অহল্যাবাঈ ও তার শহর

indore1
ছবি: একুশ তাপাদার

ইন্দোর ভারতের সবচেয়ে পরিচ্ছন্ন নগরী, এখানে আসার আগেই জানা ছিল। তবে ইন্দোর এই অঞ্চলের সবচেয়ে বুড়ো শহরগুলোর একটি তা জানা ছিল না। জানা ছিল না অহল্যাবাঈ’র কথা, যিনি নারীকে স্বাধীনচেতা দেখতে চেয়েছিলেন এবং অতি অবশ্যই এখানে আসার আগে এ শহরের সাবলীল, প্রাণবন্ত জীবনযাপন সম্পর্কে কোনো ধারণাই থাকবার কথা নয়।

খেলা কাভার করতে এসে খেলার বাইরের অন্য বিষয় নিয়ে লেখার ফুরসত বের করা বেশ শক্ত। বাংলাদেশ তিন দিনে টেস্ট হেরে গেল বলেই মিলল কিছু ফাও সময়। চলতি পথে শহরটা এমনিতে দেখা হচ্ছিল কিন্তু আরেকটু সময় নিয়ে দেখা, আরেকটু ভিন্নভাবে অবলোকন করার দরকার হয়ে পড়ছিল। বাড়তি পাওয়া দুইদিনে তা কিছুটা হয়ে গেল।

ইন্দোর মধ্য প্রদেশের রাজধানী নয় কিন্তু সবচেয়ে বড় শহর এবং সবচেয়ে প্রাচীন জনপদ। পুরনো শহরের রাজবাড়া, পুরাতন মন্দির, ইমামবাড়া কিংবা লালবাগ প্যালেস দেখলে এখানকার প্রাচীনত্ব টের পাওয়া যায়। যেই সেই প্রাচীন না, সেই ১২শ শতকেও ছিল এই শহর। তবে এই শহরের জনপদ আর স্থাপনাই কেবল প্রাচীন আর মানুষের জীবনযাপন ও চিন্তা চেতনাও একদম তাই- সেটা নয়। 

indore2
ছবি: একুশ তাপাদার

ইন্দোরে দিন আটেকের অবস্থান তাই ভরপুর স্বস্তিই দিয়েছে। পরিচ্ছন্নতার কারণে স্বস্তি তো ছিলই, এখানকার আনন্দমুখরিত জীবন দিয়েছে যেন চোখের শান্তি, মনের শান্তি।

ইন্দোরের রাস্তা যেন জানান দেয়, এখানে নারী পুরুষের অবস্থান সমান-সমান। প্রায় সমান সংখ্যক ছেলে-মেয়ে মোটর বাইক আর স্কুটি নিয়ে দাপিয়ে বেড়ায় শহরময়। সবার মধ্যেই একটা প্রাণের জোয়ার। বিশেষ করে নারীদের চাল-চলন আর চেহারায় ব্যক্তিত্বের একটা আভা। আরেকটু খোঁজ নিয়ে জানা গেল, এর কারণও আছে। এখানকার বেশিরভাগই নারীই যে অর্থনৈতিকভাবে সাবলম্বী। পুরুষ অর্থ যোগান দেবেন আর মেয়েরা ঘর-সংসার সামলাবে, উপমহাদেশের চিরায়ত এই রীতি বোধহয় এখানে কিছুটা মার খেয়েছে। নারীরা ব্যবসা করছে, চাকরি করছে কিংবা কোনো একভাবে নিজের পায়ে দাঁড়ানো।  

indore4

ঠিক যেমন অহল্যাবাঈ হোলকার চেয়েছিলেন। হোলকার সম্রাজ্যের কারণেই ইন্দোর বিখ্যাত। এই হোলকার সম্রাজ্যেরই রানী ছিলেন অহল্যাবাঈ। সেই ১৭৬৭ সালে। ৩০ বছর শাসন করেন অহল্যা। নারী হয়েও ভদ্রমহিলা সেই যুগেও চলনসই পড়াশোনা জানতেন।

