শুভ জন্মদিন: রণদা প্রসাদ সাহা
মাত্র সাত বছর বয়সে রণদার চোখের সামনে মায়ের মৃত্যু হয়। বিনা চিকিৎসায় আর অবহেলায় মারা যায় মা। উচ্ছল শৈশব থমকে যায় মার অকাল মৃত্যুতে। ডানপিটে বালক জীবনের কঠিনতম সময়ে শুরু করেন তখন থেকেই। এই মৃত্যুই সাত বছরের বালকের জীবনের দর্শন বদলে দেয়। মনে মনে সংকল্প করে মানুষের জন্য, মানবতার জন্য কিছু করতে হবে।
মা মারা যাবার পরে বাবা দেবেন্দ্রনাথ আত্মীয়-পরিজনের পরামর্শে দ্বিতীয় বিয়ে করেন। পড়াশোনার জন্য তাকে পাঠিয়ে দেওয়া হয় মামার বাড়ি। কিন্তু, বাঁধাধরা জীবন তার ভালো লাগেনি। তাই মাত্র ১৪ বছর বয়সে বাড়ি থেকে পালিয়ে কলকাতা চলে যায় সে।
অচেনা-অজানা পরিবেশে পেটের তাগিদে জীবন বাঁচাতে কুলিগিরি, রিকশা চালানো, ফেরি করা, খবরের কাগজ বিক্রির মতো বিচিত্র কাজ করেছেন রণদা। কলকাতায় তখন সারাবাংলা থেকে কাজের সন্ধানে ছুটে আসা ভুখা মানুষের ভিড়। মানুষের দুঃখ-দুর্দশা দেখে এরইমধ্যে স্বদেশী আন্দোলনে যোগদান করে কয়েকবার কারাবরণ করেন তিনি।
১৯১৪ সালের ২৮ জুলাই প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শুরু হয়। ভারত থেকেও অসংখ্য তরুণ যুদ্ধের জন্য সেনাবাহিনীতে নাম লিখায়। বাংলার সেই কিশোর যোগ দেয় বাঙালিদের প্রথম সামরিক সংগঠন বা ইউনিট ‘বেঙ্গল এ্যাম্বুলেন্স কোর’-এ।
যুদ্ধ শেষে সেনাবাহিনী ত্যাগ করে রেলওয়ে বিভাগের টিকিট কালেক্টরের চাকরি নেন। ১৯৩২ সালে এই চাকরি থেকে স্বেচ্ছায় অবসর নেন। নিজের সঞ্চয় করা ও অবসরের এককালীন অর্থ দিয়ে শুরু করেন লবণ ও কয়লার ব্যবসা। বছর চারেকের মধ্যেই ব্যবসায়িকভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়ে ওঠেন তিনি। পরবর্তীতে কয়লার ব্যবসায় লাভ বেশি হওয়ায় লবণের ব্যবসা বাদ দিয়ে কয়লার ব্যবসায় মনোযোগ দেন।
১৯৩৯ সালে জমিদার নৃপেন্দ্রনাথ চৌধুরী, ডা. বিধান চন্দ্র রায়, বিচারপতি জে. এন. মজুমদার ও নলিনী রঞ্জন সরকারকে সঙ্গে নিয়ে তিনি গড়ে তোলেন ‘বেঙ্গল রিভার সার্ভিস’ নামে একটি নৌ-পরিবহণ কোম্পানি। কিন্তু, অল্প কিছুদিনের মধ্যে অন্যান্য শরিকদের কাছ থেকে সব অংশ কিনে নিয়ে তিনি কোম্পানির একক মালিকানা লাভ করেন। তারপর শুধুই এগিয়ে যাওয়া। সেখান থেকে তিনি কোম্পানির লঞ্চগুলির মেরামত ও রক্ষণাবেক্ষণের উদ্দেশ্যে নারায়ণগঞ্জে একটি ডকইয়ার্ড নির্মাণ করেন। এ অঞ্চলে এটিই প্রথম ডকইয়ার্ড। সেখানে বেঙ্গল রিভার সার্ভিসের লঞ্চ ছাড়াও অন্যান্য কোম্পানির এবং ব্যক্তিগত লঞ্চও মেরামত ও রক্ষণাবেক্ষণ করা হতো।
