‘বিশ্ববিদ্যালয়ে অস্থিতিশীলতার দায় সরকারকে নিতে হবে’
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিকতর উন্নয়ন প্রকল্পে দুর্নীতি এবং অপরিকল্পনার অভিযোগ উঠেছে। এই অভিযোগের প্রেক্ষিতে উপাচার্য অধ্যাপক ফারজানা ইসলামের অপসারণের দাবিতে আন্দোলন অব্যাহত রেখেছে শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের একাংশ।
দুর্নীতির অভিযোগের সুষ্ঠু তদন্ত এবং উপাচার্যের অপসারণের দাবিতে প্রায় দু’মাসের অধিক সময় ধরে চলা এই আন্দোলনে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনিক কার্যক্রমে অচলাবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। বর্তমান সময়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিস্থিতি নিয়ে জানার জন্যে দ্য ডেইলি স্টার অনলাইনের পক্ষ থেকে টেলিফোনে যোগাযোগ করা হয়েছিলো শিক্ষক সমিতির সভাপতি অধ্যাপক ড. অজিত মজুমদার এবং বঙ্গবন্ধু শিক্ষক পরিষদের সভাপতি অধ্যাপক ড. মো. আব্দুল মান্নান চৌধুরীর সঙ্গে।
“আমরা সমিতির পক্ষ থেকে সিদ্ধান্ত নিয়েছি সবার সঙ্গে কথা বলে সমস্যার সমাধান করবো,” বলে মন্তব্য করেন শিক্ষক সমিতির সভাপতি অধ্যাপক ড. অজিত মজুমদার। এর বেশি কিছু বলতে রাজি হননি তিনি। ড. মো. আব্দুল মান্নান চৌধুরী ব্যস্ত রয়েছেন বলে কথা বলতে অপারগতা প্রকাশ করেন। উপাচার্য অধ্যাপক ফারজানা ইসলামের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করে কথা বলা সম্ভব হয়নি।
আন্দোলন ও বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ে ডেইলি স্টারের সঙ্গে কথা বলেছেন অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ এবং ‘দুর্নীতির বিরুদ্ধে জাহাঙ্গীরনগর’র মুখপাত্র দর্শন বিভাগের অধ্যাপক রায়হান রাইন।
অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ বলেন, “বিশ্ববিদ্যালয়ে এখন যে জটিলতা এর কারণ সরকারের নিষ্ক্রিয়তা। আর তার সঙ্গে এখন যুক্ত হয়েছে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন থেকে এখন এই আন্দোলনকে দাবি করা হচ্ছে যে আন্দোলনের পিছনে শিবির সংশ্লিষ্টতা রয়েছে। এই অভিযোগটা আন্দোলনকে খারিজ করার কৌশল। যা এতো ব্যবহৃত হয়েছে যে এটা এখন জীর্ণ। এবং এটা সরকার থেকে শুরু করে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়, বিভিন্ন পর্যায়ের যারা ক্ষমতাবান লোকজন এটা ব্যবহার করে অভাবিতভাবে জামাত এবং শিবিরকে এমন সার্ভিস দিচ্ছে যেকোনো বৈধ ও নৈতিক আন্দোলন যখন হচ্ছে যেটা তাদের বিরুদ্ধে যাচ্ছে তারা তখন তার সঙ্গে শিবির-সংশ্লিষ্টতা বের করে এটি দেখাতে চাচ্ছে যে জামাত-শিবির খুব নৈতিক আন্দোলনগুলোর সঙ্গে যুক্ত আছে।
এটা তো তারাই জামাত-শিবিরকে সার্ভিস দিচ্ছে যেটা আর কোনোদিন কেউ দিতে পারেনি। এটা বলে তো কোনো লাভ হবে না। কারণ এ আন্দোলনের ধারাবাহিকতা শুরু হয়েছে বেশ আগে থেকেই। হল নির্মাণ হচ্ছে ভুল জায়গায়। একটি পুরাতন হল সেটাকে শেষ করে দিয়ে, পরিত্যক্ত বানানোর একটা অবস্থা তৈরি করে, প্রাণ-প্রকৃতি বিনাশ করে তা করার কথা ভাবা হয়। সেটি থেকে আন্দোলনটির সূত্রপাত। এবং পরবর্তীকালে মহাপরিকল্পনায় অস্বচ্ছতা ও তা গোপনীয়তার মাধ্যমে করা হচ্ছে। সেটিকে স্বচ্ছ করার জন্য দাবি করা হচ্ছে। সেই আন্দোলন এর মধ্যে জোরদার হয়েছে। এখানে শিবিরের কী স্বার্থ থাকতে পারে?
