ফার্স্ট ডিভিশন ক্রিকেট খেলতেন প্রবীর মিত্র

চারশ সিনেমার অভিনেতা প্রবীর মিত্র। এইচ আকবর পরিচালিত জলছবি সিনেমা দিয়ে বড় পর্দায় আসেন তিনি। সিনেমার বাইরে কিছু করেননি এই শিল্পী। এখন তিনি অসুস্থ। চার দেয়ালের মধ্যে কাটছে তার সময়। জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারে এইবার চারজনের নাম এসেছে, যারা আজীবন সম্মাননা পাচ্ছেন, তার মধ্যে প্রবীর মিত্র একজন। গুণী এই শিল্পী কথা বলেছেন ডেইলি স্টারের সঙ্গে।
Prabir-Mitra.jpg
প্রবীর মিত্র। ছবি: সংগৃহীত

চারশ সিনেমার অভিনেতা প্রবীর মিত্র। এইচ আকবর পরিচালিত জলছবি সিনেমা দিয়ে বড় পর্দায় আসেন তিনি। সিনেমার বাইরে কিছু করেননি এই শিল্পী। এখন তিনি অসুস্থ। চার দেয়ালের মধ্যে কাটছে তার সময়। জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারে এইবার চারজনের নাম এসেছে, যারা আজীবন সম্মাননা পাচ্ছেন, তার মধ্যে প্রবীর  মিত্র একজন। গুণী এই শিল্পী কথা বলেছেন ডেইলি স্টারের সঙ্গে।

অভিনয় জীবনে কখনও নায়ক, কখনও ভাই, কখনও নেতিবাচক চরিত্র, কখনও বাবা চরিত্রে অভিনয় করেছেন। অভিনয়ে কখনও ভাটা পড়েনি তার। এমনও হয়েছে- একই সময়ে তিন বা চারটি সিনেমায় অভিনয় করেছেন।

প্রবীর মিত্র বলেন, “অভিনয় আমার প্রেম, ধ্যান-জ্ঞান-ভালোবাসা। অভিনয় আমার সবকিছু।”

রঙিন নবাব সিরাজদৌলা সিনেমায় তিনি নবাবের চরিত্রে অভিনয় করেছেন। এদেশে নবাব সিরাজদৌলাকে নিয়ে দুটি সিনেমা নির্মিত হয়েছিলো। একটিতে অভিনয় করেছিলেন প্রয়াত আনোয়ার হোসেন। সেটি ছিল সাদাকালো এবং প্রথম নবাব সিরাজদৌলা। অনেক পরে এসে নির্মিত হয়েছিলো রঙিন নবাব সিরাজদৌলা, যেখানে প্রবীর মিত্র অভিনয় করেন।

ঋত্বিক ঘটকের বহুল প্রশংসিত তিতাস একটি নদীর নাম সিনেমায় অভিনয় প্রবীর মিত্রর ক্যারিয়ারে মাইলফলক হয়ে আছে। এই সিনেমাটি তাকে দিয়েছে অন্যরকম খ্যাতি।

প্রবীর মিত্র বলেন, “ওটা ছিলো স্বপ্নের মতো। না চাইতেও বড় কিছু পাওয়ার মতো।”

গুণী অভিনেতা প্রবীর মিত্রর জন্ম ১৯৪০ সালের ১৮ আগস্ট চাঁদপুরে। বড় হয়েছেন পুরান ঢাকায়। পোগজ স্কুলে পড়ালেখা করেছেন তিনি। এরপর জগন্নাথ কলেজ থেকে স্নাতক সম্পন্ন করেন।

স্কুলজীবনে রবীন্দ্রনাথের ডাকঘর নাটকে অভিনয় করেন। সেই যে শুরু হলো- অভিনয় চলতেই থাকে। আরও কিছুদিন পুরান ঢাকায় মঞ্চ নাটকে অভিনয় করেন। সেই সময়ে প্রয়াত অভিনেতা ফরিদ আলীর সঙ্গে পরিচয় ঘটে। ফরিদ আলী প্রবীর মিত্রকে অভিনয়ের সুযোগ করে দেন।

প্রবীর মিত্র বলেন, “ফরিদ আলী আমার জন্য সেই সময়ে অনেক করেছেন। অনেকের কাছে নিয়ে গেছেন। তার মাধ্যমেই নানাজনের সঙ্গে পরিচয় ঘটে আমার এবং একটা সময়ে অভিনয়ে চলে আসি।”

তিতাস একটি নদীর নাম সিনেমায় কাজ করার স্মৃতি জানতে চাইলে প্রবীর মিত্র বলেন, “ওখানেও আমাকে নিয়ে যান ফরিদ আলী। ওই সময়ে আমি জীবন তৃষ্ণা সিনেমায় শুটিং করছিলাম। কিছুই জানতাম না। হঠাৎ ফরিদ আলী আমাকে নিয়ে যান ঋত্বিক ঘটকের কাছে। ঋত্বিক ঘটক শুয়ে শুয়ে বই পড়ছিলেন এবং আমাকে দেখছিলেন, কিছুক্ষণ দেখার পর তার কথায় বুঝতে পারি আমাকে তিনি পছন্দ করেছেন।”

চলচ্চিত্র অভিনেতা প্রবীর মিত্র একসময় ক্রিকেট খেলেছেন ঢাকা ফার্স্ট ডিভিশনে। হকিও খেলেছেন। এ বিষয়ে তিনি বলেন, “অভিনেতা হব কখনও ভাবিনি। খেলতে খেলতে জীবন পার করতে চেয়েছিলাম। হঠাৎ অভিনয়টা চুম্বকের মতো টেনে ধরলো। তারপর থেকে অভিনেতাই হয়ে গেলাম।”