১৯৪০ সালে রণদা নারায়ণগঞ্জের জর্জ অ্যান্ডারসনের যাবতীয় পাট ব্যবসা কিনে নেন। পাট মজুদের জন্য তিনি পাটকল সংলগ্ন বেশ কয়েকটি গুদাম নির্মাণ করেন।
এভাবে যে কিশোর তার মাকে হারিয়েছে চিকিৎসার অর্থাভাবে, বড় হয়েছে চরম দারিদ্র্যের মধ্যে দিয়ে তিনিই পরে হয়ে উঠেন দেশের শ্রেষ্ঠ ব্যবসায়ীদের একজন।
তিনি আর কেউ নন। তিনি হলেন আমাদের রণদা প্রসাদ সাহা। ১৮৯৬ সালের আজকের (১৫ নভেম্বর) তিনি সাভারের অদূরে শিমুলিয়ার কাছৈড় গ্রামের মাতুলালয়ে জন্মগ্রহণ করেন। বাবার নাম দেবেন্দ্রনাথ পোদ্দার, মা কুমুদিনী দেবী। তিনভাই এক বোনের মধ্যে রণদা প্রসাদ দ্বিতীয়। রণদা প্রসাদ সাহার পৈতৃক বাড়ি টাঙ্গাইল জেলার মির্জাপুর উপজেলায়।
দেশ বিভাগের আগেই রণদা বাংলাদেশের অন্যতম প্রধান ব্যবসায়ী এবং শিল্প উদ্যোক্তা হিসেবে প্রতিষ্ঠা পান। তিনি চাকরি শুরু করেছিলেন যুদ্ধক্ষেত্রে অসুস্থ ও আহতদের সেবাদানের মাধ্যমে। একজন সফল ব্যবসায়ী হিসেবে রূপান্তরিত হওয়ার পরও তিনি সমাজের বিভিন্ন ক্ষেত্রে সেবা প্রদান অব্যাহত রাখেন।
শৈশব থেকে মানবকল্যাণের যে স্বপ্ন নিজের মনে লালন করেছিলেন তার বাস্তবায়ন শুরু হয় ১৯৩৮ সালে মাতামহীর নামে শোভাসুন্দরী ডিসপেনসারি ও মায়ের নামে কুমুদিনী হাসপাতাল প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে। ১৯৪৩ সালের দুর্ভিক্ষে আড়াই শতাধিক লঙ্গরখানা পরিচালনা করেন তিনি। রণদা প্রসাদের আহ্বানে ১৯৪৪ সালে অবিভক্ত বাংলার গভর্নর লর্ড আর জি কেসি কলকাতা থেকে নদীপথে দুর্গম পথ পাড়ি দিয়ে এক অজোপাড়া গাঁয়ে এসে কুমুদিনী হাসপাতাল আনুষ্ঠানিকভাবে উদ্বোধন করেন। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সংকটময় সময়ে রণদা রেডক্রসকে আড়াই লাখ রূপি দান করেন।
১৯৪৩ সালে কুমুদিনী হাসপাতালের নির্মাণ কাজ শুরু হয় এবং ১৯৫৩ সালে কুমুদিনী হাসপাতালে ক্যান্সারের চিকিৎসা চালু হয়। বাংলাদেশে এখানেই প্রথম ক্যান্সার রোগীর চিকিৎসা শুরু হয়।