গত বেশকিছু দিন ধরে শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের যৌথ মঞ্চের মধ্যদিয়ে যে আন্দোলন হচ্ছে সে আন্দোলনের একটি নৈতিক ভিত্তি আছে। এবং এ আন্দোলনটা আসছে ধারাবাহিকভাবে। প্রথমদিকে দাবি ছিলো মহাপরিকল্পনায় অনিয়ম, দুর্নীতির বিষয়ে। যে মহাপরিকল্পনা হওয়া উচিত স্বচ্ছতার সঙ্গে পরিবেশ-বান্ধব উপায়ে তার থেকে ভিন্নভাবে তড়িঘড়ি করে যত্রতত্র, যেখানে-সেখানে নির্মাণ কাজের তাড়াহুড়া ও অস্বচ্ছতা ছিলো সেটার বিরুদ্ধে আন্দোলন শুরু হয়। এবং সেই আন্দোলনের ধারাবাহিকতাতেই এটা স্পষ্ট হয় যে মহাপরিকল্পনা প্রণয়নে তাড়াহুড়ার পেছনে দুর্নীতি একটি বড় কারণ। টাকা ছাড় হয়েছে কী না সেই বিতর্কের কোনো প্রশ্নই হয় না। কারণ ঠিকাদারদের যে সংশ্লিষ্টতা অনিয়ম ও অস্বচ্ছতার মাধ্যমে তা আমরা বিভিন্ন ধরনের সূত্র থেকে খবর পাচ্ছি। এবং এভাবেই দুর্নীতিগুলো হয়ে থাকে।
সেই পরিপ্রেক্ষিতেই যে আন্দোলনটা আস্তে আস্তে নৈতিক ভিত্তির উপর দাঁড়ায় যে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে স্বচ্ছতার সঙ্গে মহাপরিকল্পনা প্রণয়ন করতে হবে। যেখানে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের অংশগ্রহণ থাকে। এই যে দাবিটা এবং হল নির্মাণে যে অনিয়ম এটা দূর করতে হবে। যথাযথ জায়গায় হল নির্মাণ করতে হবে। এই দাবিটা উপাচার্য ও প্রশাসন মেনে নেন। এবং মেনে নেওয়ার মাধ্যমে এটাও প্রমাণিত হয়েছে যে আন্দোলনটা নৈতিক ছিলো। এই মেনে নেওয়ার পরে যে দাবিটা সবার মধ্যে ছিলো- দুর্নীতির অভিযোগ নিয়ে যথাযথভাবে তদন্ত করা হোক। আসলে এটা একটা বিস্ময়কর ব্যাপার যে বিশ্ববিদ্যালয়ে এমন একটি অভিযোগ উঠেছে উপাচার্য সম্পর্কে বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়ন প্রকল্প নিয়ে। সেই অভিযোগটা উঠার পরপরই ইউজিসি, শিক্ষামন্ত্রণালয় বা আচার্যের কার্যালয় থেকে একটা তদন্তের দরকার ছিলো। এখানে তাদের নীরবতা সত্যিই বিস্ময়কর।
তারা যদি প্রথম থেকেই এর তদন্তের দায়িত্ব গ্রহণ করতেন এবং এর সত্য-মিথ্যা বের করতেন এবং সেই অনুযায়ী ব্যবস্থা গ্রহণ করতেন, তাহলে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে এমন অচলাবস্থা সৃষ্টি হতো না। এটা আমার কাছে সত্যিই বোধের অগম্য যে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে এ অচলাবস্থা জারি রেখে সরকারের কী লাভ। কেনো সরকার এমনভাবে নিয়োগ দেয় যারা দুর্নীতির দায়ে অভিযুক্ত হয়। এবং তা নিয়ে কথা বললে, প্রশ্ন তুললে, আন্দোলন হলে, অচলাবস্থা সৃষ্টি হলে সরকার সম্পূর্ণ নির্লিপ্ত থাকে। শিক্ষামন্ত্রণালয় ও ইউজিসি তারা বসে থাকে। যা একটা অসম্ভব ব্যাপার বলে আমার মনে হয়।
আর দুর্নীতির যে অভিযোগটা উঠেছে তা সরকারি ছাত্র সংগঠনের নেতাদের মুখ থেকেই বের হয়েছে। এটা তো বাইরে থেকে কেউ বলেনি। দুর্নীতির অভিযোগটা যখন ছাত্রলীগের নেতারা বলল, তখন সরকারি দল কেনো চুপচাপ থাকে। তারা এখানে অচল মুদ্রা দিয়ে অনৈতিক অবস্থানকে বৈধতা দেওয়ার চেষ্টা করছে। আমি আশা করি, বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন এই ধরনের তৎপরতা থেকে দূরে থাকবে। একটি আন্দোলনের মধ্যে যে শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের অংশগ্রহণ সেই অংশগ্রহণ এবং