দেশের ক্রিকেটের ‘তেতো সত্য’ উন্মোচিত হয়েছে যে নয় দিনে

papon-shakib
ফাইল ছবি: ফিরোজ আহমেদ

গেল বিশ্বকাপে অষ্টম স্থান অর্জনের পর থেকে বাংলাদেশের ক্রিকেট একের পর এক ধাক্কা খেয়ে যাচ্ছে। বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ড (বিসিবি) প্রাক্তন কোচ স্টিভ রোডসের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করার পর অন্তর্বর্তীকালীন কোচ খালেদ মাহমুদের অধীনে এবং ভারপ্রাপ্ত অধিনায়ক তামিম ইকবালের নেতৃত্বে শ্রীলঙ্কায় গিয়ে তিন ম্যাচের ওয়ানডে সিরিজে হোয়াইটওয়াশ হয় দল। এরপর গেল সেপ্টেম্বরে চট্টগ্রাম টেস্টে আফগানিস্তানের কাছে ২২৪ রানের অপ্রত্যাশিত হার! অর্থাৎ বিশ্ব আসরের পর থেকে বাংলাদেশের ক্রিকেটের কোনো কিছুই সঠিক পথে চলছে না।

সেপ্টেম্বরের শেষ দিকে অবশ্য আফগানিস্তানের সঙ্গে ত্রিদেশীয় টি-টোয়েন্টি সিরিজের ট্রফিটি ভাগ করে নেয় বাংলাদেশ। তবে ক্রিকেটপ্রেমীদের মনে রাখার কথা, বৃষ্টির কারণে ফাইনালটি পরিত্যক্ত হয়েছিল। ততদিন পর্যন্ত হতাশা জড়িত ছিল মাঠের পারফরম্যান্সের সঙ্গে, কিন্তু এর পরের ধারাবাহিক ঘটনাগুলো বিস্তৃত হয়েছে মাঠের বাইরে, যা বাংলাদেশ ক্রিকেটের ভিতই একেবারে কাঁপিয়ে দিয়েছে এবং হতাশাকে ভীতিতে রূপান্তর করেছে।

২১ অক্টোবর থেকে ২৯ অক্টোবর- এই নয়টি দিন কোনো সাদামাটা সময় ছিল না- দেশের ক্রিকেট অনুরাগীদের জন্য অন্তত নয় এবং জাতীয় ক্রিকেট দলের সঙ্গে যুক্ত কারও জন্য তো নয়ই। ধারাবাহিক নজিরবিহীন ঘটনা বাংলাদশের ক্রিকেট ভক্তদের এতটাই অনুভূতিশূন্য করে দিয়েছে যে ভারত সফরে মুমিনুল হককে টেস্ট দলের দায়িত্ব দেওয়ার মতো উদ্ভট সিদ্ধান্তও তাদের কাছে খুবই গ্রহণযোগ্য মনে হয়েছে। এমন সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে অতীতে বহুবার তাদের প্রতিবাদ করতে দেখা গেলেও, এবার তারা কোনো প্রশ্ন তোলেনি।

বাংলাদেশের ক্রিকেট অঙ্গনের সঙ্গে যারা যুক্ত, তারা হয়তো ধারণা করেছিলেন যে গেল ২১ অক্টোবর বিকালে সবচেয়ে খারাপ সংবাদটি তারা পেয়েছিলেন। ক্রিকেটাররা ধর্মঘটের ডাক দিয়েছিলেন ১১ দফা দাবিতে যা পরবর্তীতে বেড়ে ১৩ দফা হয়েছিল। কিন্তু এর চেয়েও কঠিন বাস্তবতার মুখোমুখি তাদের হতে হয় মাত্র আট দিন পরই যখন তারা জানতে পারেন যে অন্তত আগামী এক বছরের জন্য ক্রিকেট খেলতে পারবেন না দেশের সেরা তারকা সাকিব আল হাসান! গেল বুধবার আন্তর্জাতিক ক্রিকেট কাউন্সিল (আইসিসি) এক বছরের স্থগিত নিষেধাজ্ঞাসহ দুই বছরের জন্য নিষিদ্ধ করে বিশ্বসেরা অলরাউন্ডারকে। সাকিব সাজা পাওয়ায় বাংলাদেশের ক্রিকেট যেন চূড়ান্ত আঘাতটি পেয়েছে আর এর আগের ঘটনাগুলোতে দেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় খেলাটি সম্পর্কে কিছু তেতো ও কুৎসিত সত্যও উন্মোচিত হয়েছে।

ছবি: ফিরোজ আহমেদ

মাত্র নয় দিনের মধ্যে অবকাঠামোগত ঘাটতি, ঘরোয়া ক্রিকেটের নিচের স্তরে দুর্নীতি, বোর্ড সদস্যদের কাছ থেকে খেলোয়াড়দের সম্মান দাবি, পারিশ্রমিক ও অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা নিয়ে তাদের অসন্তুষ্টি, বোর্ড পরিচালকদের অক্ষমতা থেকে শুরু করে শেষ পর্যন্ত জুয়াড়ির সঙ্গে সাকিবের জড়িত থাকা- এই নির্মম সত্যগুলোর কয়েকটি নতুন করে উন্মোচিত হয়েছে, আবার কয়েকটি আগের চেয়ে আরও জোরালোভাবে উপস্থাপিত হয়েছে।