অবহেলিত নারী সমাজকে সমাজের মূলধারায় নিয়ে আসতে ১৯৪০ সালে তার প্র-পিতামহী ভারতেশ্বরী দেবীর নামানুসারে প্রতিষ্ঠা করেন নারী শিক্ষার অনন্য প্রতিষ্ঠান ভারতেশ্বরী হোমস। তারপরে একে একে বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেন দেশের বিভিন্ন স্থানে।
১৯৪৭ সালে রণদা তার সব ব্যবসা, কল-কারখানা, সম্পত্তি এবং দাতব্য প্রতিষ্ঠানসমূহ পরিচালনার জন্য ‘কুমুদিনী ওয়েলফেয়ার ট্রাস্ট অব বেঙ্গল’ গঠন করেন।
১৯৪৭ সালে যখন দেশভাগ হয় ধর্মের ভিত্তিতে তখন অসংখ্য মানুষ এই অঞ্চল থেকে স্রোতের মতো দেশান্তরী হয়ে পশ্চিম বাংলায় যান। কিন্তু, সেই সময় কলকাতার ব্যবসা-বাণিজ্যের পাঠ চুকিয়ে সেখানকার অঢেল সম্পদের মায়া ত্যাগ করে সম্পূর্ণ বিপরীতমুখী রণদা নিজের মাতৃভূমিতে পাকাপাকিভাবে ফিরে আসেন।
ব্রিটিশ সরকারকে দ্বিতীয় মহাযুদ্ধে সহযোগিতা প্রদানের জন্য রণদা ১৯৪৪ সালে ‘রায় বাহাদুর’ খেতাব প্রাপ্ত হন। ১৯৬৯ সালে পাকিস্তান সরকার সমাজসেবার জন্য তাকে ‘হেলাল এ পাকিস্তান’ খেতাব প্রদান করে। পূর্ববাংলার প্রতি পাকিস্তানের বৈষম্যমূলক আচরণের কারণে তিনি সেই খেতাব গ্রহণ করেননি।
১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধকালে শুভাকাঙ্ক্ষীরা রণদা প্রসাদ সাহাকে দেশত্যাগের পরামর্শ দিয়েছিলেন। কিন্তু, মাতৃভূমি ছেড়ে তিনি কোথাও যেতে রাজি হননি। ১৯৭১ সালের ৭ মে পশ্চিম পাকিস্তানের হানাদার বাহিনীর সহযোগীরা মির্জাপুর থেকে রণদা প্রসাদ সাহা ও তার ছেলে ভবানী প্রসাদ সাহাকে ধরে নিয়ে যায়। তারপর, তাদের কোনো খোঁজ পাওয়া যায়নি।
১৯৭৮ সালে রণদা বাংলাদেশের সর্বোচ্চ খেতাব স্বাধীনতা দিবস পুরস্কার পান। ১৯৮৪ সালে ‘কুমুদিনী ওয়েলফেয়ার ট্রাস্ট’ ও সমাজ সেবায় অসামান্য অবদানের জন্য ‘স্বাধীনতা দিবস পুরস্কার’ লাভ করে।
দরিদ্র পরিবারে জন্ম নিয়ে, নানান ঘাত প্রতিঘাত পেরিয়ে রণদা প্রসাদ নিজ কর্মগুণে যে বিশাল সম্পদের ভাণ্ডার গড়ে তুলেছিলেন তার পুরোটাই ব্যক্তিগত ভোগে খরচ না করে মানবতার কল্যাণে উৎসর্গ করে গেছেন।
আজো তার হাতে গড়া প্রতিষ্ঠানগুলো আলো ছড়িয়ে যাচ্ছে দেশের আনাচে-কানাচে। রণদার উত্তরসূরিরা মানবতার সেবার পরিধি বাড়িয়েছে বহুগুণ। আজকে এই কর্মবীর রণদা প্রসাদ সাহাকে শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করছি। কারণ আজ তার জন্মদিন। রণদার সহকর্মীরা ভালোবেসে তাকে ডাকতো ‘জ্যাঠা মনি’ বলে। শুভ জন্মদিন জ্যাঠা মনি!
Comments