এখানকার ইতিহাস বলে তিন যুগের শাসনে হোলকার রাজ্যকে শক্ত ভিত দিতে পেরেছিলেন অহল্যাবাঈ। অবকাঠামো নির্মাণের পাশাপাশি মানুষের মনন তৈরিতেও রেখেছেন ভূমিকা। প্রচুর পরিমাণ মন্দিরের দৃষ্টিনন্দন স্থাপনা যেমন বানিয়েছেন, করে দিয়েছেন মসজিদও। মুসলিম ফকির, সন্তদের আশ্রয় দিতেও বিন্দুমাত্র দ্বিধা করেননি। তবে তার চিন্তায় সবচেয়ে অগ্রাধিকার পেয়েছিল নারী স্বাধীনতা। মেয়েরা যেন পুরুষের ওপর নির্ভরশীল না হয়ে পড়ে তার জন্য অহল্যাবাঈ’র চেষ্টা ছিল তীব্র, নিয়েছিলেন নানান উদ্যোগ।

ইন্দোরের মেয়েরা সেই ঐতিহ্য বহন করেই এমন সাবলীল কিনা কে জানে! ফেরার আগের দিন অহল্যাবাঈ’র স্মৃতিবিজড়িত এক মন্দিরে যাওয়া হলো। সেখানে এক সংগ্রহশালায় রয়েছে তার আমলে ব্যবহৃত কিছু জিনিস। জানা হলো মহেশ্বরের কথা। ইন্দোর থেকে একশো কিলোমিটার দূরে দেবী অহল্যা হোলকারের মূল রাজপ্রাসাদ। ছবিতে দেখা যায়, নদীর তীরে অবস্থিত ওই সুবিশাল ভবন চোখ ধাঁধানো সৌন্দর্য নিয়ে দাঁড়িয়ে। স্বচক্ষে দেখতে এতদূর যাওয়ার সময়-সুযোগ কোনোটাই হলো না।

ইন্দোরের স্ট্রিট ফুড

রাতেও ইন্দোর যেন উদ্দীপ্ত। মানুষের আড্ডায় মুখরিত শহরের কিছু প্রান্তর জানান দেয়, কতটা প্রাণোচ্ছল ভাব নিয়ে চলে এ শহর। ছাপ্পান্ন দোকান আর সারাফা বাজার নামে দুটো স্ট্রিট ফুডের গলি মুগ্ধ করবে যে কাউকে। হরেক রকমের মুখরোচক খাবার তো আছেই, আপনার চোখে পড়বে প্রাণের সঞ্চারণ। মজার ব্যাপার, অসংখ্য বৈচিত্র্যের এসব খাবার সবই নিরামিষ। নিরামিষ দিয়ে এত রকমের খাবার বানানো যায়, এখানে না এলে ভাবাই যেত না।

indore3
ছবি: একুশ তাপাদার

রাত ৯টা থেকে ২টা পর্যন্ত বাহারি স্ট্রিট ফুড চলছে, চলছে মানুষের আড্ডা। ভিড় লেগেই আছে, হাজার হাজার মানুষ কিনছে, খাচ্ছে। সবচেয়ে বিস্ময়কর হলো একটুও ময়লা কেউ রাস্তায় ফেলছে না। চা-দোকানওয়ালা থেকে শুরু করে সবারই একটা ডাস্টবিন আছে। আলাদা করে মানুষের এই সংস্কৃতিবোধ নজর কাড়তে বাধ্য।

খেলার মাঠ

যে কাজে এসেছি সে জায়গাটা স্বস্তির কিনা তাও জানিয়ে দেওয়া ভালো। মধ্য প্রদেশ ক্রিকেট অ্যাসোশিয়েশনের মাঠ সুব্যবস্থাপনার এক উদাহরণই হতে পারে। হোলকার মাঠে আন্তর্জাতিক ক্রিকেট হয় কালেভদ্রে। রঞ্জী ট্রফি ও অন্যান্য ঘরোয়া খেলা অবশ্য নিয়মিতই হয়ে থাকে। খেলা হোক না হোক, মাঠের প্রতিটি কোণা পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন আর টিপটপ থাকা চাই। বাংলাদেশের অনেক মূল মাঠেও যা করা হয় না। ফেরার সময় বাংলাদেশের সাংবাদিকদের স্থানীয় সংগঠকরা একটি স্মরণিকা উপহার দিলেন। জীবনভর ইন্দোরকে মনে রাখবার একটা ব্যবস্থা আরকি। প্রাচীন এই শহরে এসে এর উষ্ণতা পেলে সহজেই ভুলে যাওয়ার কথাও না অবশ্য!

Comments

The Daily Star  | English

No price too high for mass deportations

US President-elect Donald Trump has doubled down on his campaign promise of the mass deportation of illegal immigrants, saying the cost of doing so will not be a deterrent.

3h ago