খেলোয়াড়দের ধর্মঘটের ডাক দেওয়ার বিষয়টি ছিল বিসিবির দুর্বল পরিচালনা পদ্ধতির প্রথম নজির (ওই নয় দিনের মধ্যে)। তবে খেলোয়াড়রা কেন বোর্ডের কাছে না গিয়ে সরাসরি গণমাধ্যমের কাছে দাবি নিয়ে হাজির হয়েছিল, তা নিয়ে বিসিবি তীব্র ক্ষোভ প্রকাশ করেছিল। পরে দাবি করা হয় যে খেলোয়াড়রা যদি প্রথমেই বোর্ডের কাছে যেত, তবে বিসিবি দাবিগুলোর সমাধান করত। কিন্তু ক্রিকেটারদের এই পদক্ষেপ থেকে একটা ব্যাপার স্পষ্ট হয়ে ওঠে যে তারা বোর্ডের ওপর থেকে বিশ্বাস হারিয়ে ফেলেছিল এবং সেকারণে তারা জনসাধারণের সামনে দাবি উপস্থাপন করেছিল।

প্রথম, দ্বিতীয় এবং তৃতীয় বিভাগ ক্রিকেটে দুর্নীতির ঘটনা সাংবাদিক, খেলোয়াড়, বিসিবি পরিচালক থেকে শুরু করে নিয়মিত ক্রিকেট অনুসারীদেরও অজানা নয়। সেখানে পয়েন্ট কেনা-বেচা এবং পক্ষপাতদুষ্ট ও দুর্বল আম্পায়ারিং আগে থেকেই চলছে এবং অতীতেও বিক্ষিপ্তভাবে দুর্নীতি নিয়ে প্রশ্ন উঠেছিল। কিন্তু খেলোয়াড়রা যখন তাদের প্রতিবাদের সময় ঘরোয়া ক্রিকেটে দুর্নীতির কথা আলাদাভাবে উল্লেখ করেছিলেন, তখন এই ইস্যুটি ভীষণভাবে সবাইকে নাড়া দেয়।

দেশের প্রতিটি বিভাগে ক্রিকেটীয় অবকাঠামোর উন্নতির দাবিও তুলেছিলেন খেলোয়াড়রা। সেই সঙ্গে অনুশীলনের সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধি করা এবং খেলোয়াড়, স্থানীয় কোচ এবং এমনকি গ্রাউন্ডসম্যানদের বেতন কাঠামোতে ভারসাম্য আনার আহ্বান জানান তারা। এতে করে জনগণ এই ধারণা পেয়েছে যে ক্রিকেটীয় কার্যক্রম পরিচালনায় অন্যান্য দেশগুলোর চেয়ে বাংলাদেশ কতটা পিছিয়ে রয়েছে।

ছবি: ফিরোজ আহমেদ

সংকট সমাধানে বিসিবির প্রথম চেষ্টাটি ছিল নিতান্তই হাস্যকর। শুরু থেকেই অবশ্য তারা বলছিল যে ক্রিকেটারদের দাবিগুলো যৌক্তিক। কিন্তু খেলোয়াড়রা ধর্মঘট ডাকার একদিন পর সংবাদ সম্মেলনে বিসিবির এবং ক্রিকেটার্স ওয়েলফেয়ার অ্যাসোসিয়েশনের (কোয়াব) কর্তারা ক্রিকেটারদের বিরুদ্ধে ক্ষোভ উগড়ে দেন। বিশেষ করে বোর্ড সভাপতি নাজমুল হাসান দৃষ্টিকটুভাবে অতীতে কীভাবে ক্রিকেটারদের ব্যক্তিগত সমস্যার সমাধান করেছেন, সেসব গণমাধ্যমের সামনে তুলে ধরেন।

যাই হোক, ২৩ অক্টোবর অচলাবস্থা কেটে যায়- অন্তত সেটাই ধারণা করেছিলেন সবাই। সেদিন রাতে বিসিবি কার্যালয়ে আলোচনার পর বোর্ড ক্রিকেটারদের ১১ দাবির নয়টি মেনে নেয় এবং তারা ভারত সফরের প্রস্তুতি ক্যাম্পে যোগ দিতে সম্মত হয়। কিন্তু ২৫ অক্টোবর অনুশীলনের প্রথম দিনে অনুপস্থিত থাকেন সাকিব। যেহেতু বিসিবির বিপক্ষে আন্দোলনের নেতৃত্বে ছিলেন তিনি, তাই তার না থাকায় নানা প্রশ্ন সৃষ্টি হয়েছিল। সেসব জিজ্ঞাসার উত্তর বিসিবি কর্তারাও দিতে ব্যর্থ হয়েছিলেন।