প্রবীর মিত্র অভিনীত চারশ সিনেমার মধ্যে অনেক সিনেমা সুপারহিট ব্যবসা করেছে। অভিনয় করতে করতে মানুষের মনে গেঁথে গেছেন তিনি। দীর্ঘ অভিনয় জীবনে কখনও অভিনয় থেকে বিরতিও নেননি। তাকে বলা হয়- ফিল্ম ম্যান।

প্রবীর মিত্রর কিছু উল্লেখযোগ্য সিনেমার মধ্যে রয়েছে- তিতাস একটি নদীর নাম, জীবন তৃষ্ণা, দুই পয়সার আলতা, রাজলক্ষ্মী শ্রীকান্ত, মিন্টু আমার নাম, নয়নের আলো, পুত্রবধূ, জয় পরাজয়, তীর ভাঙা ঢেউ, জলছবি, জন্ম থেকে জ্বলছি, বড় ভালো লোক ছিলো, চরিত্রহীন, অভাগী, হারানো সুর, দহন, যোগাযোগ ইত্যাদি।

অভিনয় জীবনের এতো বছর পর গত বছর থেকে হঠাৎ করেই অসুস্থ হয়ে পড়েন প্রবীর মিত্র। তার ভাষায়, “একদিন শুটিং করতে বাইরে যাবো, ঘর থেকে বের হওয়ার সময় দেখি হাঁটতে পারছি না, পায়ে ব্যথা করছে। তারপর থেকেই অসুস্থ। ডাক্তার দেখিয়েছি। এখনও চিকিৎসা চলছে। ডাক্তার তো বলেছেন ভালো হবে।”

দুই হাঁটুতে সমস্যা (অর্থারইটিজ) নিয়ে প্রবীর মিত্র এখন অভিনয় থেকে দূরে আছেন। কিন্তু অভিনয় তাকে আজও টানে। আফসোস করে বলেন, “অভিনয়টাই তো করেছি সারাজীবন। ভালো হয়ে গেলে আবারও সিনেমায় কাজ করতাম।”

অভিনয় থেকে দূরে থাকলেও প্রবীর মিত্র ঘরে বসে মাঝে মাঝেই ফিরে যান পেছনে। সিনেমা জগতের হারিয়ে যাওয়া মানুষদের কথা মনে পড়ে খুব। সমসাময়িক যারা বেঁচে আছেন, তাদের কথাও মনে পড়ে।

পেছনের কথা বলতে গিয়ে প্রবীর মিত্র বলেন, “কতো স্মৃতিই তো মনে পড়ে। মনে আছে- রাজ্জাকের সঙ্গে শুরুর দিকে একটি সিনেমা করি। পাশাপাশি বসে মেকআপ নিচ্ছিলাম। আমি তাকে বললাম, রাজ্জাক ভাই আমি তো সিনেমায় নতুন, ভুল হলে আপনি ঠিক করে দিয়েন। সেই থেকে রাজ্জাকের সঙ্গে আমার ঘনিষ্ঠতা বেড়ে গেলো। তিনি আমাকে আপন করে নিলেন।”

সিনেমা করতে এসে কোনো কোনো শিল্পীর সঙ্গে চমৎকার বন্ধুত্ব হয়েছে প্রবীর মিত্রর। সেইসব বন্ধুদের মধ্যে বেশিরভাগই বেঁচে নেই। আরেক গুণী অভিনয়শিল্পী এটিএম শামসুজ্জামানের সঙ্গে প্রবীর মিত্রর বন্ধুত্ব স্কুল জীবন থেকে। পোগজ স্কুলে একসঙ্গে পড়ালেখা করেছেন। এরপর তো অভিনয় করতে এসেও দুজনের বন্ধুত্ব আজও অটুট রয়েছে।

প্রবীর মিত্র বলেন, “এটিএম আমার স্কুল জীবনের বন্ধু। আজ আমিও অসুস্থ, এটিএমও অসুস্থ। চাইলেও দেখা করতে পারি না, খারাপ লাগে।”

প্রয়াত খ্যাতিমান আনোয়ার হোসেনের সঙ্গে অনেক সিনেমায় অভিনয় করেছেন প্রবীর মিত্র। দুজনের সম্পর্কও ছিলো চমৎকার। আনোয়ার হোসেন সম্পর্কে প্রবীর মিত্র বলেন, “এইরকম বড় মাপের শিল্পী কমই এসেছে আমাদের সিনেমায়। তাকে আমি ওস্তাদ বলে ডাকতাম। ওস্তাদের কাছ অনেক কিছু শিখেছি।”

কথা বলতে বলতে প্রবীর মিত্র অনেক কথা বলেন। সবই সিনেমার গল্প। সবই অভিনয় জীবনের গল্প। শেষ প্রশ্ন করি, যে জীবন পার করে এলেন, আপনি কি সেই জীবন নিয়ে সুখী?

প্রবীর মিত্র একটু সময় নেন। একটু ভাবেন। তারপর বলেন, “আমার চাওয়া সীমিত। ছোট্টতে আমি খুশি। ছোট ছোট পাওয়ায় আমি খুশি থাকি। কষ্ট একটাই অভিনয় করতে পারছি না। যদি ভালো হয়ে আবারও অভিনয় করতে পারতাম, তাহলে কোনো কষ্ট থাকতো না।”

Comments

The Daily Star  | English

Fire breaks out on LPG tanker at Kutubdia anchorage

31 people, including 18 crew comprising nine Bangladeshis, eight Indonesians, and one Indian, were rescued

1h ago