আন্দোলনের যে নৈতিক ভিত্তি সেটাকে স্বীকার করবে। এই ধরনের তৎপরতার মাধ্যমে তারা নিজেদেরকেই ছোট করছেন এবং এটা প্রমাণিত হচ্ছে যে তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগের সত্যতা আছে। তারা এ আন্দোলনকে বাতিল করতে ভুল এবং নিম্নমানের কৌশল অবলম্বন করছেন। আর এখানে সরকারের দায়িত্ব বেশি বলে আমি মনে করি। শিক্ষামন্ত্রণালয়, ইউজিসি এবং আচার্যের কার্যালয়ের উচিত আর বিলম্ব না করে দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়া। এখানে যেহেতু উপাচার্যের বিরুদ্ধে অভিযোগ সুতরাং এ অভিযোগের বিষয়ে তদন্ত করা উচিত।
যদি তারা দায়িত্ব না নিয়ে সমাধান না করে, তাহলে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা, গবেষণা ও স্বাভাবিক কাজে যে অচলাবস্থা তৈরি হচ্ছে, যে সহিংস অবস্থা তৈরি হচ্ছে, যে অবিশ্বাসের পরিস্থিতি তৈরি হচ্ছে, যে দ্বন্দ্ব-সংঘাত তৈরি হচ্ছে, চক্রান্তমূলক নানান তৎপরতার মধ্যদিয়ে যে বিভিন্ন ধরনের সহিংসতার সম্ভাবনা তৈরি হচ্ছে তার সম্পূর্ণ দায়ভার সরকারকে নিতে হবে। এজন্য যথাযথ উদ্যোগ নিয়ে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়কে স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরিয়ে আনার দাবি জানাচ্ছি।
‘দুর্নীতির বিরুদ্ধে জাহাঙ্গীরনগর’র মুখপাত্র দর্শন বিভাগের অধ্যাপক রায়হান রাইন বলেন, যে কোনো আন্দোলন দমানো বা আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত কাউকে দমাতে চাইলে তাকে শিবির বলা বা ‘স্বাধীনতাবিরোধী’ ট্যাগ দেওয়া হলো ক্ষমতাসীনদের পুরনো অপকৌশল। আমরা বুয়েটে দেখলাম আবরার নামে ছেলেটাকে শুধু শিবির বলে হত্যা করে ফেলা হলো। কিন্তু, পরবর্তীতে দেখা গেলো যে সে ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের করা চুক্তিগুলোকে যৌক্তিক জায়গা থেকে বিরোধিতা করেছিলো।
আমাদের আন্দোলনকে বিতর্কিত করার জন্য শিবির ‘নাটক’ সাজানো হলো। বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন প্রাক্তন ছাত্র মোটরবাইকে যাচ্ছিলো। তাকে ধরে শিবির বানানো হলো। এখন প্রাক্তন কোনো ছাত্রের সঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয়ের নানাজনের যোগাযোগ থাকতেই পারে কিন্তু, এর দ্বারা প্রমাণ হয় না যে আন্দোলনের সঙ্গে সে যুক্ত আছে। এই আন্দোলন পরিচালিত হচ্ছে ছাত্র ইউনিয়ন, ছাত্রফ্রন্ট, সাংস্কৃতিক জোটসহ বামপন্থি, আওয়ামীপন্থি ও বিএনপিপন্থি শিক্ষকদের সমন্বয়ে। এই সর্বদলীয় সংগঠনের মতামতের ভিত্তিতে আন্দোলন চলছে। কোথাকার একজনকে প্রক্টিরিয়াল টিম ধরলো আর তাকে আন্দোলনের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট করে দেওয়ার চেষ্টা চালানো হচ্ছে। এটি সম্পূর্ণ অযৌক্তিক ও উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। বিভিন্নজনের সঙ্গে করা কনভার্সেশন এক সঙ্গে জুড়ে দিয়ে চলমান আন্দোলনকে বিতর্কিত করার চেষ্টা চালানো হচ্ছে।
তবে কার কী পরিচয় কিংবা কে শিবির করে সেটা বের হলেই প্রমাণ হয়ে যায় না যে ফারজানা ইসলাম দুর্নীতি করেন নাই। ফারজানা ইসলামের দুর্নীতি ঢাকার জন্য বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন যে পথ বেছে নিয়েছে তা হলো শাক দিয়ে মাছ ঢাকার মতো বিষয়।
Comments