পরের দিনটি শুরু হয়েছিল সাকিবের বিরুদ্ধে বিসিবির ব্যবস্থা নেওয়ার খবর দিয়ে। কারণ বোর্ডের সঙ্গে চুক্তির শর্ত ভঙ্গ করে দেশের শীর্ষস্থানীয় একটি মোবাইল ফোন অপারেটরের সঙ্গে ব্যক্তিগত চুক্তি স্বাক্ষর করেছিলেন তিনি। দিনভর নাটকের পর সাকিবকে কারণ দর্শানোর চিঠি পাঠানো হয়েছিল। ফলে সাকিবের ভারত সফরে অংশ নেওয়া নিয়ে অনিশ্চয়তা তৈরি হয় এবং ঠিক সেদিনই আরেকটি দুঃসংবাদে কালো ছায়া নেমে আসে ক্রিকেট অঙ্গনে। পারিবারিক কারণে সফর থেকে নিজের নাম প্রত্যাহার করে নেন তামিম ইকবাল।

ওই দিনই, বিসিবি সভাপতি নাজমুল হুট করে জাতীয় ক্রিকেট লিগের (এনসিএল) তৃতীয় রাউন্ডে খেলতে থাকা নয়জন খেলোয়াড়কে জরুরি ভিত্তিতে ডেকে পাঠান ঢাকায়। কারণ তাদেরকে যেন পর্যবেক্ষণ করে দেখতে পারেন নতুন স্পিন বোলিং পরামর্শক ড্যানিয়েল ভেট্টোরি, যার পেছনে বিসিবির হাজার হাজার ডলার ব্যয় করছে। বিসিবি কি আগে থেকে জানত না যে ভেট্টোরি বাংলাদেশে আসছেন? নইলে কেন হঠাৎ করে খেলোয়াড়দের ডেকে পাঠানো হবে? দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা নিয়ে কাজ করার বুলি আওড়ানো একটি বোর্ডের এমন অকস্মাৎ সিদ্ধান্ত ছিল একেবারেই হাস্যকর।

Shakib Al Hasan
ছবি: ফিরোজ আহমেদ

এর পরের দুদিনে ক্রিকেটাররা দুটি প্রস্তুতি ম্যাচ খেললেও সাকিবকে দেখা যায়নি। গোটা পরিস্থিতিকে বোর্ড প্রধান ‘অস্পষ্ট’ বলে উল্লেখ করেন এবং ভারত সফরের টেস্ট দল ঘোষণা পিছিয়ে দেওয়া হয়।

তারপর আসে ২৯ অক্টোবর, তথ্য গোপনের কারণে সাকিবকে নিষিদ্ধ করা হয়। বাংলাদেশের ক্রিকেট ইতিহাসে এর চেয়ে বড় আঘাত কখনও আসেনি। স্তব্ধ হয়ে পড়ে গোটা দেশ। বোর্ড পরিচালকরা সেদিনই ভারত সফরের জন্য একটি সংশোধিত টি-টোয়েন্টি স্কোয়াড এবং টেস্ট স্কোয়াড ঘোষণা করেন। পরদিন সাকিবকে ছাড়াই প্রথমবারের মতো ভারতের মাটিতে পূর্ণাঙ্গ সিরিজ খেলতে দেশ ছাড়ে টাইগাররা।

গত কয়েকদিনে বাংলাদেশের ক্রিকেট কাঠামোয় প্রচুর ফাটল ধরা পড়েছে। শক্তিশালী ভারতীয় দলের বিপক্ষে আসন্ন তিনটি টি-টোয়েন্টি ম্যাচে বিপর্যস্ত বাংলাদেশ দল কীভাবে পারফর্ম করে, সেটাই এখন দেখার বিষয়। আর সাম্প্রতিক হতাশাজনক ঘটনাগুলোকে পাশে সরিয়ে যদিও-বা বাংলাদেশ ভারতের বিপক্ষে ভালো কিছু করে, তবুও ভবিষ্যতে অনেকগুলো ক্ষেত্রে ব্যাপক পরিবর্তন ঘটাতে হবে। সেই দিকগুলো সংশোধন যদি না করা হয়, তবে বাংলাদেশ দলকে নিয়ে উদ্বিগ্ন না হয়ে উপায় নেই।

আর বিসিবি যদি সাম্প্রতিক অভিজ্ঞতাগুলোকে নিতান্ত দুর্ভাগ্যজনক বিচ্ছিন্ন ঘটনা হিসাবে উপেক্ষা করার সিদ্ধান্ত নেয়, তাহলে দেশের ক্রিকেট আরও বড় বিপর্যয় নেমে আসাটা কেবল সময়ের ব্যাপার মাত্র।

Comments

The Daily Star  | English

Large-scale Chinese investment can be game changer for Bangladesh: Yunus

The daylong conference is jointly organised by Bangladesh Economic Zones Authority and Bangladesh Investment Development Authority

1h ago