটানো কথা ঢাকায় এখন হরহামেশাই শুনছি।
চারিদিকে এখন আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স, ইন্টারনেট অব থিংকস, রোবটিক্স, বিগ ডেটা নিয়ে নানা স্বপ্ন সাজানোর কথা শুনি। শুনতে শুনতে বিশ্বাসও করতে শুরু করেছি। তাতে করে নিজের স্বপ্নজালও ক্রমাগত বিস্তৃত হতে শুরু করেছে– আমরা পারবো! বলার অপেক্ষা রাখে না, এইসব সেবা মাধ্যম কিন্তু ফাইভ জি নেটওয়ার্কেই করার কথা।
স্বপ্নটা ঠিক এই জায়গাটায় এসেই ফিতা কেটে যাচ্ছে। কাজটা যার ঘাড়ের ওপর চাপিয়ে করবো, তাকে তো বাঁচিয়ে রাখতে হবে। তার যৌক্তিক কথাও শুনতে হবে। বলদই যদি না বাঁচে, হাল চাষটা করবো কী দিয়ে? পরে তো নিজের ঘাড়ে জোয়াল টেনেও কুল কিনারা হবে না! স্বপ্নকে দুঃস্বপ্নে রূপ দিতে চাই না বলেই চিন্তাকেও আর এগুতেও দেই না।
বহুদিন ধরে অপারেটর-বিটিআরসির চলা টানাপড়েনের এক পর্যায়ে ত্রাতা হতে এসেছিলেন অর্থমন্ত্রী। সমস্যার সুরাহার আলোচনা শুরু করলেও তার উদ্যোগও ভেস্তে গেছে। গত ১৮ সেপ্টেম্বর তিনি এ বিষয়ে প্রথম বৈঠক করে বলেছিলেন, দুই থেকে তিন সপ্তাহের মধ্যে সুরাহা করে ফেলবেন। ওই বৈঠকের পর চার সপ্তাহ পেরিয়ে এখন পাঁচ সপ্তাহ চলছে। যারা খবর রাখেন তারা জানেন অর্থমন্ত্রীর ওই আলোচনা আর চাকা ঘুরাচ্ছে না।
অর্থমন্ত্রী ডিজিটালাইজেশনের প্রসঙ্গ আনেননি। তিনি করেছিলেন তার নিজের হিসাব। তার হিসাবে ছিলো অপারেটররা একশ টাকা আয় করলে অর্ধেকটা সরকারি কোষাগারে জমা পড়ে। ফলে এদের ব্যবসার শ্রীবৃদ্ধি করার সহজ হিসাব কষেছিলেন অর্থমন্ত্রী।
তিনি যেটি বলেননি, তার একটি হলো- বিদেশি বিনিয়োগ। সরাসরি আসা বিদেশি বিনিয়োগে তো এর প্রভাব পড়বেই, উপরন্তু এই ঘটনা প্রভাবে এরইমধ্যে শেয়ার বাজার থেকে বিদেশিরা ছুটে পালাতে শুরু করেছেন। জানি না সরকার বাহাদুরের সিদ্ধান্তের ক্ষেত্র এতোটা প্রসারিত হয়েছিলো কী না।
অর্থমন্ত্রীর একাধিক আলোচনায়ও যখন গতি আসলো না, তখন অবধারিতভাবে বোঝাই যাচ্ছিলো বড় কিছু আসছে। বলা হচ্ছে, প্রশাসকদের প্রধান কাজ হবে অডিটের মাধ্যমে গ্রামীণফোনের কাছ দাবিকৃত ১২ হাজার ৫৭৯ কোটি টাকা এবং রবির কাছ থেকে ৮৬৭ কোটি টাকা সরকারকে বুঝিয়ে দেওয়া।
দুই অপারেটরের টালিখাতা বলছে, লাভ থেকে টাকা নিতে হলে অন্তত তিন বছর প্রশাসকদেরকে ব্যবসাটা চালাতে হবে। আর যদি মূলধন থেকে নিয়ে নেন তাহলে কোম্পানি কি আর থাকবে? বিনিয়োগই বা তারা কীভাবে পাবেন, সে চিন্তা না হয় বাদই থাকলো। এবার প্রশাসক নিয়োগের পৃষ্ঠা উল্টে দেখুন বাংলাদেশে কবে কোন প্রশাসক কোন কোম্পানিকে ঠিকঠাক চালাতে পেরেছে? উপরন্তু এগুলো তো প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান! আর প্রশাসকরা যদি সত্যিই মোবাইল অপারেটর চালাতে পারেনই, তাহলে দেড় দশকেও টেলিটক কেনো এমন মরণদশা নিয়ে টিকে আছে? প্রশাসক দিয়েই টেলিটকের শ্রীবৃদ্ধি কোনো ঘটাচ্ছি না?
দুই অপারেটর বারবার বলছে, এই অডিটে হাজারটা গণ্ডগোল রয়ে গেছে। গণ্ডগোলের এই অডিটের মাধ্যমে দাবি করা টাকা আদায়ে ‘প্রশাসক’ প্রক্রিয়া কতোটা সফল হবে? তবে অন্তত এটা বুঝতে পারি সব মিলে বিদেশি বিনিয়োগকেন্দ্রিক বড় এক ঝুঁকির দিকেই আমরা পা চালাচ্ছি।
টেলিযোগাযোগ খাতে এখন কেমন কেমন একটা বারুদে গন্ধ। নানা উৎস থেকে খবর আসছে বিনিয়োগকারীরা আর ঘরোয়া ম্যাচ খেলবেন না। তারা এখন আন্তর্জাতিক ম্যাচের প্রস্তুতি নিচ্ছেন।
২০১১ সালেও আমরা এমন আন্তর্জাতিক ম্যাচ উপভোগ করেছি। সেবারও বিটিআরসি গ্রামীণফোনের লাইসেন্স নবায়ন এবং তখনকার একটি বিতর্কিত অডিট মিলিয়ে গুবলেট পাকিয়ে ফেলেছিলো। আন্তর্জাতিক ম্যাচেই সমাধান এসেছিলো সেবার। এর আগেও টেলিযোগাযোগ খাতে আমরা নানা আন্তর্জাতিক ম্যাচ দেখেছি। আবার আন্তর্জাতিক ম্যাচ না খেলতে চেয়ে অনেক টেলিকম কোম্পানি বাংলাদেশই ছেড়েছে। তাতে তাদের হয়তো টাকার অংকে বহু ক্ষতি হয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশের যে ক্ষতি হয়েছে, সেটি টাকা দিয়ে কখনোই কেউ মাপতে পারবে না। যে কারণে বিটিআরসি বারবার উদ্যোগ নিলেও টেলিকম খাতের কোনো বিদেশি বিনিয়োগকারীর টিকিটিও আর দেখতে পাওয়া যায় না।
ফিরে আসি ফাইভ জি’র কথায়। সন্দেহ নেই ফাইভ জি-ই হবে সামনের দিনে দিন বদলে দেওয়া প্রযুক্তি। যেটি হয়তো গ্রাহককে সরাসরি সেবা দেবে না, তবে শিল্প ক্ষেত্রে বড় রকমের পরিবর্তন এনে দেবে মোবাইলের পঞ্চম প্রজন্মের এই প্রযুক্তি। আর এটি বলার অপেক্ষা রাখে না, সত্যিই যদি আমরা এই দফায় ট্রেন মিস করে ফেলি তাহলে কিন্তু সেই ক্ষতি পূরণ করা দুরূহ হয়ে পড়বে।
১৯৯২ সালে সাবমেরিন কেবলে যুক্ত না হওয়ার ক্ষত পরের দুই দশকেও সারানো যায়নি। অনেকে সেটি দিয়ে রাজনৈতিক ফায়দাও লুটেছেন। কিন্তু ফাইভ জি’র ট্রেন মিস হয়ে গেলে কিন্তু আমাদেরকে কয়েক প্রজন্ম ভুগতে হবে।
যারা আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স, ইন্টারনেট অব থিংকস, রোবটিক্স, বিগ ডেটার স্বপ্নময় বুলি শোনাচ্ছেন তারা ভাবুন তো সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে আমরা যদি এগুতে না পারি তাহলে আপনি-আমি তো বাদ, আমাদের আরও কয় প্রজন্মকেও এর খেসারত দিতে হবে?
সুতরাং নীতি নির্ধারণ যারা করবেন, তাদেরকে আগে-পেছনেও ভাবতে হবে। ভাবতে হবে সম্ভাবনার ফাইভ জি-তে প্রশাসকের চোখ রাঙানি কতোটা নেওয়া যাবে?
লেখক: সিনিয়র রিপোর্টার, দ্য ডেইলি স্টার
Comments